ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুসান্না সাজ্জিল

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি জোট নিরপেক্ষতা ছেড়ে মার্কিনবন্ধুত্ব

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ২২ জুন ২০১৬

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি জোট নিরপেক্ষতা ছেড়ে মার্কিনবন্ধুত্ব

ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বড়সড় পরিবর্তন ঘটেছে। সামরিক-স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে মার্কিনমুখী পদক্ষেপের দিকেই এগিয়েছে জোট নিরপেক্ষ কূটনীতিতে বিশ্বাসী দেশটি। বর্তমানে ভারত মার্কিন সামরিক-স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থের সহযোগী ও সহায়ক শক্তি। দক্ষিণ-চীন ও ভারত মহাসাগরে প্রতিবেশী চীনের আধিপত্য ঠেকাতেই ভারতের এমন কৌশল। পাশাপাশি ৪৮ রাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপের (এনএসজি) সদস্যপদ প্রাপ্তি এ সামরিক স্ট্র্যটেজির অন্যতম অংশ। এনএসজি-তে ভারতের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে বেশকিছু রাষ্ট্র বিরুদ্ধ মত দিয়েছিল। তবে সে অবস্থান থেকে বেশিরভাগ রাষ্ট্র সরে আসলেও তুরস্ক ও চীন এখনও তাদের সিদ্ধান্ত বদলায়নি। এছাড়া ৩৪ জাতির মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম’র (গঞঈজ) সদস্যপদেও শীঘ্রই দেশটির অন্তর্ভুক্তি ঘটবে বলে আশা করা যায়। বিশ্লেষকদের অভিমত আন্তর্জাতিক এসব অভিজাত ক্লাবের সদস্য প্রাপ্তিতে মার্কিন সমর্থন এবং প্রতিবেশী চীনকে কোণঠাসা করতেই দেশটির এমন দিক পরিবর্তন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একজন চৌকস রাষ্ট্রনায়ক। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার মাত্র দুই বছরের মধ্যেই তিনি অসংখ্য রাষ্ট্র সফর করেছেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের অবস্থানকেও পোক্ত করেছেন। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হাসি, উষ্ণ আলিঙ্গন এবং ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পোশাক বিদেশে ক্রমেই তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলছে। তাঁর নেতৃত্বেই ভারতের কূটনীতিতে বড়সড় পরিবর্তন ঘটেছে। জোট নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে এখন দেশটি আঞ্চলিক পরাশক্তিতে রূপ নিয়েছে। সেসঙ্গে ব্রিকস জোটকে পাশ কাটিয়ে ঢুকেছে মার্কিন বলয়ে। গত দুই বছরে এ নিয়ে চতুর্থবার যুক্তরাষ্ট্রের সফর করেছেন নরেন্দ্র মোদি। মোদির সফরের পর দু’দেশের পক্ষ থেকে প্রচারিত যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। সেই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে এশীয় প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলে দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতার পথ নিশানা হিসেবে ২০১৫ তে যে ভারত-মার্কিন যৌথ স্ট্যাটেজিক দৃষ্টিভঙ্গি গৃহীত হয়েছে তা আগামী বছরগুলোতে সহযোগিতার পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে। ভরতকে মার্কিন বলয়ে নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র শুধু দেশটিকে শক্তিধর দেশ হওয়ার লোভই দেখাচ্ছে না পাশাপাশি চীনভীতিকেও অতিরঞ্জিত করছে। ভারতের বামপন্থীরা এ চুক্তিকে মার্কিন ফাঁদ বলে উল্লেখ করছেন। এ চুক্তির ফলে এ প্রথম স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে মার্কিন যুদ্ধবিমান ও নৌবহর অবাধে ভারতের সমস্ত বিমান ও নৌঘাঁটি ব্যবহার করার সুযোগ পাবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উৎসাহেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব এ্যাস্টিন কার্টারের মধ্যে সম্প্রতি এমন চুক্তি স্বাক্ষর হলো। আপাতত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও আভাস মিলছে অনুরূপ আরও দুটি চুক্তি নিয়ে দর কষাকষি করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন রণতরী নিজেদের ইচ্ছামাফিক ভারতের নৌঘাঁটি ও সামরিক নৌবন্দরগুলোয় ভিড়তে পারবে। নৌবহর মেরামত কিংবা জ্বালানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে যতদিন খুশি বন্দরে অবস্থান করতে পারবে মার্কিন রণতরী। প্রয়োজনে ভারতের নিজস্ব সামরিক কাঠামো ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করবে যুক্তরাষ্ট্র। অনুরূপভাবে ভারতেরও তদ্রƒপ সুযোগ থাকছে মার্কিন বন্দর ব্যবহারের। কিন্তু প্রশ্ন তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। কারণ আঞ্চলিক শক্তিধর ভারতের মার্কিন বন্দর ব্যবহারের কোন প্রয়োজন আদৌ থাকবে কিনা। কারণ ভারতের প্রতিরক্ষা কেবল দেশটির সুরক্ষা নিশ্চিত করা। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বব্যাপী খবরদারি নয়। ঠা-া যুদ্ধত্তোর পরিবর্তিত বিশ্বে আমেরিকার যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা মোদি সরকার যেন সেই দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলেছেন। তবে মোদি সরকার কেবল মার্কিন স্বার্থসিদ্ধি হাসিল করছে এ কথা বলা বোকামি। কারণ মার্কিন বলয়ের বাইরেও ভারত তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। গত মাসে ইরান সফর তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। ইরান সফরকালে মোদি দেশটির সঙ্গে বন্দর ও রেলপথ নির্মাণের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। কৌশলগতভাবে বন্দরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বন্দরের ফলে ভারত তার জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায় এবং যোগাযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করতে আগ্রহী। রেলপথ নির্মাণের ফলে ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তান ও ইরানের যোগাযোগ সহজতর হবে। এ নিয়ে ভারত, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরও হয়েছে। নিজেদের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও জ্বালানি নিশ্চয়তার পাশাপাশি দায়িত্বশীল প্রতিবেশীর ভূমিকায়ও অবতীর্ণ ভারত। গত ৪ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আফগানিস্তান সফরকালে একটি হাইড্রোলিক স্টেশন উদ্বোধন করেন। যা ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঙ্কের বৈদেশিক সাহায্য। এ কাজের মাধ্যমে ভারত একটি দায়িত্বশীল ও উদার মনোভাব সম্পন্ন প্রতিবেশী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এ উদারতা ও দায়িত্বশীলতার পেছনেও রয়েছে আঞ্চলিক রাজনীতি। আর তা হলো আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব খর্ব করা। আফগানিস্তান সফরের পর মোদি সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো ভ্রমণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ রাখেন। এ ভাষণ প্রদানের মধ্য দিয়ে সুদৃঢ় হলো মার্কিন-ভারত সম্পর্ক। মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণকালে মোদি আমেরিকাকে ‘অপরিহার্য অংশীদার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সেই অংশীদারিত্বের কারণেই সম্ভবত গত ৭ জুন শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-জাপান ভারতের যৌথ নৌ-মহড়া। চীনের সঙ্গে জাপানের একটি দ্বীপ নিয়ে যে বিরোধ তাকে কেন্দ্র করেই এ নৌ-মহড়া। ২০০৭ সালের পর এ নিয়ে দ্বিতীয়বার যৌথ মহড়ার আয়োজন করল জাপান। ইরানে বন্দর নির্মাণ ও জাপান-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ মহড়া সহজভাবে নেয়নি প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন। স্বভাবতই চীন এতে ক্ষুব্ধ। এ নিয়ে চীনের গ্লোবাল টাইমস পত্রিকায় ভারতকে সতর্ক করা হয়েছে। তারা বলেছে, চীনকে কোণঠাসা করতে মার্কিন পরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ায় শেষতক ভারতের কোন লাভ হবে না। বরং, বাধাপ্রাপ্ত হবে ভারতের উন্নয়ন ও বিকাশ। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনের সতর্কতায় ভীত নন। তার নেতৃত্বেই ভারতকে আঞ্চলিক শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণতি করার স্বপ্নে বিভোর তিনি।
×