ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসার অভাবে বছরে অপঘাতে মারা যায় ৭০ হাজার

পূর্ণাঙ্গ জরুরী চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই অধিকাংশ হাসপাতাল, ক্লিনিকে

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২২ জুন ২০১৬

পূর্ণাঙ্গ জরুরী চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই অধিকাংশ হাসপাতাল, ক্লিনিকে

নিখিল মানখিন ॥ গুরুতর আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য দেশের অধিকাংশ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পূর্ণাঙ্গ জরুরী চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরুরী চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে অপঘাতের শিকার অনেককেই বাঁচানো সম্ভব। দেশে এখনও জরুরী চিকিৎসার যথেষ্ট উন্নতি না ঘটায় এ ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে। জরুরী চিকিৎসার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য জনবল দরকার। পাশাপাশি যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক হাসপাতালে স্বাভাবিক চিকিৎসার সক্ষমতা ও অবকাঠামো দিয়ে জরুরী চিকিৎসা হিসেবে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ করেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে, দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে আদেশ না মানায় স্বাস্থ্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু সচিবসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এখনও দেশে প্রতিবছর বিভিন্ন অপঘাতে ২২ লাখের বেশি মানুষ আহত বা অসুস্থ হয় এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। কেবল সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় প্রায় ১২ হাজার মানুষের। এছাড়া আহত হয় আরও চার লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে দেশে বছরে যত মৃত্যু হয়, তার ৯.৩ শতাংশের কারণ হচ্ছে অপঘাত ইনজুরি। তবে বেসরকারী হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিসিন-বিএসইএমের সংশ্লিষ্টরা জানান, কোন অপঘাতের পর যত দ্রুত সম্ভব আহতকে উপযুক্ত জরুরী চিকিৎসাসেবা দেয়া গেলে অনেক ক্ষেত্রেই তার জীবন রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু দ্রুত ও উপযুক্ত জরুরী চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে অনেক রোগীর করুণ মৃত্যু ঘটে। বছরে যে ৬০ থেকে ৭০ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে, তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেয়া গেলে তাদের অনেকেই হয়ত বেঁচে যেত। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, জরুরী চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা বলতে আগে দেশে কিছুই ছিল না। তবে বর্তমান সরকার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় এ নিয়ে কাজ করছে। ইতোমধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতালসহ দেশের আটটি হাসপাতালে অত্যাধুনিক জরুরী সেবা কার্যক্রম চলছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা সদর হাসপাতালগুলোর জরুরী বিভাগের উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জরুরী চিকিৎসার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির চেষ্টা চলছে, কিছু কিছু কাজ শুরু হয়েছে। তবে এর সুফল পেতে আরও সময় লাগবে। কারণ জরুরী চিকিৎসার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য জনবল দরকার। পাশাপাশি যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ অর্থোপেডিক্স সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ আবদুল গণি মোল্লা বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার পর দ্রুত জরুরী চিকিৎসা দেয়া গেছে বলেই অনেক গুরুতর আহত মানুষ প্রাণে বেঁচে গেছেন। আহতদের অনেকে নয়ত ঘটনাস্থলেই প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যেত। তাদের বাঁচানো কঠিন ছিল। আমাদের হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে আসার পর যেভাবে জরুরী চিকিৎসা দিয়ে থাকি, অনেক হাসপাতালেই এ সুবিধা নেই। এছাড়া দুর্ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালের দূরত্বও বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ আবদুল গণি মোল্লা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কেবল সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই যে জরুরী চিকিৎসা প্রয়োজন তা নয়, যে কোনভাবে আহত বা অসুস্থতার ক্ষেত্রেও জরুরী চিকিৎসা অত্যাবশ্যক। তাই হাসপাতালগুলোতে জরুরী চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা খুবই জরুরী। এ ক্ষেত্রে হৃদরোগের জরুরী চিকিৎসাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার। বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিসিন-বিএসইএম সূত্র জানায়, আগে হাসপাতালগুলোতে নামমাত্রই জরুরী বিভাগ ছিল। সাধারণ চিকিৎসকরাই এসব জরুরী বিভাগে কাজ করতেন। এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এখন জরুরী চিকিৎসার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। বিশেষ করে গত এক বছরে প্রায় ৪০০ নবীন চিকিৎসককে ট্রমা, কার্ডিয়াক এবং পেডিয়াট্রিক ইমার্জেন্সির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে দেশের কয়েকটি হাসপাতালে অত্যাধুনিক জরুরী বিভাগ চালু করা হয়েছে। অন্যান্য হাসপাতালেও জরুরী বিভাগ নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন অপঘাতে বছরে দেশে ২২ লাখ ১০ হাজার ৯৮০ জন আহত হয়। তাদের মধ্যে ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই ৭০ হাজারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৫.৫ শতাংশ মারা যায় পানিতে ডুবে। এর পরই ২২.৬ শতাংশ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। এছাড়া কোন না কোনভাবে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর হার ১৫.৭, আত্মহত্যা করে ১৩.৬, সহিংসতায় ৬.৬, পশুর কামড়ে ৫.৫, অগ্নিকা-ে ৩.৯, বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে ২.৮ শতাংশ এবং বাকি মৃত্যু অন্যান্য কারণে হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই অপঘাতের পর পরই হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে আসা হয় বা ঘটনাস্থলে কিংবা আনার পথে প্রয়োজনীয় প্রাক-জরুরী চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু ঘটে। জরুরী চিকিৎসা যে কেবল হাসপাতালের জরুরী বিভাগে আনার পর শুরু হবে তা নয়, দুর্ঘটনার পর থেকেই এর শিকার ব্যক্তির জরুরী চিকিৎসার সময় শুরু হওয়া দরকার। প্রাক-জরুরী সেবাটাও খুব জরুরী। বিশেষ করে এ্যাম্বুলেন্সে পর্যাপ্ত জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম থাকা অত্যাবশ্যক। এছাড়া হাসপাতালের জরুরী বিভাগে আনার পর যাতে তার সার্বিক দিকগুলো দ্রুতগতিতে দেখার মতো দক্ষতাসম্পন্ন জনবল থাকে সেই ব্যবস্থা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের অনুরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশে জরুরী চিকিৎসা সার্ভিসের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিতে শুরু করে।
×