ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন রাডার প্রতিস্থাপনে সিন্ডিকেটের বাধা

তেত্রিশ বছরের পুরনো রাডারে ঝুঁকিপূর্ণ বিমান চলাচল শাহজালালে

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২২ জুন ২০১৬

তেত্রিশ বছরের পুরনো রাডারে ঝুঁকিপূর্ণ বিমান চলাচল শাহজালালে

আজাদ সুলায়মান ॥ তেত্রিশ বছরের পুরনো রাডার দিয়ে চলছে দেশের প্রধান বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এটা এতটাই পুরনো যে, অনেক আগেই বিশ্বের অনেক দেশ তা বাতিল করে দিয়েছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরাপদ বিমান চলাচলের বিষয়টি পুরোপুরি রাডারের ওপর নির্ভরশীল হলেও সিভিল এ্যাভিয়েশন তা প্রতিস্থাপন করতে পারছে না। যখনই নতুন রাডার কেনার উদ্যোগ নেয়া হয় তখনই বাধা আসে বিভিন্ন মহল থেকে। ফলে চরম ঝুঁকিপূর্ণ রাডার দিয়ে কাজ চালানোর দরুন বিমান চলাচলের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে। প্রশ্ন উঠছে -কেন এত পুরনো রাডার দিয়ে চালানো হচ্ছে দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালাল। কেনইবা নতুন রাডার কেনার ক্ষেত্রে বার বার বাধা আসছে ভেতর ও বাইরে থেকে। সূত্র জানায়- সিভিল এ্যাভিয়েশন যখনই নতুন রাডার কেনার উদ্যোগ নিয়েছে তখনই অদৃশ্য ও অশুভ মহল তা নানা অজুহাতে নস্যাত করে দিচ্ছে। বছর বছর মেরামত করেই চালানো হচ্ছে এ রাডার। এতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এ টাকার কমিশন বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য সক্রিয় ওই সিন্ডিকেট। সিভিল এ্যাভিয়েশনের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা ওই চক্র মেরামত বাণিজ্য রক্ষার জন্য সক্রিয়। যখনই নতুন রাডার কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়, দরপত্র আহ্বান করা হয়, তখনই ওই চক্র নানা চক্রান্তে লিপ্ত হয়। সর্বশেষ যে পিপিপি দরপত্র ডাকা হয়েছে-তাও ঠেকানোর জন্য চক্রটি আদালতে মামলা ঠুকে দেয়। যদিও আদালত তা আমলে না নিয়ে খারিজ করে দিয়েছে। এতেও তারা দমেনি। এক মামলা শেষ হয় তো আরেক মামলা দায়ের করে। এমনই সব জটিলতার মুখে পড়েছে এই প্রকল্প। অথচ সিভিল এ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেছেন-আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরাপদ বিমান চলাচলের স্বার্থে আরও অনেক আগেই উচিত ছিল অত্যাধুনিক রাডার প্রতিস্থাপন করা। কিন্তু নানা জটিলতায় তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এবার আর কোন জটিলতায় বা প্রতিবন্ধকতাকেই প্রশ্রয় দেয়া হবে না। যে কোন মূল্যে নতুন রাডার কেনা হবে। দরপত্র ডাকা হয়েছে। সব কিছু স্বাভাবিক গতিতে চললে- আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে কার্যাদেশ দেয়া সম্ভব হবে। সে চেষ্টা চলছে। সূত্র জানায়, দশ বছর ধরে প্রাইমারি রাডারটি বিকল। সেকেন্ডারি দিয়ে কাজ চালানো হলেও এখন সেটাও বিকলের পথে। বছর বছর ধরে এটি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিভিল এ্যাভিয়েশনের ব্যয় হয়েছে কোট কোটি টাকা । মূলত এ মেরামত বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্যই একটি মহল অত্যাধুনিক ও নতুন রাডার বসানোর উদ্যোগ বার বার নস্যাত করে দিচ্ছে। সর্বশেষ পিপিপির আওতায় রাডার বসানোর যে দরপত্র আহব্বান করা হয়, তা খোলার তারিখ (আজ) বুধবার। কিন্তুুু তার আগেই দরপত্রে অংশ নেয়া একটি পক্ষ আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছে। ওই মামলা আদালত খারিজ করে দেয়ার পর অপর পক্ষকে দিয়ে আরও একটি মামলা ঠুকে দেয়া হয়। অবশ্য মামলায় কোন আদেশ না হওয়ায় দরপত্র খুলতে কোন বিধিনিষেধ না থাকায় আজই তা খোলা হবে। এ সম্পর্কে বর্তমান চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন-যারা মামলা দায়ের করে রাডার বসানোর দরপত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে তারা আসলে সিভিল এ্যাভিয়েশনের দুশমন। তারা দেশের শত্রু। এদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। এরা সিভিল এ্যাভিয়েশনের বিরুদ্ধে মামলাও করবে- আবার ব্যবসাও করবে তা হতে পারে না। জানা যায়- প্রাইমারি রাডারটি কাজ না করায় আপাতত জোড়াতালি দিয়ে সেকেন্ডারি রাডার দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। এতে নিরাপদ বিমান ওঠানামায় অনেক বিঘœ ঘটছে। নিরাপত্তার প্রতি হুমকিও বটে। এটিও চার বছর আগে সর্বশেষ মেরামত করা হয়। মেরামতের পর আয়ুষ্কাল থাকে কমপক্ষে ১০ বছর। কিন্তু একটি চক্র নির্ধারিত সময়ের আগেই ফের মেরামতের নামে অর্থ আত্মসাতের জন্য সক্রিয়। এ ছাড়া সেকেন্ডারি রাডার শুধু বর্তমানে একটি প্রসেসর দিয়ে চালানো হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার কারণে টানা ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টার বেশি রাডারটি কার্যকর রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় ২৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া চক্রটি এখন আবার রাডার মেরামত করার জন্য দরপত্র আহ্বানের চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে সিভিল এ্যাভিয়েশনের এক পরিচালক জনকণ্ঠকে জানান- হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এয়ার ট্রাফিক সার্ভিল্যান্স সার্ভিসের জন্য স্থাপিত সিভিল এ্যাভিয়েশনের রাডারব্যবস্থা প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি রাডার সমন্বয়ে গঠিত। ফরাসী সরকারের অনুদানে ১৯৮৪ সালে প্রাইমারি রাডার এবং ১৯৮৬ সালে সেকেন্ডারি রাডার (১০ বছর আয়ুষ্কালসম্পন্ন) স্থাপনে মোট ১৭ কোটি ৬৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ব্যয় হয়। স্থাপনের সময় এর এ্যান্টেনার ঘূর্ণন ছিল প্রতি মিনিটে ১৫ বার। যন্ত্রাংশ পুরনো হওয়ায় এটি চলমান রাখার স্বার্থে এর ঘূর্ণন সংখ্যা কমিয়ে বর্তমানে প্রতি মিনিটে সাতবার করা হয়েছে। সিভিল এ্যাভিয়েশনের রাডারের অবস্থা নিরূপণ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাডারটির অধিকাংশ খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবহার ও মেরামত অযোগ্য। বর্তমান রাডারটি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থ্যালাস বহু আগেই যন্ত্রাংশ তৈরি বন্ধ করে দিয়েছে। ১৯৮৭ সালে ৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, ১৯৯৪ সালে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও ২০০৮ সালে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রাডারের সম্পূর্ণ সিস্টেমে আপগ্রেড করা হয়েছে। এর পরও ৩০ বছরের পুরনো মডেলের রাডারটির ঘূর্ণন বাড়ানো ও প্রাইমারি অংশটি সম্পূর্ণ ব্যবহারযোগ্য করা এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। মেরামতের নামে সিভিল এ্যাভিয়েশনের একটি চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ায় প্রকল্প তৈরি করে। একটি চক্র নতুন রাডার না কেনার চেয়ে পুরনো রাডার মেরামতের জন্য আবারও দরপত্রের আয়োজন করে। ওই দরপত্রে মেরামত বাবদ ২৩ কোটি টাকা ব্যয় অফার করে একটি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, সিভিল এ্যাভিয়েশনের একটি সিন্ডিকেট ভুয়া প্রস্তাবের মাধ্যমে ‘এ্যারোনেস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে বাজারমূল্যের চেয়ে ৬ গুণ বেশি দামে ২৩ কোটি টাকার মেরামত কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য মরিয়া। কিন্তুুু বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সম্প্রতি তা বাতিল করা হয়। কারণ সিভিল এ্যাভিয়েশনের রাডার আপগ্রেডেশনবিষয়ক কমিটি বর্তমান রাডারটি পরিবর্তন করে নতুন রাডার স্থাপনের পক্ষে মত দেয়ায় মেরামতবাণিজ্য ভেস্তে যাবার উপক্রম হয়েছে। এ ছাড়া পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী কোন নতুন যন্ত্রাংশ অবশ্যই বাজার যাচাই এবং সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে কেনার বিধান রয়েছে। কিন্তু সিএএবির চক্রটি সেই বিধান না মেনে মেসার্স এ্যারোনেস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে থ্যালাসের স্থানীয় প্রতিনিধি দেখিয়ে কাজটি দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে। এ সম্পর্কে সিভিল এ্যাভিয়েশনের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন-বর্তমান সেকেন্ডারি রাডার দিয়ে দুইশ’ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এখন নির্ভর করতে হয় উড়োজাহাজের ট্রান্সফন্ডারের ওপর। যদি সেটা নষ্ট থাকে তাহলে তো সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা থাকে। যদি প্রাইমারি রাডার ঠিক থাকত তাহলে ট্রান্সফন্ডারের ওপর নির্ভর করতে হতো না। জানতে চাইলে এয়ারমার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী বলেন, নতুন রাডার বসানো হলেও পুরনো রাডারটি ব্যাকআপ হিসেবে রাখা হবে। সে জন্যই এটা ঠিক করা হবে। এ জন্য দরপত্র আহ্বান করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্বচ্ছতা বজায় রেখে উন্মুক্ত দরপত্র ডাকা হবে, যাতে কেউ কোন ফায়দা নিতে না পারে।
×