ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উলফার মাধ্যমেই এসেছিল বলে অনেকটাই নিশ্চিত

উত্তরার অস্ত্রের উৎস খুঁজতে গভীর তদন্ত শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২২ জুন ২০১৬

উত্তরার অস্ত্রের উৎস খুঁজতে গভীর তদন্ত শুরু

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ি খাল থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র গোলাবারুদের বিশাল চালানটি কোথা থেকে কিভাবে এসেছে তার গভীর তদন্ত শুরু হয়েছে। চালানটির অর্থায়নের সঙ্গে জড়িতদের খোঁজা হচ্ছে। দেশী ও আন্তর্জাতিক কোন্ কোন্ চক্র এর সঙ্গে জড়িত তা জানতে রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে তদন্তকারীদের। ইতোমধ্যেই প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ সদস্যসহ আশপাশে থাকা কয়েকজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের বর্ণনা মোতাবেক কালো বিলাসবহুল পাজেরো গাড়ি ও অস্ত্রের ব্যাগ যারা ফেলে দিয়েছে, তাদের খোঁজা হচ্ছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটকে তদন্তে সহায়তা করতে পুলিশের একজন উপকমিশনারের নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত সহায়ক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। গত ১৮ ও ১৯ জুন রাজধানী ঢাকার তুরাগ থানাধীন উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরে মিরপুর আশুলিয়া বেড়িবাঁধ সংলগ্ন দিয়াবাড়ি খালে দুদিনব্যাপী পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের অভিযানে পানিতে ডুবে থাকা সাতটি ট্রাভেল ব্যাগ থেকে সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের ৯৫টি ও ২টি দেশীয় পিস্তল, সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোবের ১৯২টি ম্যাগজিন, ১০টি ম্যাগজিন গ্লোক পিস্তল, ২৯৫টি এসএমজির (সাব মেশিন গান), ১০টি বেয়োনেট, ১০৪টি ছোট সিলিন্ডার আকারের বুলেট তৈরির বাক্স, নাইন এমএম (নয় মিলিমিটার) পিস্তলের ৮৪০টি তাজা বুলেট, চীনের তৈরি সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের ২১৭টি তাজা বুলেট ও অস্ত্র পরিষ্কার করার ১০৮টি ক্লিনিং রড উদ্ধার হয়। অস্ত্র গোলাবারুদের চালানের সঙ্গে কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় এবং কোন দাবিদার না থাকায় এ সংক্রান্ত তুরাগ থানায় ২টি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। ডায়েরি দুটির তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অস্ত্র উদ্ধার টিম। তদন্তে সহায়তা করতে ডিবির উত্তর বিভাগের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলমকে প্রধান করে এবং পাঁচজন অতিরিক্ত উপকমিশনারের সমন্বয়ে একটি তদন্ত সহায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি প্রধান জানান, সার্বিক বিষয় গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার সময় একজন পুলিশ সদস্য স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঘটনাস্থলের খানিক দূর থাকা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি নম্বরপ্লেটবিহীন একটি কালো বিলাসবহুল পাজেরো গাড়ি থেকে ৪/৫ জনকে দ্রুত ব্যাগ ফেলতে দেখেন। ব্যাগে লাশ ফেলা হচ্ছে বলে ওই পুলিশ সদস্যের সন্দেহ হয়। তিনি বিষয়টি তুরাগ থানা পুলিশকে জানান। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস অভিযান চালিয়ে বিশাল অস্ত্র গোলাবারুদের চালান উদ্ধার করে। ইতোমধ্যেই তদন্তকারীরা ওই পুলিশ সদস্যের বক্তব্য নিয়েছে। ওই পুলিশ সদস্য যারা অস্ত্রের ব্যাগ ফেলেছেন, দূর থেকে দেখা তাদের চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন। গাড়িটি ছাড়াও ঘটনার সময় আশপাশের পরিবেশেরও বর্ণনা দিয়েছেন। এছাড়া ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা যে কয়জনের জবানবন্দী নেয়া হয়েছে, তাদের কাছ থেকেও ঘটনা সম্পর্কে প্রায় একই ধরনের বর্ণনা এসেছে। গাড়িটি সোজা রাস্তা ধরে উত্তরার দিক থেকে এসেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা প্রকাশ পেয়েছে। সন্ধ্যার সময় ওই এলাকায় কড়া চেকিং হয়। কিন্তু দিনের বেলায় তেমন চেক হয় না। কারণ অনেকেই নিজের প্লট দেখতে, ঘুরতে, বেড়াতে সেখানে গিয়ে থাকেন। এমন সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়ে অস্ত্র গোলাবারুদের চালানটি সেখানে রেখে যায়। তদন্তকারী সংস্থার একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, যেখানে অস্ত্র গোলাবারুদের চালানটি রেখে যাওয়া হয়েছিল তার সঙ্গেই মিরপুর বেড়িবাঁধ সড়ক। ধারণা করা হচ্ছে, অস্ত্রের চালানটি হস্তান্তরের উদ্দেশ্যেই সেখানে রেখে গেছে। যারা চালানটি গ্রহণ করবে, তারা সহজেই যাতে খালে মাছ ধরার ছল করে বা অন্যকোন কাজের ছলে ব্যাগুগুলো তুলে রাতের আঁধারে সরিয়ে নিতে পারে। সন্ধ্যার পরেই এলাকাটি একেবারেই নির্জন হয়ে পড়ে। রাস্তায় যানাবাহনের যাতায়াতও কমে যায়। এমন পরিবেশ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেই চালানটি সুবিধাজনক জায়গায় রেখে গেছে। এই কর্মকর্তা বলছেন, অস্ত্রের চালানটি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার (ইউনাইটেড ফ্রন্ট অব অসম) বলে অনেকটাই নিশ্চিত। উলফার সঙ্গে আগাগোড়াই বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠনগুলোর যোগাযোগ রয়েছে। উলফার একজন শীর্ষ নেতার বিশ্বস্ত দুজন দেহরক্ষী রয়েছে, যারা বাংলাদেশের একটি নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের সদস্য। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশে বিদেশী কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে অভিযান চলছে। সেই অভিযানে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদেশী সংগঠনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাঁটি আবিষ্কৃত হয় উলফার। সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের অনেককেই অভিযানের মুখে পালিয়ে যেতে হয়। অনেকে পালানোর সময় ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়ে। আবার অনেককে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে পুশব্যাক ও হস্তান্তর করা হয়। এ কারণে বাংলাদেশে উলফার ঘাঁটি ও নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে পড়ে। এজন্য আওয়ামী লীগের উপর ক্ষিপ্ত উলফা। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তারা সরকার বিরোধীদের সঙ্গে জোট বেঁধে অস্ত্রের চালানটি দেয়ার প্রক্রিয়া করে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সোমবার ডিএমপি কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে দেশে ভয়াবহ নাশকতা চালিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই বিএনপি-জামায়াত-শিবির-জঙ্গী গোষ্ঠী অস্ত্র গোলাবারুদের বিশাল চালানটি এনেছিল বলে ইঙ্গিত দেন। বলেন, এরসঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত। চক্র দু’টি ২০১৩ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মরিয়া হয়ে আছে। দেশী ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে অস্ত্রের চালানটির যোগান এসেছে। ইতোপূর্বে ধরা পড়া অস্ত্র গোলাবারুদগুলো কোন দেশের তৈরি তা লেখা ছিল। এবারের চালানে সবই আছে, শুধু যে দেশ অস্ত্র গোলাবারুদ তৈরি করেছে সেই দেশের নাম নেই। এ থেকে অস্ত্র গোলাবারুদের চালানটির সঙ্গে দেশী ও আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত থাকার বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
×