ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

অভিমত ॥ সুশিক্ষা নিশ্চিত করবে কে?

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২২ জুন ২০১৬

অভিমত ॥ সুশিক্ষা নিশ্চিত করবে কে?

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ক্যাম্পাসে ‘চোখে আঙুল দাদা’ নামক একটি মঞ্চ নাটক দেখেছিলাম। বাস্তবধর্মী ওই নাটকের কাহিনী ছিল মোটামুটি এ রকম : সমাজপতিরা সমাজের নানা অসঙ্গতি ও সমস্যা দেখেও না দেখার ভান করেন। এ অবস্থা যখন চলতেই থাকে এবং ওইসব অসঙ্গতি ও সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে সমাজপতিরা যখন কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেন না, তখন ভুক্তভোগীরা শেষ পর্যন্ত সমাজপতিদের চোখে সরাসরি আঙুল দিয়ে ওইসব অসঙ্গতি ও সমস্যা দেখিয়ে দিতে বাধ্য হন। এ নাটক দেখার আগে কলেজে পড়ার সময় একবার এক চিত্রশিল্পীর চিত্রপ্রদর্শনী দেখেছিলাম। ওখানে একটি চিত্রে দেখানো হয়েছিল : মশা তাড়ানোর জ্বলন্ত কয়েলের ওপর জীবন্ত একটি মশা স্থির হয়ে বসে আছে। আর ওই চিত্রের ক্যাপশনে লেখা রয়েছে ‘প্রশাসন’। ‘চোখে আঙুল দাদা’ নামক নাটকটির মাধ্যমে সমাজের নানা অসঙ্গতি ও সমস্যা এবং ‘প্রশাসন’ নামক ওই চিত্রের মাধ্যমে দেশের প্রশাসনের বাস্তব অবস্থা সেসময় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। ঠিক একইভাবে সম্প্রতি মাছরাঙা টেলিভিশনে জিপিএ-৫ নিয়ে সম্প্রচারিত একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ধরন, শিক্ষার প্রকৃত হাল, শিক্ষার মান এবং শিক্ষার দৈন্যদশার বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনটিতে দেখানো হয়, এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকার একাধিক স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল জিপিএ-৫ কি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম কি, স্বাধীনতা দিবস কবে, বিজয় দিবস কবে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও জাতীয় স্মৃতিসৌধ কোথায় অবস্থিত ইত্যাদি। তবে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক ‘মেধাবী’ শিক্ষার্থী। যদিও এসব প্রশ্ন শিক্ষার মানদ- নিরূপণের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ মাপকাঠি নয়, তথাপিও দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে এসব সাধারণ বিষয় কি জানা উচিত নয়? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মতো দেশের জিপিএ-৫ পাওয়া সব শিক্ষার্থীরই এমন অবস্থা তা কিন্তু নয়। কারণ দেশে নতুন প্রজন্মের মধ্যে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আছেন, যারা অনেকেই অনেক বিষয়ে অনেক বেশি জানেন, বোঝেন এবং জ্ঞান রাখেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, দেশের শিক্ষার এই হালের জন্য দায়ী কি শুধুমাত্র প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা জিপিএ-৫ পাওয়া ওইসব শিক্ষার্থী? নাকি আমাদের দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা, বিদ্যাপীঠ, পরিবার এবং পরিবেশও এর পেছনে দায়ী? এদেশে অনেক আগে থেকেই শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ ছিল এবং জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা সত্যিকার অর্থেই মেধাবী কি-না তা প্রশ্ন আকারে দেখা দিয়েছে বারবার। মাছরাঙা টেলিভিশনের সংশ্লিষ্ট এ প্রতিবেদনটি যেন সেই প্রশ্নগুলো আবারও সামনে নিয়ে এসেছে (যদিও সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মান-সম্মান বিবেচনাপূর্বক এবং সাংবাদিকতা নীতিমালা অনুযায়ী ওইসব শিক্ষার্থীর চেহারা বা মুখম-ল সম্পূর্ণ প্রকাশ না করে অন্যভাবে প্রকাশ করা যেত)। লক্ষ্য করলে মনে হবে, দেশে প্রতি বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে শিক্ষার আদৌ মান বাড়ছে কি? এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের ওপর কখনও এই পদ্ধতি, কখনও ওই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে- যেন শিক্ষার্থীরা ল্যাবরেটরির গিনিপিগের মতো। এর পাশাপাশি শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাস নেয়ার বেলায় কতটুকু যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ ও কতটুকু আন্তরিক এবং শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা (বিশেষ করে বোর্ড পরীক্ষার খাতা) মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কতটুকু স্বাধীন কিংবা আদৌ স্বাধীন কি-না- সে বিষয়গুলোও ভালভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। শিক্ষকদের ওপর মহল থেকে যদি এই মর্মে নির্দেশনা দেয়া থাকে যে, ‘পরীক্ষার্থী খাতায় লিখুক আর নাই লিখুক, কিংবা ‘ক’-এর জায়গায় ‘ব’ লিখুক তাকে নম্বর দিয়ে পাস করিয়ে দিতে হবে’। তখন বেচারা শিক্ষক পেটের দায়ে ও চাকরি রক্ষার্থে ওই ধরনের পরীক্ষার্থীকে নম্বর দিতে বাধ্য থাকবেন। কিন্তু এর ফলে শিক্ষার কী ধরনের দুর্দশা হবে বা হতে পারে-তা কী ভেবে দেখা উচিত নয়? তাছাড়া দেশের বিভিন্ন বিদ্যাপীঠগুলোতে (বিশ্ববিদ্যালয়সহ) শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার চেয়ে যদি রাজনৈতিক পরিচয়, লবিং-গ্রুপিং, তদবির, স্বজনপ্রীতি আর ঘুষের বিষয় প্রাধান্য পায়, তবে ওই বিদ্যালয়গুলোর বিদ্যা ‘লয়’ (ধ্বংস) হতে বেশি সময় নেবে না। বলাবাহুল্য, অনেক আগে থেকেই এ দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থায় ত্রুটি রয়ে গেছে এবং এখনও আছে। এসব ত্রুটি দূর করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, শিক্ষাবিদ, পরিবার, বিদ্যাপীঠ, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ সমাজের সকলের একযোগে আন্তরিকভাবে দ্রুত এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তবে তার আগে অভিভাবকদের সজাগ হয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও নানা বিষয়ে জানার সুযোগ করে দিতে হবে। যেমন : কেউ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র বলেই যে সে বিজ্ঞানের বিষয়সমূহ ছাড়া অন্যান্য বিষয় বা সাধারণ জ্ঞান সম্পর্কে জানবে না বা পড়বে না- এমনটি যেন না হয়। এজন্য এক বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া ঘটানো অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সিলেবাসে ‘বাংলাদেশ বিষয়ক সাধারণ জ্ঞান’ নামক একটি বিষয় যুক্ত করলে সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা অনেক জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করা যায়। তবে সুশিক্ষা ও সুশিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাঁদের অভিভাবক, শিক্ষক, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে একযোগে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। [email protected]
×