ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

শেখ হাসিনার নিরাপত্তা জাতিরও নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২১ জুন ২০১৬

শেখ হাসিনার নিরাপত্তা জাতিরও নিরাপত্তা

শেখ হাসিনা শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি ঢাল হয়ে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-চেতনা, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মীয় জঙ্গী-জেহাদীমুক্ত বাংলাদেশ বিশ্বাসী মানুষের। সেই নির্ভরতার জায়গাকে বারবার বিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশবাসী জানে তাঁকে একাধিকবার হত্যাচেষ্টার কথা। এবারেও কি বিমানবন্দরে তাঁর হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল কিনা সে প্রশ্ন মিলিয়ে যায়নি। প্রসঙ্গটি অবশ্যই আলোচনার দাবি করে। ভয়ঙ্কর গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতার আসলাম চৌধুরী রিমান্ডে যেসব তথ্য দিয়েছেন এর মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সরকার উৎখাতে বিএনপি-জামায়াতপন্থী কিছু রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি সম্পৃক্ত তা নয়, এ ষড়যন্ত্রে সরকারের মধ্যে ঘাপটিমেরে আছে কিছু ছদ্মবেশী। পাঠক, এখন কি বর্তমান সময়টিকে ’৭৫- এর জুলাই, আগস্টের মতো তুলনীয় মনে হচ্ছে না? প্রধানমন্ত্রীর বিমান অবতরণের আগে বিমানবন্দর থেকে ধাতববস্তু পড়ে থাকা অবস্থায় ১২টি দেশী-বিদেশী ফ্লাইট অবতরণ ও উড্ডয়ন করেছে। যদিও সৌভাগ্যবশত এর কোনটি দুর্ঘটনায় পড়েনি। ২০০০ সালে প্যারিসের দ্য গল বিমানবন্দরে এরকম এয়ার ফ্রান্সের কনকর্ড বিমান উড্ডয়নের সময় রানওয়েতে আগের বিমানের ফ্যানের ভাঙ্গা অংশ লেগে আরেকটি বিমানের চাকা পাংচার হয়ে সেটি এমন এক দুর্ঘটনায় পড়ে যার ফলে ১১৩ যাত্রী মৃত্যুবরণ করে। এখানে একটু পার্থক্য সম্ভবত আছে। ফ্রান্সের প্যারিসের রানওয়ের মাঝখানে ঐ ধাতববস্তুগুলো ছড়ানো ছিল, যা পরক্ষণেই রওনা হওয়া প্লেনটির জন্য নিরাপত্তা চেক সম্ভব হয়নি। ঢাকার বিমানবন্দরের ধাতববস্তুগুলো রানওয়ের দু’পাশে ছড়িয়ে ছিল। সম্ভবত এ কারণে কিনা জানি না পরপর ১২টি ফ্লাইটে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়নি। কিন্তু দুর্ঘটনার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল, যেটি উড়িয়ে দেয়া অনুচিত হবে। কেননা, পাখির ডানায় লেগেও বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমান নামার আগে যে ব্যক্তি রানওয়ের নিরাপত্তা চেক করার দায়িত্বে ছিলেন তাকে নাকি ঐ সময় ইফতার কিনতে বিমানবন্দরের বাইরে পাঠানো হয়েছিল, যা একটি খোঁড়া যুক্তি বলেই প্রতীয়মান হয়। এ ঘটনাটিকে যদি সরকার উৎখাত ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করা হয়, তা কি খুব অযৌক্তিক হবে? বর্তমানে কোথায় শকুনের দল বসে বসে দেশের নিরীহ সংখ্যালঘু- হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, আদিবাসী, অসাম্প্রদায়িক মুসলিম শিক্ষক, পরোপকারী লালনভক্ত ব্যক্তি, নাট্যকর্মী তনু, তরুণ যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্কদের হত্যা করছে- তাদেরই একটি অংশ সাহসী পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর প্রাণ নিয়েছে। তাদের একটি গোষ্ঠী রানওয়ের ষড়যন্ত্রে ছিল কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু’ হিন্দুসহ সবার ওপর নির্যাতনের ফলে নেদারল্যান্ডসের এমপি এসব অনাচার বন্ধের লক্ষ্যে সব দলের একটি সংলাপ শুরু দরকার বলে আহ্বান করেছেন, যার পরপরই দেখা গেল বিএনপি নেত্রী বড় গলায় ঘোষণা করল, দেশে এসব ঘটমান সংখ্যালঘু খুন আওয়ামী লীগই করেছে। যেমন দাবি খালেদা জিয়া ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার পর এবং ২০১৪ সালে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যার পরও করেছিল। খালেদা জিয়ার ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত শাসনামলে তাদের জঙ্গী, পুলিশ এবং দলীয় ক্যাডারের হাতে বিশ হাজারের বেশি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী খুন হয়েছিল। দু’লাখ হিন্দু দেশত্যাগে বাধ্য হয়, অনেকেই খুন, ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। খালেদা জিয়ার এসব খুন, নির্যাতনের কথা মনেও নেই। ’৭১-এর ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যা তার কাছে অসত্য বলে মনে হয়, তার জন্মতারিখ কি ছিল তা মনে রাখার দরকার না থাকায় কূটকৌশলের মাধ্যমে রক্তঝরা কলঙ্কিত ১৫ আগস্টকে নিজের জন্মদিনের উৎসব করে জাতির জনককে বিদ্রƒপ করতে ভুল হয়নি তার। সম্ভবত মোসাদ-আইএসআই-এর সাহায্যে বিএনপি-জামায়াতের যৌথ ষড়যন্ত্রে সরকার উৎখাতের খবর জানাজানি হওয়ার পর সংখ্যালঘু, ব্লগার ও অসাম্প্রদায়িক শিল্প-সাহিত্যপ্রেমী মানুষ হত্যা করে বহির্বিশ্বে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা এবং সমাজে একটি অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে সরকারকে শীঘ্রই নির্বাচন দেয়ার চাপে ফেলার কাজটি চালিয়ে যেতে চায় তারা। এটা সবার জানা যে, ক্লিনটন-হিলারি ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ড. ইউনূস যে কোন কারণেই হোক, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক করতে উৎসাহী হিসেবে দেখা গেছে এবং আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাবিরোধী হয়ে উঠেছেন। সেটি তাকে এতদূর টেনে এনেছে যে, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ স্থগিত চেয়ে বারবার ক্লিনটনদের সাহায্য নিতে হয়েছে। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সরকার নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শোনা যায়, খালেদা তাকে প্রেসিডেন্ট পদ দিতে চেয়েছিল, তিনি গ্রহণ করেননি। এখন আমেরিকার জনগণ ফ্যাসিবাদী ট্রাম্পের চাইতে হিলারিকেই গ্রহণ করবে- এটাই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই হিসাবগুলোর ফলে খালেদা-তারেক-জামায়াত উজ্জীবিত হয়েছে বলে মনে হয়। তবে, বাস্তবক্ষেত্রের রাজনৈতিক চালগুলো চালতে গিয়ে রাজনীতিকরা পুরনো হিসাব অনুযায়ী পুরনো চাল চালতে পারেন নাÑ এটি একটি চিরকালীন সত্য। নতুবা মোদি সরকার শেখ হাসিনা সরকারকে এতটা আস্থায় নেয়ার কথা ছিল না, যা তিনি নিয়েছেন। যা হোক, মুক্তিযুদ্ধপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ উদার অসাম্প্রদায়িক বাঙালীই যে আওয়ামী লীগের পরম ও প্রধান মিত্র, তা শেখ হাসিনা জানেন। তাই তাকে এই শক্তিকে রক্ষার্থে কতগুলো কাজ দ্রুত করতে হবে- প্রথমত, তিনি আপাতত বিদেশে যাবেন না, প্রয়োজনে প্রতিনিধি পাঠাবেন। তাঁর প্রাণের সঙ্গে জড়িত কোটি কোটি প্রাণ। দেশে বহুদেশীয় কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে আওতায় আনা, শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বিদেশী কোম্পানির মালিকেরা হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতি বছর তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। করের সø্যাব বাড়াতে হবে, বাসা ভাড়া দিয়ে মাসিক চল্লিশ, পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতন না পেলে পেশাজীবীরা শীঘ্রই নিম্ন আয়ের শ্রেণীতে নেমে যাবে। এভাবে মধ্যম আয়ের দেশ হবে না। সরকারী, বেসরকারী পেনশনভোগীরা কিভাবে বাঁচবে? তাদের জন্য একটা স্কিম না থাকলে বর্তমান পণ্যমূল্যে তাদের সংসার চলছে না। দেশকে নবায়ণযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুত তৈরির দিকে নিয়ে যান, বাদ দেন পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লা। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভারতের সঙ্গে যুক্ত নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা লাভের ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে কূটনীতি সফল না হলে আন্তর্জাতিক আদালতে দাবি উত্থাপনের ব্যবস্থা করুন। জঙ্গী-জেহাদীদের অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি আইন জরুরী, তাদের জন্য দ্রুত ট্রাইব্যুনালে বিচার এবং ধর্ষকদের জন্য মৃত্যুদ-ের দাবি জানাই। কিছু জঙ্গী ধরতে হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেফতার করে যে পুলিশ তারা কি প্রকৃত জঙ্গী ধরতে পারবে? আমরা জানি, পুলিশ চাইলে বিগত যত ব্লগার, মুক্ত চিন্তার মানুষ, সংখ্যালঘু খুন হয়েছে তাদের প্রকৃত খুনীকে ধরতে সক্ষম। আগেও বলেছিলাম, সেই সাংসদকে পুরস্কৃত করুন যার এলাকায় কোন সংখ্যালঘুর জমি দখল হয়নি, নির্যাতন-ধর্ষণ হয়নি। আর সেই সাংসদকে শাস্তি দিন, যার এলাকায় যার ছত্রছায়ায় সংখ্যালঘু খুন হচ্ছে, বাড়িঘর, জমি হারাচ্ছে, নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছে। শ্রীমঙ্গলের খাসিয়াদের পানপুঞ্জি তাদের হাতেই ছেড়ে দিন। তারাই প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রকৃতিপ্রেমী, প্রকৃতি পূজারীরাই পৃথিবীর প্রকৃতিকে সুরক্ষা দেয়, অন্যেরা ধ্বংস করে। একটি প্রশ্ন করছি সংশ্লিষ্টদের- এই যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির জন্য একটি ম্যালওয়্যার বসানো হলো, আমাদের দেশে কি এসব ম্যালওয়্যারকে প্রতিরোধকারী অটোমেটেড কোন যন্ত্র, কোন প্রযুক্তি কি কেউ তৈরি করতে জানেন না? অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক ডিলিং সেকশনে বসে উপযুক্ত জ্ঞান, দক্ষতা ও দেশপ্রেম নিয়ে নিয়োজিত হওয়ার মতো যোগ্য কোন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ কি দেশে নেই? থাকলে সরকারকে তাদের নামের তালিকা দিন। অর্থমন্ত্রীকে আমার অনুরোধ, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণ নিরাপত্তা দিন। সুইফ্ট যেসব মন্দ কাজ করেছে, সেসব দ্রুত অকার্যকর করা হয়েছে তো? ফায়ারওয়ালের কথা শুনেছি, তা কি ইনস্টল করা হয়েছে? সরকার ও জাতিকে আপনাদের মেধা দিয়ে সাহায্য করুন।
×