ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম হাসান

বাবার ভালবাসা

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২০ জুন ২০১৬

বাবার ভালবাসা

কাটে না সময় যখন আর কিছুতে, বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না... মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়... এই গানের সুর যখন কানে এসে লাগে এমন কোন সন্তান নেই যার বাবার কথা এবং এমন কোন বাবা নেই যার সন্তানের কথা মনে না পড়ে। মনে হয় অতীতের গহব্বর থেকে কথাগুলো মধুরতম সুর হয়ে হৃদয়ে পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়। গানটি কি শুধুই সুরের জন্য ভাললাগে? না। কারণ এই সুরের মধ্যে যে মিশে একটি অকৃত্রিম ভালবাসা। সুরকে হৃদয় স্পর্শী করা এই ভালবাসার নাম বাবার প্রতি ভালবাসা। যখন কোন মানবশিশুর জন্ম হয় তখন শুধু একজন শিশুরই জন্ম হয় না। জন্ম হয় একজন মা, একজন বাবার এবং আরও অনেক সম্পর্কের। আর সঙ্গে সঙ্গে জন্ম হয় একটা ভালবাসার। এই ভালবাসার তীব্রতা এত বেশি যে, যে বাবা হয়েছে সেই জানে। সদ্য জন্ম নেয়া সন্তান বুকে নিয়ে বাবার যে সুখ তা তো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আসলে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম জিনিস, সবচেয়ে ভাললাগার জিনিস ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। শুধু হৃদয় দিয়ে তা উপলব্ধি করতে হয়। সন্তানকোলে বাবার ভালবাসাও তেমনি। হয়ত বেহেশতি সুখের ধরন এই রকমই হয়। একজন বাবা তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একজন সুখী মানুষ। আমরা সবাই বাবা হওয়ার পর বুঝতে পারি সন্তানের প্রতি আমাদের বাবা-মায়ের ভালবাসার তীব্রতা। জন্মের পর থেকেই শুধু তাদের ভালবাসা পেয়ে এসেছি। বিনিময়ে তারা কখনোই কিছু চায়নি। একমুখী ভালবাসা। শুধু দিয়েই গেছে। যা কিছু চেয়েছে তার সবই আমাদের স্বার্থে, আমাদের মঙ্গলের জন্য। তাদের ভালবাসার সবটুকু নিংড়ে, শেষ টুকু দিয়ে আমাদের বড় করতে চেয়েছে। সন্তান যা কিছু হয় তা বাবা-মায়েরই অবদান। তাদের শ্রমে-ভালবাসায় গড়া। যে বাবা আমাদের জন্য এতকিছু করেন তার প্রতি আমরা কত টুকু দায়িত্ব পালন করি। আসলে আমরা নিজেরা বাবা হয়ে বাবাকে ভুলে যাই। বোধ হয় ভালবাসার গতি নিম্নমুখী। তাই হয়ত নিম্নমুখী স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে বাবাকে ভুলে যাই। ব্যতিব্যস্ত থাকি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। অথবা তাদের জন্য যা কিছু করি, কখনোই কি জানার চেষ্টা করেছি এতে তারা খুশি কিনা? ঊাবা-মায়ের প্রতি ভালবাসার জন্য, দায়িত্ব পালনের জন্য কোরআন হাদিসসহ পৃথিবীর সব ধর্মেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (স) জীবনে কারো ক্ষতি চাননি। সারা জীবন উম্মতের ভাল চিন্তা করেছেন। এমনকি রোজ হাসরের ময়দানে মহা বিপদের সময়ে অন্যান্য সকল নবী-রাসুল যখন উম্মতের চিন্তা বাদ দিয়ে নিজ নিজ চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তখনো আমাদের প্রিয় নবী ইয়া উম্মতি, ইয়া উম্মতি বলে চিৎকার করতে থাকবেন। সেই উম্মত প্রাণ নবী (স) ও এক ধরনের উম্মতের ধ্বংস কামনা করেছেন। তারা হলো, যারা জীবদ্দশায় বাবা-মা পেয়েও তাদের খেদমত করে নিজেদের গুনাহ মাফ করাতে পারল না-তারা। ঊাবা-মার জন্য কিছু করা শুধু দায়িত্ব পালন নয়, একধরনের ইবাদতও বটে। ছোট্ট বেলায় যেমন বাবার সঙ্গে গল্প করার জন্য আপনি ব্যাকুল থাকতেন। বাবা ছিল আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এখন আপনার বৃদ্ধ বাবা ব্যাকুল হয়ে থাকেন আপনার সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য, একটু সঙ্গ পাওয়ার জন্য। অথচ সকলের জন্য সারা দিনের ব্যস্ত আপনার বাবাকে দেয়ার মতো একটু সময় হয় না। আপনি এখন ঠিক সেভাবেই বৃদ্ধ বাবাকে সঙ্গ দেয়ার চেষ্টা করুন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে শেয়ার করুন। বুঝানোর চেষ্টা করুন আপনি এখনও তার জন্য ব্যাকুল। অফিসে যাওয়ার সময় এবং অফিস হতে ফিরেই তার খোঁজ নিন। এক সাথে চা পান করুন। প্রয়োজনে যদি বাবা-মার সঙ্গে একসঙ্গে নাও থাকতে পারেন তবে নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নিন, টেলিফোনে কথা বলুন যাতে তারা নিঃসঙ্গ মনে না করেন। বাবার সঙ্গে পুরাতন স্মৃতিচারণ করুন। দেখবেন তার পুরাতন স্মৃতি কিন্তু আপনাকে ঘিরেই। এতে আপনারও ভাল লাগবে। বাবাকে নিয়মিত পকেট মানি দিন। দান-খয়রাত করতে চাইলে সহযোগিতা করুন। সময় পেলে আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়াতে নিয়ে যান। বিশেষ করে তার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে, পুরাতন আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিন। পারিবারিক কোন বিষয়ে তার পরামর্শ গ্রহণ করুন। তাকে বোঝান যে আপনি এখনও বাবাকে ছাড়া কিছু করেন না। একজন সন্তানের কাছে বাবা হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। ব্যক্তি জীবনে মানুষ খারাপ হতে পারে, নিকৃষ্ট হতে পারে, কিন্তু সন্তানের কাছে সব বাবাই ভাল। আমরা শিশুকালে হামাগুড়ি থেকে প্রথম উঠে দাঁড়াই যে হাত ধরে তা বাবার হাত। হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলতে শিখি বাবার হাত ধরে। প্রথম যে কথা বলি তা বাবা-মার ভাষায় কথা বলি। এভাবে সব শুরুই হয় বাবাকে দিয়ে। বাবা হয়ে উঠে একজন সন্তানের আদর্শ মানুষ। কিন্তু শৈশব থেকে যখন যৌবনে পা রাখি তখন অনেকেই ভুলে যাই বাবার অবদানের কথা। ভুলে যাই আমাদের জীবনে কারিগর তো আমাদের বাবাই। বাবার উপদেশ বা আদেশ ভাল লাগে না। কালক্রমে বাবাকে অবহেলা করতে শুরু করি। অনেক পাওয়ার ভিড়ে বাবাকে পাওয়ার প্রয়োজন মনে করি না, কোন কিছুতে তার আর গুরুত্ব অনুভব করি না। এইভাবে চলতে, চলতে, অনাদরে অবহেলায় কবে যে বাবা নেই হয়ে যান টেরই পেলাম না। বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। যখন বুঝতে পারলাম তখন আর কিছুই করার নেই। বুকের ভেতরটা খালি খালি লাগে। বুকের গহীন থেকে তপ্ত হাহাকার বেরিয়ে আসে। অনেক ভুল হয়ে গেছে। বাবা যদি আবার ফেরত আসত, তাহলে সব করতাম। জন্মের পর প্রথম যেভাবে হাত ধরেছিলাম সেই হাত আর কখনই ছাড়তাম না। কিন্তু কালের আবর্তে একবার যে যায় সে কি আর ফেরত আসে? আসে না, থাকে শুধু দীর্ঘশ্বাস। যাদের বাবা জীবিত আছেন আশা করি তারা আর এই ভুল করবেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন না। হাহাকারে দগ্ধ হবেন না। সময় থাকতে বাবা-মায়ের খেদমত করুন, তাদের জীবনকে আনন্দময় করে তুলুন এবং নবীজীর (স) অভিশাপমুক্ত হউন। মডেল : সনি ও বাপ্পী
×