ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আরও ৩২ ম্যাগজিন উদ্ধার ॥ বসেছে চেকপোস্ট, চলছে তল্লাশি

উত্তরায় এত বিপুল অস্ত্র উদ্ধারে ঢাকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২০ জুন ২০১৬

উত্তরায় এত বিপুল অস্ত্র উদ্ধারে ঢাকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রবিবারও রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি খাল থেকে এসএমজির আরও ৩২ ম্যাগজিন উদ্ধার হয়েছে। খালের পানির নিচে ডুবে থাকা একটি কার্টন থেকে ম্যাগাজিনগুলো উদ্ধার হয়। দ্বিতীয় দিনেও অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় চাঞ্চল্য আরও বেড়ে গেছে। উদ্ধার হওয়া এত বিপুল অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিপুল অস্ত্রের আরও এক বা একাধিক চালান ঢাকায় প্রবেশ করেছে কিনা সে বিষয়ে রীতিমতো শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। এমন ঘটনায় ঢাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উদ্ধারকৃত বিপুল অস্ত্র কিভাবে ঢাকায় প্রবেশে করেছে এবং এর নেপথ্য কারিগরদের শনাক্ত করতে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে কোন জঙ্গী গোষ্ঠী বা দেশী বা আন্তর্জাতিক কোন চক্র অস্ত্রগুলো আনতে পারে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। আশপাশের ঝোপঝাড়ে বা খালের পানিতে এভাবে আরও অস্ত্র ফেলে রাখা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। উদ্ধারকৃত ম্যাগাজিনগুলো যেসব অস্ত্রে ব্যবহৃত হয়, সেসব অস্ত্র ঢাকা বা তার আশপাশের কোন এলাকায় প্রবেশ করেছে কিনা বা প্রবেশের অপেক্ষার রয়েছে কিনা তা নিয়েও রীতিমতো শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে ঘটনাস্থলের আশপাশে অনুসন্ধানের পাশাপাশি ঢাকায় প্রবেশের রাস্তাগুলোতে বাড়তি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চলছে। শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে রাজধানীর তুরাগ থানাধীন উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের শেষপ্রান্তে মিরপুর আশুলিয়া বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বৌদ্ধ মন্দিরের কাছে দিয়াবাড়ি খালের ঝোপঝাড় ও পানির মধ্য থেকে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৮টি ব্যাগ উদ্ধার করে। ব্যাগে ১০৪টি বক্স ছিল। সেই বক্সের ভেতর থেকেই একে একে উদ্ধার হয় বিপুল অস্ত্রগোলাবারুদ। উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদের মধ্যে চীনের তৈরি সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের ৯৫ পিস্তল রয়েছে। এসব পিস্তলের ২২০ রাউন্ড তাজা বুলেট উদ্ধার হয়। আর পিস্তলগুলোর ১৮৯টি ম্যাগাজিন উদ্ধার হয়। এছাড়া দুটি নাইন এমএম পিস্তল উদ্ধার হয়। সেইসঙ্গে উদ্ধার হয় নাইন এম এম পিস্তলের ৮৪০ রাউন্ড তাজা বুলেট। এছাড়া দশটি বেয়োনেট উদ্ধার হয়। বেয়োনেট সাধারণত রাইফেলের সামনে লাগানো থাকে। কোন সময় রাইফেলের গুলি শেষ হয়ে গেলে, যাতে বেয়োনেট নিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা সম্ভব হয় বা হত্যা করা যায় এজন্য বেয়োনেট রাইফেলের নলের ওপর লাগানো থাকে। এগুলো খুবই বিষাক্ত। এছাড়া এসএমজির (স্মল মেশিন গান) ২৬৩ ম্যাগাজিন উদ্ধার হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশনস) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ জানান, শনিবার রাতভর সার্চ লাইট জ্বালিয়ে তাদের ডুবুরিরা খালের পানিতে অভিযান চালায়। বেলা এগারোটার দিকে ডুবুরীরা খালির পানি থেকে ডুবন্ত একটি কার্টন উদ্ধার করে। কার্টনে ৩২ ম্যাগাজিন পাওয়া যায়। দুপুর আড়াইটার দিকে পুরো এলাকা তল্লাশি শেষে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। প্রয়োজন হলে বা কোন তথ্য পেলে সে অনুযায়ী আবারও অভিযান চালানো হবে। সে সংক্রান্ত সব ধরনের প্রস্তুতি তারা নিয়ে রেখেছেন। ডিএমপির তুরাগ থানার ওসি মাহবুবে খোদা জানান, উদ্ধারকৃত কার্টনটি খালের পানিতে ডুবন্ত অবস্থায় ছিল। যা একটি কাগজ দিয়ে নানাভাবে প্যাকিং করা। প্যাক খুলতেই চকচকে ৩২ ম্যাগাজিন বেরিয়ে আসে। ম্যাগাজিনগুলো এসএমজির। এ নিয়ে ২৯৫ এসএমজির ম্যাগাজিন উদ্ধার হলো। আশপাশের ঝোপঝাড়ে বা খালের পানিতে এ ধরনের আরও অস্ত্রগোলাবারুদ কোন গোষ্ঠী ফেলে রেখেছে কিনা বা হস্তান্তরের জন্য রেখে দিয়েছে কিনা সে বিষয়ে পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনুসন্ধান চালাচ্ছে। পুরো এলাকার তল্লাশি চলছে। এছাড়া উদ্ধারকৃত ম্যাগজিনগুলো যেসব অস্ত্রে ব্যবহৃত হয়, সেসব অস্ত্র ঢাকায় বা তার আশপাশের এলাকায় প্রবেশ করেছে কিনা বা প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে কিনা সে বিষয়ে তৎপরতা অব্যাহত আছে। এজন্য তুরাগ তিন রাস্তা মোড়সহ প্রতিটি সড়কে বাড়তি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি অব্যাহত আছে। তবে রবিবার বিকেলে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় কোন মামলা হয়নি। বিষয়টি সম্পর্কে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের অস্ত্র উদ্ধার টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলছেন, এটি খুবই আতঙ্কের বিষয়। কারণ একত্রে ঢাকায় এত বড় অস্ত্রের চালান আর ধরা পড়েনি। কেন, কারা, কিভাবে অস্ত্রগোলাবারুদগুলো ঢাকায় এনেছে সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, বেশিরভাগ অস্ত্রই চীনের তৈরি। ধারণা করা হচ্ছে, এসব অস্ত্র বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান স্থলসীমান্ত দিয়ে নানাভাবে ঘুরে ঢাকায় প্রবেশ করেছে। তবে এসব অস্ত্রের চালানের সঙ্গে দেশী-বিদেশী বড় কোন চক্রের হাত থাকার সম্ভাবনা বেশি। ইতোপূর্বে কোন অস্ত্র ব্যবসায়ীর এত বড় চালান আনার কোন আলামত রেকর্ড মেলেনি। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে বা দেশে পুরোপুরি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই কোন বিশেষ গোষ্ঠী এত বড় অস্ত্রের চালান এনেছে। পুরো এই চক্রটির সঙ্গে বিশাল যোগসূত্র থাকতে পারে। উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত বা আশপাশের অন্য কোন সীমান্তপথে অস্ত্রগুলো ঢাকায় ঢোকার সম্ভাবনা বেশি। এই কর্মকর্তা বলছেন, উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ ও সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের পিস্তল পেশাদার সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও জেএমবি সদস্যরা ব্যবহার করে থাকে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এই দুই ধরনের পিস্তল ব্যবহার করলেও বেয়োনেট ব্যবহার করার কোন প্রমাণ মেলেনি। যে দশটি বেয়োনেট উদ্ধার হয়েছে, এ ধরনের বেয়োনেট একমাত্র জেএমবি সদস্যদের মধ্যে কমান্ডো নাইফ হিসেবে ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর এসএমজির যে ম্যাগাজিন উদ্ধার হয়েছে এ ধরনের অস্ত্রগোলাবারুদ পেশাদার সন্ত্রাসী বা কোন জঙ্গী সংগঠনের মধ্যে ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়নি। তবে হালে কোন জঙ্গী সংগঠন মারাত্মক নাশকতা চালাতে এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ছাত্রশিবিরের শুধু এ ধরনের নয়, এর চেয়েও ভারী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নজির রয়েছে। সবচেয়ে বড় ভয়ের বিষয় হচ্ছে, অস্ত্রের চালান নানাভাবে বিভক্ত হয়ে আসে। কৌশলের অংশ হিসেবে অস্ত্র, গোলাবারুদ, ম্যাগাজিনসহ অন্যান্য জিনিস আলাদা আলাদাভাবে আসে। যাতে একটি চালান ধরা পড়লেও, পুরোপুরি অস্ত্রগোলাবারুদের সবকিছু ধরা না পড়ে। শুধু পরবর্তীতে যেসব জিনিসপত্র ধরা পড়ে, তা আবার সংগ্রহ করলেই পূর্ণাঙ্গ অস্ত্রগোলাবারুদ মজুদ হয়ে যায়। বিপুল অস্ত্রগোলাবারুদ উদ্ধার সম্পর্কে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার বিধান ত্রিপুরা জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এবং স্থানীয় মাধ্যমে খবর পেয়ে তারা সেখানে অভিযান চালিয়ে অস্ত্রগোলাবারুদগুলো উদ্ধার করেন। তিনি আরও বলেন, দেশে পরিকল্পিতভাবে বড় ধরনের নাশকতা চালাতেই দেশীয় বা আন্তর্জাতিক কোন সন্ত্রাসী বা জঙ্গী গোষ্ঠী অস্ত্রগোলাবারুদের চালানটি ঢাকায় আনতে পারে। অস্ত্রগোলাবারুদগুলো সবই তাজা এবং নতুন। একেবারে নতুন প্যাকিং। ধারণা করা যায়, অস্ত্রগুলো ইতোপূর্বে ব্যবহৃত হয়নি। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে। অস্ত্রগোলাবারুদের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলছেন, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরাই অস্ত্রগুলো সেখানে রেখেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখা নিরাপদ নয় ভেবে তারা নিরিবিলি স্থানে সেগুলো ফেলে রেখে যায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ সম্পর্কে পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় শাখার সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক মোঃ মনিরুজ্জামান বলছেন, নানা দিক মাথায় রেখেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত হচ্ছে। দেশে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে আন্তর্জাতিক বা দেশীয় কোন সন্ত্রাসী বা জঙ্গী গোষ্ঠী জব্দ হওয়া অস্ত্রগোলাবারুদের বিশাল চালানটি আনতে পারে। এর পেছনে কারা রয়েছে সে বিষয়ে বিস্তর অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। এ ব্যাপারে তুরাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলছেন, সম্প্রতি রাজধানীর তুরাগ থানা থেকে রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় বদলি হওয়া এক কনস্টেবল শনিবার দুপুরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দিয়াবাড়ি খালপাড় দিয়ে যাচ্ছিলেন। সন্তানকে খালের পাশে প্রস্রাব করাতে দাঁড় করান। এ সময় নম্বরপ্লেটবিহীন একটি কালো বিলাসবহুল পাজেরো গাড়ি সেখানে থামে। গাড়ি থেকে চার-পাঁচজন লোককে ট্রাভেল ব্যাগ ফেলতে দেখেন। ব্যাগে লাশ ফেলা হচ্ছে সন্দেহে তিনি বিষয়টি তুরাগ থানা পুলিশকে জানান। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সেখানে অভিযান চালিয়ে অস্ত্রগোলাবারুদগুলো উদ্ধার করে।
×