ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গ্রামাঞ্চলে উঁচু তাল, খেজুর গাছ লাগিয়ে প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব

রাজধানীর নব্বই ভাগ ভবনেই নেই বজ্রপাত নিরোধক ॥ জাতীয় বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৯ জুন ২০১৬

রাজধানীর নব্বই ভাগ ভবনেই নেই বজ্রপাত নিরোধক ॥ জাতীয় বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না

শাহীন রহমান ॥ রাজধানীর নব্বই ভাগ ভবনে বজ্রপাত নিরোধক কোন ব্যবস্থা নেই। অথচ বজ্রপাত ঝুঁকি বিবেচনা করেই জাতীয় বিল্ডিং কোডে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বজ্রপাত নিরোধক দ- বা আর্থিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, পাকা ভবনে আর্থিং ব্যবস্থা রাখা হলে বজ্রপাতে ঝুঁকি ও প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কমানো সম্ভব। তিনি বলেন, যেসব ভবনে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা নেই সেসব ভবনে বজ্রপাতের সময় ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় ল্যান্ড ফোনের ব্যবহার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে হবে। প্রয়োজনে ল্যান্ড ফোন বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন উঁচু তালগাছ, খেজুরগাছ লাগানো ছাড়াও আর্থিংয়ের মাধ্যমে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকা যায়। যে স্থানে বজ্রপাত হবে সেখানে সবচেয়ে উঁচু যে বস্তুটি থাকবে বজ্রপাত মূলত তার উপর গিয়ে পড়ে। যদি কেউ বজ্রপাতের সময় নদীতে খোলা নৌকায় অবস্থান নেয় তাহলে তার উপর বজ্রপাত হবে। কারণ সেখানে সে সবচেয়ে উঁচু স্থানে রয়েছে। বজ্রপাতের সময় ঘরের ভেতর থাকা সবচেয়ে নিরাপদ। বাসায় বাজ পড়লেও তা টিন বা ইটের দেয়ালের মাধ্যমে মাটির সঙ্গে সহজে যুক্ত হবে। ফলে তেমন ক্ষতি হবে না। শহরে উঁচু ভবনের চারপাশে আর্থিং ব্যবস্থা থাকলে ঝুঁকি কম থাকে। আর্থিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুত পরিবাহী তামার তারের এক মাথা মাটির গভীরে পুঁতে রাখা হয়, অন্যপ্রান্ত থাকে ছাদের উপরে চোখা শিকের আকারে। এতে বজ্রপাতের হাত থেকে ভবন ও ঘরের মানুষ রক্ষা পায়। গ্রামে বাড়ির চারপাশে উঁচু সুপারি ও নারকেলগাছ লাগানো হলে বাজ পড়লে সেখানেই পড়ে। এতে বাড়ি সুরক্ষা পায়। তাদের মতে, বজ্রপাতে যে বিদ্যুত উৎপন্ন হয় তা আর্থিংয়ের মাধ্যমে মাটিতে ফেরত পাঠানো যায়। এজন্য ভবনের আর্থিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যবস্থার ফলে বজ্রপাতে ভবনের ক্ষতি হয় না ? বরং বিদ্যুত সরাসরি ভূমিতে চলে যায়? মাটি বা ছনের ঘরকে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা করতে ঘরের ওপর দিয়ে একটি রড টেনে তার সঙ্গে দুই দিকে দুটি রড খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে বজ্রপাতের বিদ্যুত ঘরকে আক্রান্ত না করে রডের ভেতর দিয়ে মাটিতে চলে যাবে। ইটের তৈরি অট্টালিকাতেও নিরাপদ করা যায়। তবে এখানে কিছুটা ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়। এতে ভবন ও ভেতরে থাকা ইলেকট্রনিক পণ্য নিরাপদ করা সম্ভব। এখানে ভবনের উপরে লৌহদ- বসিয়ে দিয়ে পাশ দিয়ে মাটির সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। তারা বলছেন, শহরে উঁচু দালানে বাজ নিরোধক আর্থিং ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। বাড়ির ছাদে উঁচু করে রাখা চোখা ধাতবদ- থাকে। ওই শলাকার সঙ্গে যুক্ত তামার তার দেয়ালের ভেতরে লুকোনো পাইপের মধ্য দিয়ে মাটির অন্তত ১০-১২ ফুট গভীরে বিশেষ ব্যবস্থায় স্থাপন করা হয়। মাটিতে বিদ্যুত ভোল্টশূন্য। তাই আকাশে মেঘের উঁচু বিদ্যুত চার্জ দ্রুত ছাদের চোখা ধাতবদ-ের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ভবনের কোন ক্ষতি হয় না। তবে আর্থিং ব্যবস্থা নিরাপদ হলেও দেশের অধিকাংশ পাকা ভবন ও উঁচু দালানগুলোর বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই নেই আর্থিং ব্যবস্থা। জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, বজ্রপাতের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে ভবন নির্মাণ বিধিমালায় এটি বাধ্যতামূলক করা হলেও তা অনুসরণ করা হয়নি। তিনি বজ্রপাতের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্য পুস্তকেই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খোলা মাঠে বা বাইরে যেহেতু বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বেশি, সেক্ষেত্রে উন্মুক্ত স্থানেও এক ধরনের পিলার বসিয়ে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ব্রিটিশদের সময় সারাদেশে খোলা জায়গায় এ ধরনের পিলার বসানো হয়েছিল। যেগুলো বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা করত। এখন তার সবই চুরি হয়ে গেছে। পিলারগুলো ফ্রিকোয়েন্সি অনুযায়ী একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব মেপে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছিল। এগুলো পিতল, তামা, লোহা, টাইটেনিয়মসহ ধাতব চুম্বক সমন্বয়ে গঠিত হওয়ায় বজ্রপাতে যে ইলেকট্রিক চার্জ তৈরি হয় সেটি সরাসরি এ পিলারগুলো এবজর্ভ করে আর্থিংয়ের কাজ করত। এতে বজ্রপাত হতো কিন্তু মানুষ মারা যেত না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যেসব এলাকায় বজ্রপাতের ঝুঁকি বেশি রয়েছে সেসব এলাকায় এ ধরনের আর্থিংয়ের ব্যবস্থা করে বজ্রপাতে ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। বর্তমানে দেশে বজ্রপাত এক বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতের সময় ঘরে থাকা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস যেমন- টিভি, ফ্রিজ, ফোনের ব্যবহার ছাড়াও ভবনের বিদ্যুত পরিবাহী লোহার গ্রিল বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। ফলে বজ্রপাতের সময় এগুলোর ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে হবে। এছাড়া প্রত্যেকটি ভবনের ছাদে পানির ট্যাঙ্ক বসানো থাকে। এই ট্যাঙ্কের উপর বজ্রপাত হলে সে সময় কেউ কলে পরিবাহিত পানি ব্যবহার করতে থাকলে তার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ বজ্রপাতের বিদ্যুত পানির মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। ভবনের গা বেয়ে যদি বজ্রপাত চলে যায় সেক্ষেত্রে গ্রিলের সংস্পর্শে কেউ থাকলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া ডিসের কেবলসহ অন্যান্য কেবলের মাধ্যমেও ঘরের ভেতরে থাকা যে কেউ এর শিকার হতে পারে। তবে ঘরের বাইরে খোলা মাঠেই বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটে। বজ্রপাতের সময় কেউ খোলা মাঠে থাকলে কোন গাছের নিচে আশ্রয় না নিতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যদি কোন ভবনের আর্থিং বা বজ্রপাত নিরোধক দ- থাকে তাহলে সব সময় ঝুঁকিমুক্ত থাকে। সম্প্রতি দেশে বজ্রপাতের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে এটি জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে গণ্য করেছে সরকার। জাতীয় দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ বছরই বজ্রপাতে নিহত হয়েছে ১০৩ জন। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বজ্রপাতে নিহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া বজ্রপাতের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া সম্ভব এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিশেষভাবে বজ্রপাতের আগে জনগণকে সচেতন করে তোলার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাত যেহেতু সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য একটি দুর্যোগ, যার হাত থেকে রক্ষা পেতে ব্যাপকভাবে জনগণকে সচেতন করে তোলার বিকল্প নেই। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রতিবছর গড়ে ২শ’ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বজ্রপাতে। এ হার বিশ্বের দ্বিতীয়। বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর বিষয়টি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবেও গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে মূলত বাইরে বা খোলা স্থানে অবস্থানের কারণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সময় দেশে তাল, খেজুর, নারিকেল ও সুপারি গাছের আধিক্য থাকার কারণে বজ্রপাত হতো মূলত এসব গাছের উপর। এসব গাছের কারণে মানুষ বেঁচে যেত। ফলে বজ্রপাত নিচে নেমে আসত না। কিন্তু উঁচু স্থানের অভাবের কারণে অথবা এসব উঁচু গাছপালার অভাবের কারণে তা এখন সরাসরি মানুষের উপর পড়ছে। এছাড়া বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সম্প্রতি দেশে বজ্রপাত বৃদ্ধি হওয়ারও অন্যতম একটি কারণ। শনিবার রাজধানীর মহখালীতে হোটেল অবকাশে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এক কর্মশালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্বাত্তিক পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন বলেন, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত উগান্ডায় হলেও জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে বাংলাদেশে এ ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, আকাশে কিউমুলো নিমবাস টাইপের মেঘ দেখা দিলেও বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া যেতে পারে। এই মেঘ দেখতে সুন্দর হলেও এর আড়লেই বিপদ লুকিয়ে থাকে। এই মেঘ মাটির ২ কিলোমিটার ওপর থেকে ওপরে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্তম্ভ আকারে থাকে। বজ্রপাতের পাশাপশি এ মেঘ থেকেও শিলা বৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, এই মেঘ তৈরির সময় বাইরে অবস্থানকালে যদি দেহের ও মাথার লোম খাড়া হয়ে যায় তাহলে ভাবতে হবে বজ্রপাতের ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। কারণ সেখানে এক ধরনের ইলেক্ট্রনিক চার্জ তৈরির কারণে এটি হয়ে থাকে। জাইকার কান্ট্রি প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর নাওকি মাতসুমুরা নিজ দেশে অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে অনুষ্ঠানে বলেন, জাপানে আগে বজ্রপাতে প্রতিবছর ৩০ জনের বেশি মারা যেত। এখন সচেতনতা গড়ে তোলায় বছরে ২ জনের বেশি মানুষ মারা যায় না। তিনি বলেন, এ বিষয়ে জাপানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে স্থানে বজ্রপাতের আশঙ্কা রয়েছে ১০ মিনিট আগে তার পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও স্কুলের পাঠ্য বইয়ে এ বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করে বাচ্চাদের সচেতন করে তোলা হচ্ছে। তিনি বলেন, জাপানে এখনও প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি বজ্রপাত হয়। অথচ মৃত্যুর ঘটনা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন বলেন, খেজুরগাছ, তালগাছের উপর মূলত বজ্রপাত বেশি হয়। এর ফলে মানুষ বাঁচত। বর্তমানে দেশে এর সংখ্যা কমে আসার কারণে বজ্রপাত এখন সরাসরি মানুষের ওপর পড়ছে। অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষের হাতে ব্যবহৃত মোবাইলসহ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বজ্রপাতের সময় ঝুকিপূর্ণ হতে পারে। তাই এগুলোতে প্রটেক্টর ব্যবহার করলে বা চামড়ার আবরণ দিয়ে ব্যবহার করলে ঝুঁকি অনেক কমে যায়। এছাড়াও গাড়িতে বসে থাকার সময় যদি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে তাহলে ধাতব পদার্থ থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে বসতে হবে। তবে সোজাসুজি মানুষের গায়ে বজ্রপাত হলে তার মৃত্যু অবধারিত।
×