ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টার্গেট কিলিংয়ের এরাই মূল হোতা

টপ র‌্যাঙ্কের এক ডজন জঙ্গী নেতা গ্রেফতারের পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৯ জুন ২০১৬

টপ র‌্যাঙ্কের এক ডজন জঙ্গী নেতা গ্রেফতারের পরিকল্পনা

শংকর কুমার দে ॥ দেশে অন্তত ছয়টি জঙ্গী সংগঠনের প্রায় এক ডজন টপ র‌্যাঙ্কের নেতৃত্বদানকারী জঙ্গী লিডারকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তারাই টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যার হোতা। খুবই দুর্ধর্ষ ও সুইসাইড স্কোয়াড গ্রুপের নেতা তারা। তারাই সিøপার সেল গঠন করে টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনায় নেতৃত্বদান করছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত তিন বছর ধরে প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, হিন্দু, খ্রীস্টান, বিদেশী, পুলিশ সদস্য, ভিন্নমতাবলম্বীদের টার্গেট কিলিং পরিণত করা হচ্ছে। দেশব্যাপী এক সপ্তাহ ধরে সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেফতার হওয়া ১৯৪ জঙ্গীর মধ্যে গ্রেফতারের পর অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সূত্র জানান, দেশব্যাপী এক সপ্তাহের সাঁড়াশি অভিযানে ১৯৪ জঙ্গী সদস্য গ্রেফতার হলেও টপ র‌্যাঙ্কের নেতৃত্বদানকারী দুর্ধর্ষ প্রকৃতির সুইসাইড গ্রুপের জঙ্গী লিডার গ্রেফতার করা যায়নি। তবে যারা ধরা পড়েছে তাদের কাছ থেকে এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে যে চারটি জঙ্গী সংগঠন টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে তার মধ্যে জামা‘আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আল্লাহ দল, আনসার আল ইসলাম, হরকত-উল-জিহাদ (হুজি) হিযবুত তাহরীর ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)। এই চারটি জঙ্গী সংগঠনের টপ র‌্যাঙ্কের নেতৃত্বদানকারী জঙ্গী নেতা হচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও হিযবুত তাহরীর যৌথ নেতৃত্বদানকারী নেতা সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারী মেজর জিয়া, ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে প্রিজনভ্যানে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে এক পুলিশকে হত্যা ও পাঁচ পুলিশকে আহত করে জেএমবির তিন জঙ্গী ছিনিয়ে নেয়ার নেতৃত্বদানকারী জেএমবির দুর্ধর্ষ দুই জঙ্গী সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তৌহিদ ও মিজান ওরফে বোমা মিজান ওরফে জাহিদুল হাসান সুমন। দেশের প্রথম ব্লগার প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে হত্যার নেতৃত্বদানকারী জামায়াত নেতা বড়ভাই হিসেবে পরিচিত সেই রানা এবং অভিজিৎ রায় হত্যাকা-ের পর সম্প্রতি যেসব টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটানোতে অংশগ্রহণ করেছে তার নেতৃত্বদানকারী এবিটির শীর্ষ পর্যায়ের সংগঠক শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১। এ ছাড়াও এবিটির দুর্ধর্ষ ও সুইসাইড গ্রুপের সদস্য সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী-২, সদস্য সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সালমান ওরফে সাদ। তাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ২ নবেম্বর রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় শিহাব ওরফে সুমন ওরফে সাইফুল ও সাজ্জাদ ওরফে সজীব ওরফে সিয়াম ওরফে শামসকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যাকা-ে কারা অংশ নিচ্ছে, কারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, কিভাবে পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে, অর্থ যোগানদাতা, মদদদাতাদের নামের তালিকা বের হয়ে আসার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। শিহাব ওরফে সুমনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করার চেষ্টা করছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে জঙ্গী দমনে দেশব্যাপী পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান শেষ হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের সাত দিনের জঙ্গীবিরোধী বিশেষ অভিযানে ১৯৪ জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ১৫১, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশের ৭, হিযবুত তাহরীরের ২১, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) ৬, আনসার আল ইসলামের ৩, আল্লাহর দলের ৪, হরকত-উল-জিহাদের এক ও আফগানিস্তান থেকে ফেরত একটি জঙ্গী সংগঠনের এক সদস্য রয়েছেন বলে পুলিশ দাবি করেছে। অভিযানের শেষদিনে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ধরা পড়েছে ১৭ জঙ্গী। তাদের মধ্যে ৯ জেএমবি, ৭ হিযবুত তাহরীর এবং ১ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন অস্ত্র ও বই উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একটি পাইপগান, একটি শাটারগান, দুটি ককটেল, একটি রামদা, একটি চাপাতি ও ১৪টি উগ্রপন্থী জিহাদী বই। কিন্তু টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত ও জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বদানকারী টপ র‌্যাঙ্কের জঙ্গী নেতা বা সুইসাইড গ্রুপের সদস্য গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারেনি গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকা-ের ঘটনার পরই মূলত দেশব্যাপী এক সপ্তাহের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হওয়ার মধ্যেই পাবনার হেমায়েতপুরে সেই একই কায়দায় খুন হলেন শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পা- (৬২)। নাটোরে মুদি দোকানি সুনীল গোমেজ। এর আগে খুন হন ঝিনাইদহে পুরোহিত আনন্দ গোপাল। এখন যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই হিন্দু ও খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী। এসব টার্গেট কিলিং বা গুপ্ত হত্যাকা-ের ঘটনার তদন্তে অগ্রগতি দাবি করা হলেও এখন পর্যন্ত পরিকল্পনাকারী ও মদদদাতা কিংবা মাস্টারমাইন্ড কাউকেই আটক করতে পারেনি। এ ধরনের টার্গেট কিলিংয়ের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যত রয়ে গেছে অন্ধকারেই। এই পরিস্থিতিতেই আবারও মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যার চেষ্টা এবং এই ঘটনায় ফয়জুল্লা ফাহিম নামে হিযবুত তাহরীর এক দুর্ধর্ষ সদস্য গ্রেফতারের পর পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে মারা গেছে। এ ছাড়াও রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশনে চিঠি দিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। চিঠিতে হুমকিদাতার নাম লেখা রয়েছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএস, যদিও সরকারের তরফ থেকে বার বারই বলা হচ্ছে, দেশে কোন আইএস নেই। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক কর্মকর্তা বলেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যরাই টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যায় অংশ নিয়েছে বেশিসংখ্যক বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গীদের মধ্যে শরিফুল এবিটির সংগঠনের সদস্যদের সামরিক ও আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিত। টিএসসিতে অভিজিৎ রায়, গোড়ানে নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয়, লালমাটিয়ায় আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টা ও সাভারে শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিয়াদ মোর্শেদ বাবু হত্যা মামলার তদন্তে তার সরাসরি উপস্থিতি এবং নেতৃত্ব দেয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। তা ছাড়া ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা, তেজগাঁওয়ে ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নাজিমুদ্দিন সামাদ এবং কলাবাগানে জুলহাস মান্নান ও মাহবুব তনয় হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী শরিফুল। এখন প্রশ্ন হলো শরিফুল কীভাবে নির্বিঘেœ এত হত্যাকা-ে অংশ নিয়ে এখনও সে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে? শুধু তাই নয় দেশব্যাপী এক সপ্তাহের সাঁড়াশি অভিযানেও শরিফুলের মতো দুর্ধর্ষ ও টপ র‌্যাঙ্কের জঙ্গী নেতা গ্রেফতার হয়নি। শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ ৩ জনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় শিহাব ওরফে সুমন ওরফে সাইফুল ও সাজ্জাদ ওরফে সজীব ওরফে সিয়াম ওরফে শামসকে গ্রেফতারের পর ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, যাতে টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটনে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন গোয়েন্দারা।
×