ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মিতু হত্যা ১৩ দিনেও ঘুরপাক খাচ্ছে তদন্তেই

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৯ জুন ২০১৬

মিতু হত্যা ১৩ দিনেও ঘুরপাক খাচ্ছে তদন্তেই

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ শনিবার তেরো দিনেও কোন কুলকিনারা হয়নি এসপি বাবুল আক্তারের সহধর্মিণী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটনে। আটক অনেক সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৩ জনকে। হত্যাকা- সম্পর্কিত কোন তথ্যই মেলেনি এদের কাছ থেকে। তবে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত সংস্থা ও সহযোগী পাঁচটি কমিটির সদস্যরা ছাড়াও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিইউ), র‌্যাব, সিআইডি, পুলিশ ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স (পিবিআই) মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। কিন্তু রহস্য উদঘাটনে কোন কূলকিনারা করতে পারছে না। শনিবার সন্ধ্যায় এ ব্যাপারে পিবিআইয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা তো ভাই মিষ্টির দোকান নয়। দোকানে গিয়ে মিষ্টি কিনলাম আর বাসায় এনে খেলাম।’ এ ধরনের হত্যাকা- তদন্তে অনেক বিষয়াদি রয়েছে। অনাহূত কাউকে গ্রেফতার করে ফাঁসিয়ে দেয়া তো সহজ। কিন্তু এতে তো প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। তাই অনেকটা ধীরে সুস্থে তথ্য সংগ্রহ এবং এর সত্যতা যাচাই করে প্রতিটি তদন্ত কর্মকর্তারা এগোচ্ছেন। আমরা আশাবাদী আজ কাল বা পরশু বা আরও পরে অবশ্যই এ হত্যারহস্য উদঘাটিত হবেই। পুলিশ পরিবারের ওপর অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনায় যারা জড়িত তারা কোন অবস্থাতেই পার পাবে না। এদিকে, ঘটনার পর পরই হত্যাকা-টি জঙ্গীরা ঘটিয়েছে, পরে জামায়াত-শিবির ও চোরাচালানি চক্রের সদস্যদের সন্দেহ করা হলেও তা ধীরে ধীরে গতি হারাচ্ছে। কেননা, ইতোমধ্যেই গুন্নু, রবিন এবং বুলবুলকে এ হত্যাকা-ে গ্রেফতার করা হলেও রিমান্ডে তাদের কাছ থেকে কোন তথ্যই বের হচ্ছে না। কারা কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিচ্ছে না। ফলে পুলিশ বিভিন্ন পর্যায়ে আরও সোর্স লাগিয়ে ওই দিনের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। সর্বশেষ পিবিআইয়ের তথ্য অনুযায়ী তিনটি বিশেষ পয়েন্ট সামনে রেখে তারা এ হত্যাকা- রহস্য উন্মোচনে তৎপরতা চালাচ্ছে। কি এসব পয়েন্ট এবং কি ধরনের তৎপরতা চলছে তা তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে না। শুধু এ তথ্য দেয়া হয়েছে যে, সফলতা এলেই জানানো হবে। এদিকে, একজন পুলিশ পরিবারের হত্যা রহস্য উদঘাটনে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এতগুলো সংস্থা এ পর্যন্ত কোন কূলকিনারা করতে না পারায় সাধারণ জনমনে নানা ধরনের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। যেখানে উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যাকা-ের শিকার হয়ে কোন ক্লু উদঘাটন করা যাচ্ছে না, সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়Ñ এ প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার ইতোমধ্যে কয়েকদফায় স্বীকার করেছেন তারা এ হত্যাকা- নিয়ে কোন রহস্য এখনও উদঘাটন করতে পারেননি। তবে চেষ্টা চলছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক সদস্য শনিবার এ প্রতিবেদককে জানান, আইজির নির্দেশে একদিকে পাঁচটি আলাদা কমিটি হয়েছে, অপরদিকে আরও চারটি সংস্থাকে মাঠে নামানো হয়েছে। সমন্বয় করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সভা করতে বাধ্য হচ্ছেন। কেননা, অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তা সিএমপির ডিবি কার্যালয়ে যেতে অনীহ। এর নেপথ্যে রয়েছে ডিবির শীর্ষ কর্মকর্তার অসদাচরণ ও অনাহূতভাবে তিরষ্কার ও নিন্দনীয় আচরণ। ইতোমধ্যে এ কর্মকর্তার ক্ষমতাও কিছুটা খর্ব করা হয়েছে। এরপরও ওই কর্মকর্তা নাকি সহকর্মীদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে থাকেন। প্রসঙ্গত, বাবুল আক্তারের সঙ্গে এই কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনও ভাল ছিল না। ইতোপুর্বে চট্টগ্রাম জেলা এসপি কার্যালয়ের ওই কর্মকর্তা যখন এডিশনাল পুলিশ সুপার ছিলেন তখন বাবুল আক্তার ছিলেন হাটহাজারীর সার্কেল এএসপি। এসপি পদে যিনি ছিলেন তিনি বাবুল আক্তারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন এবং তাকে মাঠে অপারেশনের কাজে লাগাতেন। বিষয়টি ওই এডিশনাল এসপি কখনও ভাল চোখে দেখেননি। পরবর্তীতে সিএমপিতেও দুজনের কর্মস্থল হয়ে যায়। এখানেও দুজনের সঙ্গে অতীতের যে দূরত্ব তা ঘোচানো যায়নি। যে কারণে এডিশনাল এসপি থেকে এসপি পদে পদোন্নতির আদেশের পর দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম বাবুল আক্তারকেই সিএমপি থেকে রিলিজ করে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে এটাচড করা হয়। মিতু হত্যাকা-ের দিন বাবুল আক্তারের যোগদানের কথা ছিল। যোগদানের মাত্র ঘণ্টা আড়াই আগে স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু নির্মমভাবে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাত ও গুলিতে প্রাণ হারান। ঘটনার সংবাদ ঢাকায় শুনে বাবুল আক্তার তখনই বলেছিলেন, এ মুহূর্তে আমাকে সিএমপি থেকে রিলিজ না করার জন্য আকুতি জানিয়েছিলাম। তারপরও আমাকে রিলিজ করায় পরিবারকে একা ফেলে রেখে আসায় আজ এ মহাবিপদ নেমে এসেছে। হত্যাকা-ের পর পর র‌্যাবের হেলিকপ্টারযোগে বাবুল আক্তারকে চট্টগ্রামে আসার ব্যবস্থা করা হয়। চমেক হাসপাতালে মর্গে গিয়ে তিনি সিএমপির কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘স্যার আমাকে কেন রিলিজ করলেন।’ বাবুল আক্তার জানতেন তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুদূত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এ ব্যাপারে তিনি সিএমপির সদর দফতরে জানিয়ে রেখেছিলেন। শুধু তিনি নয়, জঙ্গীরা পুলিশ সদস্যদের টার্গেট করেছে এ বিষয়টি ও নিশ্চিত হয়ে পুলিশ সদর দফতরকে জানানোর পর এ ব্যাপারে পুলিশের চলাফেরায় সাবধানতা অবলম্বনের জন্য সার্কুলারও জারি হয়। এসব বিষয় বাবুল আক্তারের পক্ষে জানানোর পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার স্ত্রীকেই ওই আশঙ্কার শিকার হতে হয়েছে। এ নিয়ে সরকার, প্রধানমন্ত্রী ও দেশের সচেতন সকল মহল সোচ্চার হয়েছে বটে। আইজি, এডিশনাল আইজি, পিবিআই প্রধান, মন্ত্রীসহ অনেকেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। কিলিং মিশনের সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য যত প্রক্রিয়া অবলম্বন প্রয়োজন সবই করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু গত ১৩ দিনেও সফলতার মুখ দেখা মেলেনি। এক্ষেত্রে তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তা এবং সহযোগী কমিটির সদস্যদের অবহেলা আছে এমন অভিযোগ এখনও ওঠেনি। তারপরও প্রশ্ন উঠেছে এমন একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের ঘটনা উদঘাটনে পুলিশ সদস্যদের অদক্ষতাই কি মূল কারণ। নাকি এর নেপথ্যে অন্য কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। এসব প্রশ্নে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে জনমনে।
×