ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী, গুপ্তহত্যাকারীদের জানাজা পড়াও হারাম

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৯ জুন ২০১৬

জঙ্গী, গুপ্তহত্যাকারীদের জানাজা পড়াও হারাম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ইসলামের নামে জঙ্গীবাদ ও আত্মঘাতী হামলাকে ‘হারাম, জঘন্য অপরাধ ও অবৈধ’ বলে অভিহিত করে ফতোয়া জারি করেছেন দেশের লক্ষাধিক মুফতি, ওলামা ও আইম্মা। শনিবার রাজধানীতে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সেই ফতোয়া প্রকাশ করে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের গ্র্যান্ড ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ ঘোষণা দিয়েছেন- ধর্মের নামে সন্ত্রাসকারী, জঙ্গী, গুপ্তহত্যাকারীদের জানাজা পড়াও হারাম। ইসলাম এদের কখনই শহীদের মর্যাদা দেয় না। বরং যারা জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মারা যাবেন তারা শহীদের মর্যাদা পাবেন। অমুসলিমদের গির্জা, প্যাগোডা, মন্দির ইত্যাদি উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম, অবৈধ ও কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেশের বিশিষ্ট মুফতি, আলেম ও ইমামরা এই বলে ফতোয়া দিয়েছেন যে, ইসলামের নাম ব্যবহার করে কতিপয় সন্ত্রাসীগোষ্ঠী নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে মহাগ্রন্থ কোরান ও হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এরা ইসলামের কেউ নয়। এরা ইসলামের শত্রু। মানুষের চোখে ইসলামকে এরা একটা বর্বর নিষ্ঠুর ও সন্ত্রাসী ধর্মরূপে চিত্রিত করছে। জিহাদ ও সন্ত্রাস একই জিনিস নয়। জঙ্গীদের অনেকেই ‘জিহাদী’ বললেও তারা আসলে সন্ত্রাসী। ইসলাম সন্ত্রাস সমর্থন করে না। আর যারা বেহেশত পাওয়ার আশায় আত্মঘাতী হামলা করছে, বলছে মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী, তারা কোরান ও হাদিসের আলোকে বেহেশত পাবে না। তাদের স্থান নিশ্চিত দোজখে। ‘মুসলিম সমাজে বসবাসকারী অমুসলিমকে যদি কেউ হত্যা করে, সে বেহেশতের গন্ধও পাবে না। অমুসলিমদের গির্জা, প্যাগোডা, মন্দির ইত্যাদি উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম, অবৈধ ও কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গত প্রায় দুই বছরে লেখক, প্রকাশক, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট, অধ্যাপক, বিদেশী, হিন্দু পুরোহিত, খ্রীস্টান যাজক, বৌদ্ধ ভিক্ষুর ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে একই কায়দায় হামলার প্রেক্ষাপটে দেশের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো এ ধরনের শক্ত মতামত এলো। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- দেশের বিশিষ্ট মুফতি, আলেম ও ইমামরা। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ জমিয়াতুল ওলামার সেক্রেটারি মাওলানা আবদুর রহীম কাসেমী, নূরুল উলূম কুলিয়ারচরের প্রিন্সিপাল মুফতি আবদুল কাইয়ুম খান, বাংলাদেশ জমিয়াতুল ওলামা ঢাকা মহানগরীর সভাপতি মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাইফী, সার্কিট হাউস জামে মসজিদের খতিব ও জামি’আ ইকরার প্রিন্সিপাল মাওলানা আরীফ উদ্দীন মারুফ, খুলনা মাদানীনগর মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ইমদাদুল্লাহ কাসেমী, বাংলাদেশ জমিয়াতুল ওলামা ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুন, ফতোয়ার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাওলানা যাকারিয়া নোমান ফয়জী, বাংলাদেশ জমিয়াতুল ওলামা ময়মনসিংহের আহ্বায়ক মাওলানা উবায়দুর রহমান, ঢাকা মহানগরীর সহসভাপতি মুফতি শরফউদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মাওলানা হোসাইনুল বান্না প্রমুখ। ফতোয়া প্রকাশ, পরিকল্পনা, কর্মসূচী ॥ সংবাদ সম্মেলনে ফতোয়া প্রকাশ করেন এক লাখ আলিম, মুফতি ও ইমামগণের ফতোয়া ও দস্তখত সংগ্রহ কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ জমিয়াতুল ওলামার চেয়ারম্যান আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। তিনি বলেন, ইসলাম শান্তিবাদী, উদার, সহিষ্ণু এবং অসাম্প্রদায়িক এক ভারসাম্যপূর্ণ সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা। মহান রাব্বুল আলামীন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন সারা আলমের প্রতিটি বস্তুর জন্য রহমত এবং করুণার আধার হিসেবে। তাঁর এবং তাঁর সঙ্গী সাহাবীগণের জীবনে মানুষের প্রতি কল্যাণকামিতার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় আজ কতিপয় দুষ্কৃতকারী নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে মহাগ্রন্থ কোরান ও হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে ইসলামের নামে বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মানুষের চোখে ইসলামকে একটা বর্বর নিষ্ঠুর ও সন্ত্রাসী ধর্মরূপে চিত্রিত করছে। এতে সরলমনা কেউ কেউ বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। এই উগ্রজঙ্গীবাদীরা মূলত ইসলাম ও মুসলিমদেরই শত্রু নয়, মানবতারও শত্রু। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, আফ্রিকার দেশসমূহ কিভাবে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, তা আজ কারও অজানা নেই। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও আজ হুমকির সম্মুখীন। তাই বিষয়টি স্পষ্ট যে, এদের হৃদয় বৈকল্য বিদূরিত করা না গেলে কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এদের দমন করা সম্ভব নয়। কারণ এই সন্ত্রাসীরা তো ধর্মের নামে আত্মদানে প্রস্তুত। তাদের চৈতন্যের বিভ্রম দূর করা দরকার সবার আগে। ইসলামের সঠিক ও বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা তুলে ধরে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের পক্ষে তা করা সম্ভব। শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম বলেন, সুখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে মহিলাগণের মাঝেও বিপুলসংখ্যক আলিম ও মুফতির আবির্ভাব ঘটেছে। এই ফতোয়ায় মহিলা আলিম ও মুফতিগণের দস্তখত নেয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে বেশ সাড়াও পাওয়া গেছে। বর্তমান বিশ্বে এটা একটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়া সংযোজন। কমিটি এ বিষয়ে দারুল উলুম দেওবন্দ ভারত, মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা, চরমোনাই জামি’আ রশিদিয়া ইসলামিয়া, শায়খ যাকারিয়া রিসার্চ সেন্টার কুড়িল, ঢাকা, বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়াসহ বিশেষ কতিপয় ইসলামী প্রতিষ্ঠানের ফতোয়াও সংগ্রহ করে। এগুলো এখানে পত্রস্ত করা হয়েছে। এক লাখ মুফতি, ওলামা, আইম্মার দস্তখত সংবলিত সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদবিরোধী মানবকল্যাণে শান্তির ফতোয়ার সমর্থনে ঢাকা বিভাগে ২৮ হাজার ৫৬, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ হাজার ৬৮১, খুলনা বিভাগে ১৪ হাজার ২৫০, রংপুর বিভাগে নয় হাজার ৭৭০, ময়মনসিংহ বিভাগে আট হাজার ৮৯২, রাজশাহী বিভাগে দুই হাজার ২০০, বরিশাল বিভাগে এক হাজার ৪৫০ এবং সিলেট বিভাগে ১৬ হাজার ২২৫-সহ মোট এক লাখ ১৫২৪টি স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, আল্লাহপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানবকল্যাণের বিপুল আগ্রহে মুফতিগণ, আলিম ওলামা ও আইম্মা কেরাম বিপুল ক্লেশ স্বীকার করে দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেন। কাজটি সহজ ছিল না। দস্তখতের জন্য আলিম, মুফতি ও ইমামগণের দ্বারে দ্বারে সশরীরে উপস্থিত হতে হয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রভাব তুলে ধরতে হয়েছে। পরে দস্তখত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। আমরা তাদের পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করব তো দূরের কথা রাহা খরচটাও যথাযথ দিতে পারিনি। অনেক স্থানে তারা বিরূপ সমালোচনারও সম্মুখীন হয়েছেন। আল্লাহকে খুশি করতে, ইসলামের খাতিরে মানবতার খাতিরে অম্লান বদনে তারা সব সয়েছেন। এই সন্ত্রাসবিরোধী ফতোয়ার প্রধান দুটো বৈশিষ্ট্য হলো, জঙ্গীবাদীরা যে চেতনা থেকে বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে সেগুলো অপনোদনের চেষ্টা করা হয়েছে। ব্যাখ্যাসহ সবিস্তার দলিল-প্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। মহিলা আলিম ও মুফতিগণেরও সমর্থন নেয়া হয়েছে। এটি আজ পর্যন্ত কোন ফতোয়ায় করা হয়েছে কিনা জানা নেই। ৩০ খ-ে ফতোয়া ও দস্তখতসমূহ গ্রন্থবদ্ধ করা হয়েছে জানিয়ে মুফতি আলেম ইমামরা বলেন, আমাদের পরিকল্পনা হলো একটি কপি জাতিসংঘকে, একটি ওআইসিকে আরেকটি মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং আরেকটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তে অর্পণ করব। ইতোমধ্যেই এই ফতোয়ার একটা ইংরেজী, আরেকটা আরবি ভার্সনও প্রস্তুত করা হয়েছে। মুফতি, আলিম ও ইমামগণসহ নাগরিক সমাজ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরে আমরা বিপুল সমর্থন ও আগ্রহ দেখেছি। সকল পর্যবেক্ষক আমাদের উৎসাহিত করেছেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের এই ব্যাখ্যা অবশ্যই বিরাট অবদান রাখবে এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের মর্যাদা শীর্ষমার্গে নিয়ে যাবে। এ ধরনের বিরাট কাজ আজ পর্যন্ত পৃথিবীর আর কোথাও কখনও হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। গিনেস বুকের রেকর্ডস বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। ইসলামী ব্যক্তিরা সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ফতোয়ার মূল অংশটি যদি পুস্তিকাকারে কোটিখানিক ছেপে সর্বত্র পৌঁছে দেয়া হয় তবে দেশ ও সমাজের অনেক বেশি লাভ হবে। অনেক বড় পুণ্যের কাজ হবে। এদিকে আহলে খায়ের ও সম্পদশালীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমাদের কাজ এখানেই শেষ নয়। সামনে আরও কর্মসূচী নেয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। এক মাস পর ফতোয়াটি প্রকাশের পর সমাজে এর কী প্রতিক্রিয়া হলো তা যাচাই করতে উদ্যোগ নেয়া হবে। জেলায় জেলায় সম্মেলন করার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। ট্রেনযাত্রা ও পথযাত্রারও চিন্তা আছে। গণমাধ্যমসমূহকে অনুরোধ করব প্রতিদিন এর কোন একটি উদ্ধৃতি প্রচার করতে। আর বারবার প্রচার করতে, যা গণসচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। ফেসবুক, টুইটারসহ সবধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও কাজে লাগাতে হবে। এসব বিষয়ে আপনাদের সহযোগিতা ও পরামর্শ আশা করি। বাধা জামায়াত-শিবির ॥ আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, বিশাল এ কাজ করতে গিয়ে কিছু কিছু সমস্যার সম্মুখীন যে হতে হয়নি তা নয়। তিন শ্রেণী থেকে আমাদের বাধাগ্রস্ত হতে হয়েছে। জামায়াত, শিবির ও জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীÑ আমরা জেহাদের বিরুদ্ধে কাজ করছি এই অপবাদ তুলে ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমসমূহে এরা নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছে। আরেক দল এমন যারা বিষয়টি সমর্থন করেছে কিন্তু জঙ্গীবাদের হামলার শিকার হওয়ার আতঙ্কে দস্তখত করতে চাননি। আর এই আতঙ্ক তারা প্রচার করেছেন। আরেক শ্রেণী হলো হিংসুকদের। আল্লাহ পাক মেহেরবানী করে সব বাধা কাটিয়ে কাজটি অগ্রসর করে দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হতে পারে ফতোয়ায় কি সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ ঠেকানো যাবে? আমরা দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই লক্ষ অস্ত্রের চেয়েও ফতোয়ার শক্তি অনেক ধারালো। মনো চেতনা মানব কর্মের মূল উৎস। সঠিক ফতোয়া সেই মনো চেতনাকে শুদ্ধ করে, আলোড়িত করে, মানবতাবাদী বানায়। মুসলিম সমাজে ফতোয়ার ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনস্বীকার্য। ধর্মের নামে সন্ত্রাস যারা করছে তারা বেহেশতলাভের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তা করছে। এটা যে বেহেশতের নয় জাহান্নামের পথ তা যখন বুঝতে পারবে নিশ্চয় তারা এ পথে পা বাড়াবে না। সুতরাং মানবকল্যাণ ও শান্তির ফতোয়ার এই বারতা সন্ত্রাস পুরোপুরি ঠেকাতে না পারলেও এতে যে তা বহুলাংশে হ্রাস পাবে তাতে সন্দেহ নেই। সন্ত্রাসের মদদদাতারা এতে হতোদ্যম হবে দ্বিধাহীনভাবে তা বলা যায়। ১০ প্রশ্ন, কি আছে ফতোয়ায় ॥ ফতোয়ায় স্বাক্ষরের জন্য ১০টি প্রশ্নের জবাবে ওলামায়ে কেরাম তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। একমত পোষণ করে ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেন। সন্ত্রাস ঠেকাতে কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন বক্তব্যের আলোকেই ফতোয়াগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রশ্ন ছিল- শান্তির ধর্ম ইসলাম কি সন্ত্রাস ও আতঙ্কবাদের কর্মকা-কে সমর্থন করে? নবী ও রাসূল বিশেষ করে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসলাম কায়েম করার পথ কি হিংস্রতা ও বর্বর নির্মমতার অবস্থান ছিল? ইসলামে জিহাদ ও সন্ত্রাস কি একই বিষয়? জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের পথ কি বেহেশতের পথ না জাহান্নামের পথ? আত্মঘাতী মৃত্যু কি শহীদী মৃত্যু বলে গণ্য হবে? আত্মহত্যা ও আত্মঘাতের বিষয়ে ইসলামের মত কী? গণহত্যা কি ইসলামে বৈধ? শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিচারে হত্যা কি ইসলাম সমর্থন করে? ইবাদতরত মানুষ হত্যা করা কি ধরনের অপরাধ। এ ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইসলামের দৃষ্টিতে কর্তব্য কি না? সবশেষে আছে- গির্জা, মন্দির, প্যাগোডা ইত্যাদি অমুসলিম উপাসনালয়ে হামলা যায়েজ কি না? লক্ষাধিক আলেম-ওলামার স্বাক্ষরিত ফতোয়ার মধ্যে সূচি, সহযোগী আলেমদের নামসহ ফতোয়া যুক্ত করা হয়েছে। ‘ইস্তিফতা ও এর উত্তর’ শীর্ষক অধ্যায় দিয়ে ফতোয়াটি দেয়া হয়েছে। সুরা তওবার কয়েকটি আয়াত এবং বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত একটি হাদিসকে প্রেক্ষিত ধরে ফতোয়ায় ১০টি প্রশ্ন যুক্ত করা হয়েছে। ওই প্রশ্নগুলোর উত্তরেই ইসলামের ব্যাখ্যা সংবলিত মূল ফতোয়াটি বর্ণিত হয়েছে। এরপর কোরআন শরিফ ও হাদিস শরিফের দলিলের ভিত্তিতে ১০টি প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে। যেমন ৩ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, ‘জিহাদ ও সন্ত্রাস একই জিনিস নয়। জিহাদ হলো ইসলামের অন্যতম একটা নির্দেশ, পক্ষান্তরে সন্ত্রাস হলো হারাম ও অবৈধ।’ ৫ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, ‘আত্মহত্যা ও আত্মঘাত ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম।’ ৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, ‘ইসলামে নিরাপরাধ মানুষদের গণহারে হত্যা বৈধ নয়। এমনকি সন্দেহের বশবর্তী হয়েও কাউকে হত্যা করা নিষেধ।’ ৯ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা আছে, ‘মুসলিম সমাজে বসবাসকারী অমুসলিমকে যদি কেউ হত্যা করে সে বেহেশতের গন্ধও পাবে না। অমুসলিমদের গির্জা, প্যাগোডা, মন্দির ইত্যাদি উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম ও অবৈধ। এটি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ ধারাবাহিকভাবেই এভাবে ১০টি প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে কোরআন শরিফের আয়াত ও হাদিস দিয়ে। আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই লাখো অস্ত্রের চেয়েও ফতোয়া অনেক শক্তিশালী, অনেক ধারালো। সঠিক ফতোয়া মনোজাগতিক চেতনাকে শুদ্ধ করে, আলোড়িত করে এবং মানবতাবাদী বানায়। ৩২ পৃষ্ঠার ফতোয়াটির ‘প্রসঙ্গকথায়’ ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ লিখেছেন, ‘মানবকল্যাণ ও শান্তির ফতোয়ার এই বারতা সন্ত্রাস পুরোপুরি ঠেকাতে না পারলেও এতে যে বহুলাংশে হ্রাস পাবে তাতে সন্দেহ নেই। সন্ত্রাসের মদদদাতারা এতে হতোদ্যম হবে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়।’ শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম বলছিলেন, ‘যারা ধর্মের নামে হত্যা এবং বিভিন্ন সন্ত্রাস করছেন তারা সঠিক কাজ করছেন না। ইসলাম ধর্মে হত্যাকে কোনভাবে সমর্থন করে না। ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছেন যে বিশিষ্ট মুফতি, আলেমরা ॥ বেফাকুল মাদারিসিল আরবী বাংলাদেশেরসহ সভাপতি, মাওলানা আশরাফ আলী, দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর প্রধান মুফতি, মাওলানা মুফতি আব্দুস সালাম, আল জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রামের প্রিন্সিপাল মাওলানা মুফতি আব্দুল হালিম বুখারী, জামিয়া দারুল মা’আরিফ, চট্টগ্রামের প্রিন্সিপাল, মাওলানা সুলতান যওক্ব নদভী, দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুফতি মাওলানা নূর আহমদ, জামিআ আরাবিয়া এমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ, ঢাকার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, পূর্ব সিলেট আযাদ দ্বীনী এদারা বোর্ডের সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ বিন ইদ্রীস লক্ষ্মীপুরী, পূর্ব সিলেট আযাদ দ্বীনী এদারা বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী, জামিয়াতুস সাহাবা উল্টরার প্রিন্সিপাল আামীন উজানবী, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী, খাদিমুল ইসলাম গওহরডাংগা মাদরাসার প্রিন্সিপাল, মাওলানা মুফতি রুহুল আমীন। আরও আছেন মাওলানা মুফতি মনসুরুল হক, মাওলানা মুফতি নুরুল হক জকিগঞ্জী, মাওলানা নোমান ফয়জী, মাওলানা মুফতি আব্দুল হক, মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী, মাওলানা মুফতি মিজানুর রহমান, মাওলানা আবদুল হক হক্কানী, মুফতি ইউসুফ শেমপুরী, মাওলানা আনোয়ারুল করীম যশোরী, মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ, মাওলানা মুফতি এনামুল হক, মাওলানা মুফতি আবুল কাসিম, মাওলানা নাসিরুদ্দীন, সিনিয়র মুহাদ্দিস, মুফতি কেফায়েতুল্লাহ, মাওলানা শওকত সরকার, মাওলানা হাফিজুদ্দীন, প্রিন্সিপাল, মাওলানা আনাস, মুফতি সাইয়্যিদ নুরুল করীম, মাওলানা আবদুল আওয়াল, মাওলানা হেলাল আহমদ প্রমুখ। আছেন নারী আলেমা ও মুফতি ॥ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত লাখো আলেমের ফতোয়ায় অংশ নিয়েছেন নারী আলেমরাও। দেশের ৯ হাজার ৩২০ জন নারী আলেমা স্বাক্ষর করেছেন জঙ্গীবাদবিরোধী ফতোয়ায়। ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, আমাদের দেশে মহিলাগণের মাঝেও বিপুলসংখ্যক আলিম ও মুফতির আবির্ভাব ঘটেছে। এই ফতোয়ায় মহিলা আলিম ও মুফতিগণেরও দস্তখত নেয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে বেশ সাড়াও পাওয়া গেছে। বর্তমান বিশ্বে এটা একটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়া সংযোজন। দেশের নারী আলেমরাও জঙ্গীবাদবিরোধী ফতোয়ায় অংশ নিতে আগ্রহী ছিলেন। বিশেষ করে সিলেট বিভাগের মহিলা মাদ্রাসাগুলোয় এ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয়। মহিলা মাদ্রাসার মধ্যে রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসা, দুর্লভপুর দারুল হাদিস মহিলা মাদরাসা সিলেট, বারুতখানা দারুল হাদিস মহিলা মাদরাসা উল্লেখযোগ্য। স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসার আলেমা তানজিলা আফরিন, উম্মে হাফছা, আমেনা, কুলসুম রিমা, খাদিজাতুল কুবরা, তানজিম তাসফিয়া দিনা, আনিকা আহাদ, ফাতেমা খাতুনসহ আরও অনেকের নাম রয়েছে। এ মাদরাসাটির প্রিন্সিপাল চরমোনাই পীরের ভাই মাওলানা মুসতাক আহমদ। নরসিংদী জেলার কয়েকটি মহিলা মাদরাসার নারী আলেমদের মধ্যে রয়েছেন, আলেমা মোসা তৈয়্যবা, উম্মে সালমা, আমিনা, সুরাইয়া, মাকসুদা, তাসফিয়া, মুশফিকাসহ আরও অনেকে। স্বাক্ষর হয়নি ইফা ডিজি ও বায়তুল মোকাররমের খতিবের ॥ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদবিরোধী মানবকল্যাণে শান্তির ফতোয়ায় স্বাক্ষর নেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল ও বায়তুল মোকাররমের খতিব অধ্যাপক মাওলানা মুহাম্মদ সালাহউদ্দিনের। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ফতোয়া মূল উদ্যাক্তা আল্লামা মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। তবে বায়তুল মোকররমের ইমামরা স্বাক্ষর করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। জানা গেছে, সামীম আফজালের কাছে ফতোয়া পাঠানোই হয়নি। তবে বায়তুল মোকাররমের ইমামরা স্বাক্ষর করেছেন। এ নিয়ে জানতে চেয়ে মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মুহিব্বুল্লাহিল বাকী বলেছেন, আমরা স্বাক্ষর করেছি। নিজস্ব মতামত দিয়েছি। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে আজকে প্রত্যেক মুসলমানকেই জাগতে হবে। কাজ করতে হবে। সামীম আফজালকে ফোন করা হলে তার সেলফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার একান্ত সচিব মোঃ দেলোয়ার হোসেন জানান, ডিজি শারীরিক অসুস্থতার কারণে সিঙ্গাপুর রয়েছেন। আর তিনি স্বাক্ষর করেছেন কিনা জানা নেই। লাখো আলেমের ফতোয়ায় স্বাক্ষর করতে পারেননি বায়তুল মোকাররমের খতিব অধ্যাপক মাওলানা মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন। তিনি প্রায় তিন মাস ধরে জটিল রোগে আক্রান্ত আছেন। তার অসুস্থতার কথা জানান মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদও।
×