ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ মনে করছে এটা সাঁড়াশি অভিযানের সাফল্য;###;সন্ত্রাসীরা ধরা পড়ার ভয়ে এ অস্ত্র ওই খালে ফেলে দেয়

উত্তরায় জঙ্গী অস্ত্রাগার ॥ খাল থেকে স্মরণকালের সর্বাধিক অস্ত্র উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৯ জুন ২০১৬

উত্তরায় জঙ্গী অস্ত্রাগার ॥ খাল থেকে স্মরণকালের সর্বাধিক অস্ত্র উদ্ধার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ খোদ রাজধানী থেকে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় অস্ত্রগোলাবারুদের চালান ধরা পড়েছে। ইতোপূর্বে এর দশভাগের একভাগ অস্ত্রগোলারুদও উদ্ধারের ঘটনা ঘটেনি। এমন ঘটনায় দেশ-বিদেশে হৈচৈ পড়ে গেছে। নড়েচড়ে বসেছে সরকার। উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদগুলো চীনের তৈরি বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এসব অস্ত্রগোলাবারুদ একেবারেই নতুন। বিশাল এই অস্ত্রের চালানের সঙ্গে দেশী-বিদেশী বড় ধরনের একাধিক চক্র জড়িত রয়েছে বলে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালাতেই অস্ত্রগোলাবারুদগুলো মজুদ করা হয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি। জঙ্গীদের ব্যবহার করা অস্ত্রের সঙ্গে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের হুবহু মিল রয়েছে। এজন্য অস্ত্রগোলাবারুদগুলো জঙ্গীদের বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। শনিবার রাতভর অভিযান চলবে। রবিবারও অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস জানায়। রাজধানীর তুরাগ থানাধীন উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের শেষপ্রান্তে মিরপুর আশুলিয়া বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বৌদ্ধ মন্দিরের কাছে দিয়াবাড়ি খালের কিনারে থাকা ঝোপঝাড় থেকে অস্ত্রগোলাবারুদগুলো উদ্ধার হয়। এলাকাটিতে প্লট উন্নয়নের কাজ চলছে। সেখানে বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানির অফিস রয়েছে। সেখাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার সূত্রপাত দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে। একটি কালো বিলাসবহুল পাজেরো গাড়ি প্লটের ভেতর দিয়ে তৈরি করা পাকা রাস্তা ধরে উত্তরার দিক থেকে সোজা বেড়িবাঁধের কাছে চলে যায়। যাওয়ার পর গাড়ি থেকে কয়েকজন মিলে বড় বড় আটটি ট্রাভেল ব্যাগ দ্রুত ঝোপের মধ্যে ফেলে এবং পরই গাড়িটি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। গাড়িটি চলে যাওয়ার পর স্থানীয়দের সন্দেহ হয়। তাদের ধারণা কয়েকটি ব্যাগে লাশ ফেলা হয়ে থাকতে পারে। তারা বিষয়টি তুরাগ থানা পুলিশকে জানায়। তুরাগ থানা পুলিশ দ্রুত উর্ধতন কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে জায়গাটি নির্ধারণ করে। এদিকে ঝোপের ভেতরে কোন ব্যাগ না পেয়ে হতভম্ব হয়ে যায় পুলিশ। এ সময় পুলিশের ধারণা হয়, ব্যাগগুলো ঝোপ লাগোয়া খালের পানিতে ডুবে যেতে পারে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের একাধিক টিম ঘটনাস্থলে হাজির হয়। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) একেএম শাকিল নেওয়াজ জানান, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা প্লাস্টিক বোট নিয়ে খালের পানিতে নেমে পড়ে। সেখানে ছয়টি সার্চ লাইট জ্বালিয়ে তল্লাশি শুরু হয়। তল্লাশির এক পর্যায়ে একের পর এক উদ্ধার হতে থাকে ট্রাভেল ব্যাগ। আর ব্যাগ খুলতেই সবার চোখ ছানাবড়া। এমন খবরে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ, র‌্যাব, আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন পুরো এলাকাটি কর্ডন করে ফেলে। পুরো এলাকায় আলোকিত করে রাত দশটা পর্যন্ত অভিযান চলে। অভিযানে খাল থেকে উদ্ধার হয় আটটি বড় সাইজের ট্রাভেল ব্যাগ। আর সেই ব্যাগগুলোর ভেতরে ছোট বড় ১০৪টি বাক্স উদ্ধার হয়। এসব ব্যাগ ডাঙ্গায় তোলা হয়। একে একে খোলা হয় সেই বাক্সগুলো। বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে অস্ত্রগোলাবারুদ। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, রাতভর অভিযান চলবে। রবিবারও অভিযান পরিচালিত হবে। এরপরই অস্ত্রগোলাবারুদ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট জানানো সম্ভব হবে। ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার বিধান ত্রিপুরা জানান, সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। সেই অভিযানের ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অস্ত্রগোলাবারুদগুলো উদ্ধার হয়। উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদের মধ্যে চীনের তৈরি সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের ৯৫ পিস্তল রয়েছে। এসব পিস্তলের ২২০ রাউন্ড তাজা বুলেট উদ্ধার হয়েছে। আর পিস্তলগুলোর ১৮৯ ম্যাগজিন উদ্ধার হয়েছে। এছাড়া দুটি নাইন এমএম পিস্তল উদ্ধার হয়েছে। নাইন এমএম পিস্তলের ৮৪০ রাউন্ড তাজা বুলেট উদ্ধার হয়েছে। এছাড়া দশটি বেয়োনেট উদ্ধার হয়েছে। সেগুলো সাধারণত বিষাক্ত। এগুলো রাইফেলের সামনে লাগানো থাকে। কোন সময় রাইফেলের গুলি শেষ হয়ে গেলে বেয়োনেট নিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বা হত্যা করতেই এগুলো ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়া এসএমজির (স্মল মেশিন গান) ২৬৩ ম্যাগজিন উদ্ধার হয়েছে। জনকণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, অস্ত্রগোলাবারুদগুলো একেবারেই নতুন। ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালাতেই অস্ত্রগোলাবারুদগুলো মজুদ করা হয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এরসঙ্গে দেশী ও আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ ইতোপূর্বে ঢাকায় কোন সময়ই এ ধরনের অস্ত্রগোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেনি। কোন প্রকার চেকপোস্টে গাড়িটির তল্লাশির কবলে পড়া না পড়া নিয়েও রহস্য রয়েছে। এ বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান চলছে। আপাতত পুরো এলাকা কর্ডন করে অভিযান চলছে। অভিযান শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ধারণা করা হচ্ছে এ ধরনের অস্ত্রগোলাবারুদের চালান আরও ঢাকায় প্রবেশ করতে পারে। কারণ অস্ত্রগোলাবারুদ সাধারণত আলাদা আলাদা চালানে এসে থাকে। কোন চালানে শুধু অস্ত্র আসে। আবার অন্য চালানে গোলাবারুদ আসে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এসএমজির ২৬৩ ম্যাগজিন পাওয়া গেলেও কোন এলএমজি বা এলএমজির বুলেট পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, হয় এসএমজি ও বুলেট আগে এসেছে, অথবা পরের চালানে আসার কথা রয়েছে। অস্ত্রের চালানটি সমুদ্র বন্দর দিয়ে না আসার সম্ভাবনা বেশি। তারপরও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। অস্ত্রের চালানটি বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান স্থল সীমান্ত হয়ে আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, অস্ত্রের চালানটি নিষিদ্ধ কোন জঙ্গী সংগঠনের। দেশব্যাপী মারাত্মক গুপ্তহত্যা চালাতেই এবং জঙ্গীরা ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালাতেই অস্ত্রের চালানটি আনতে পারে। তবে এরসঙ্গে দেশী ও আন্তর্জাতিক এক বা একাধিক চক্রের যোগসূত্র থাকার বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, উদ্ধারকৃত এ ধরনের অস্ত্রগোলাবারুদ সাধারণত নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা ব্যবহার করে থাকে। সম্প্রতি কলাবাগানে জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু তনয় হত্যায়ও জঙ্গীরা চাপাতির পাশাপাশি সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ বোরের পিস্তল ব্যবহার করেছে। জঙ্গীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা একটি ব্যাগ থেকে অস্ত্রটি পাওয়া যায়। ইতোপূর্বে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও দাবি করেছে জঙ্গীরা চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সীমান্তবর্তী বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অস্ত্রগোলাবারুদ সংগ্রহ করে থাকে। এছাড়া বেয়োনেট একমাত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সদস্যদেরই ব্যবহার করতে দেখা যায়। এটিকে জেএমবি কমান্ডো নাইফ (গেরিলা চাকু) বলে থাকে। জঙ্গীদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে উত্তরা থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদের মিল রয়েছে। এজন্য তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা অস্ত্রগোলাবারুদগুলো জঙ্গীদের হওয়া বিচিত্র নয়। তবে এর পেছনের কুশীলব কারা সে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। সূত্র বলছে, উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদগুলো অন্যকোন গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করতেই ওই জায়গায় রাখা হয়ে থাকতে পারে। ওই এলাকায় সন্ধ্যার পর পুলিশ ও র‌্যাব কড়া চেক করে। দিনের বেলায় তেমন চেকিং হয় না। এমন সুযোগ কাজে লাগায় অস্ত্রের চালানের সঙ্গে জড়িতরা। এজন্য তারা দিনের বেলায় গিয়ে অস্ত্রের চালানটি হস্তান্তর করতেই সেখানে ব্যাগগুলো খালসংলগ্ন ঘন ঝোপের ভেতরে ফেলে রাখে।
×