ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ তারুণ্যের ডিজিটাল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১৯ জুন ২০১৬

একুশ শতক ॥ তারুণ্যের ডিজিটাল বাংলাদেশ

বাংলাদেশের সফটওয়্যার ও সেবা খাতের পথ চলা অনেক দিনের। সেই ৬৪ সালে দেশে যখন প্রথম কম্পিউটার আসে তখন থেকেই আমরা সফটওয়্যার বানাই। পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে পারি নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামের মোঃ হানিফ উদ্দিন মিয়ার কথা- যিনি কেবল আমাদের নয়, দক্ষিণ এশিয়ারই প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। তার পথ ধরে এদেশে সফটওয়্যার খাতের যে উদ্ভব সেটি আজ পত্রপুষ্পে পল্লবিত হয়ে হাজার হাজার তারুণ্যদীপ্ত মানুষের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শিল্পে ১৯৮৭ সালে ফন্ট বানিয়ে যে পথের প্রথম সিঁড়িতে পা দিয়েছিলাম তার প্রথম মেধাপণ্য ছিল বিজয় বাংলা সফটওয়্যার। মাত্র তিন কিলোবাইট আকারের সেই সফটওয়্যার আজ আমাকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে পরিচিত করেছে। সেই থেকে আমিও অংশ হয়ে গেছি দেশের অতি দ্রুত বিকাশমান সফটওয়্যার ও সেবা খাতের সঙ্গে। শয়নে-স্বপনে তথ্যপ্রযুক্তি আমার শিরা-উপশিরায়। এই পথ চলায় আমার সাম্প্রতিক উপলব্ধি এক অসাধারণ স্বপ্ন পূরণের গল্প তৈরি করেছে। শুরু করা যাক কয়েকটি গল্প দিয়ে। ক. এই গল্পটার শিরোনাম হতে পারে- ‘আমাদের আরও অনেক ফারহানা চাই।’ বেসিস বোর্ডে নির্বাচিত হওয়ার সুবাদে ফারহানাকে অনেক আগে থেকেই চিনতাম। সচরাচর আমরা মেয়েদের কাজের দুনিয়াতে কম পাই। লেখাপড়ায় ওদের সংখ্যা অনেক বাড়লেও কাজ করে সফল হওয়ার জায়গাটাতে আমরা খুব কম মানুষকেই দেখতে পাই। এবার যখন বেসিস নির্বাচনে ফারহানার সঙ্গে মোট নয়জনের একটা প্যানেল করে নির্বাচন করি তখন আরও ভালো করে চেনা হলো তাকে। জীবনে প্রথমবারের মতো ওর অফিসও দেখেছি। ওর অফিস, ওর ব্যবস্থাপনা এবং কাজ করার পদ্ধতি আমাকে মুগ্ধ করেছে। কর্পোরেট নামক একটি পত্রিকায় ফারহানা সম্পর্কে লিখেছেÑ “সফটওয়্যার খাতে নিজস্ব মেধাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার উদ্দেশ্যে ২০০৩ সালে ফারহানা এ রহমান নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন ইউওয়াই সফটওয়্যার কোম্পানি। সে সময় সফটওয়্যারে নারী উদ্যোক্তা ছিলেন যৎসামান্য। সন্তানের দেখাশোনা আর এমন এক চ্যালেঞ্জিং পেশায় সকল বৈরিতাকে হার মানিয়ে সামনে এগিয়েছেন। মূলত সফটওয়্যার ডেভেলপ, আউটসোর্সিং ওয়েবসহ বিভিন্ন কাজে ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে তার প্রতিষ্ঠানসহ বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছেন। মাত্র একজন কর্মী দিয়ে নিজের বাসার ড্রয়িংরুমে যাত্রা শুরু করা ইউওয়াই সিস্টেমস এখন একশ’র বেশি মানুষের পরিবার। তবে শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না বলে জানালেন ফরহানা রহমান। তিনি বলেন, ‘আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করি ২০০৩ সাল থেকে। তখন ছোট ছোট কাজ করতাম। নিজের দক্ষতা ও সক্ষমতা বোঝার জন্য বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করি। শুরুতে অফিসটা আমার বাসায় ছিল। তখন আউটসোর্সিংয়ে ভারত খুব ভালো করা শুরু করে। ভারতের কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে এই ব্যবসা সম্পর্কে জানি। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে অনেক কিছু করা যায় এবং অনেক দূর এগোনো যায়- এই গল্পগুলো শুনতাম। পরে গ্রাফিক্স এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্টের ওপর কিছু প্রশিক্ষণ নিয়ে এই ব্যবসায় নামি। এরপর ২০০৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। একটা কাজের কত মূল্য নির্ধারণ করলে আরও কাজ পাওয়া যাবে এসবই করে করে শিখতে হয়েছে। শুরুতে একটি আমেরিকান প্রতিষ্ঠানের কাজ পাই। এরপর আস্তে আস্তে কাজের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং প্রতিষ্ঠানের কলেবরও বৃদ্ধি পায়। ইউওয়াই সিস্টেমস লিমিটেড এরই মধ্যে গুণগতমানের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছে আইএসও ৯০০১-২০০৮ সনদ।’ এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, এই সময় থেকে আমি ওয়েবনির্ভর সেবা নিয়ে ইউরোপিয়ান মার্কেটে কাজ করছি। এছাড়া আমরা সফটওয়ার ডেভেলপমেন্টেও কাজ করি। সফটওয়্যার রফতানি বা আউটসোর্সিংয়ের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নিজের সাম্প্রতিক কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখন রেসপন্সিভ ওয়েবের জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে সবকিছু এখন মোবাইলকেন্দ্রিক করার চেষ্টা চলছে। বিদেশে আমরা সাড়ে তিন হাজার ই-কমার্স ওয়েবসাইট করে দিয়েছি। এছাড়া ইউরোপের ৭ হাজার ওয়েবসাইটকে আমরা রেসপন্সিভ করেছি।’ ভ্যাট ব্যবস্থাপনা সফটওয়ারে বাংলাদেশে পথ প্রদর্শক ফারহানা রহমানের প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, ‘ভ্যাট দিয়ে থাকে ক্রেতা বা সেবা গ্রহীতা। যে কোন প্রতিষ্ঠানের এই ভ্যাট ব্যবস্থাপনায় একজন অপারেটর কিংবা পরামর্শক রাখতে হয়। সফটওয়ারের মাধ্যমে যে কোন প্রতিষ্ঠান বাড়তি জনবল ছাড়া সহজেই তার ভ্যাট ব্যবস্থাপনা করতে পারে। আমাদের ইউওয়াই ভিএমএস (ভ্যাট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়ার) দেশের ছোট-বড় কোম্পানি, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভ্যাটের আওতায় আনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা সফটওয়ার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছিল। যে পাঁচটি কোম্পানির সফটওয়ার এনবিআরের তালিকাভুক্ত তার মধ্যে অন্যতম ইউওয়াইভিএমএস। ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে এসব সফটওয়ার ব্যবহার বাড়বে। হেলথ প্রায়োর নামে একটি পোর্টালের কর্ণধার বেসিসের এই সাবেক সহ-সভাপতি। তিনি বলেন, ‘এখনো এই সেবার বাজারে চাহিদা দেখছি। কিন্তু কিছু নীতিগত সমস্যা রয়েছে। এই পোর্টালের মাধ্যমে আমাদের দেশের রোগীরা ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। বিভিন্ন সমস্যার চিকিৎসায় কোথায় সুচিকিৎসা আছে সে সম্পর্কেও সহায়ক আমাদের ওয়েবসাইট।’ আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এ খাতে বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে। এর কারণ জানতে চাইলে ফারহানা রহমান বলেন, ‘এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা আমাদের মানসম্মত দক্ষ জনবল নেই। প্রশিক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিকমানের স্বীকৃত কোন ইনস্টিটিউট নেই। বিশ্বের বড় কোন প্রতিষ্ঠান বড় কাজের প্রতিশ্রুতি দিলেও আমরা তা করতে পারছি না। সাত হাজার ওয়েবসাইট করতে আমার নিজের প্রতিষ্ঠানেই একটি ট্রেনিং সেন্টার খুলে ফেলতে হয়েছে। কারণ, একই কোয়ালিটির মানুষ বাজারে নেই। অথচ ফিলিপাইনে একটি কোম্পানি হাজার হাজার দক্ষ মানুষ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের ইনস্টিটিউট থেকে যে জনবল বের হচ্ছে তাদের দক্ষতা প্রায় সমপর্যায়ের। তাদের নিয়ে এসে কাজে বসিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমাদের এখানে তা কল্পনাও করা যায় না।’ ব্যবসায়িক কর্মকা-ের পাশাপাশি দেশের সফটওয়্যার শিল্প ব্যবসার উন্নয়নে যোগ দিয়েছেন বেসিসে। ২০১০ সালে বেসিসের প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন ফারহানা। আগামী ২৫ জুন অনুষ্ঠিতব্য বেসিস নির্বাচনে পরিচালক হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি। বেসিস নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে ফারহানা রহমান বলেন, ‘আমি গত ১০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বেসিসের ইন্টারন্যাশনাল মার্কেট বিষয়ক কমিটিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। এজন্য আমাদের দেশের ছোট ছোট কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে উপস্থাপন করবে। কিভাবে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও ব্র্যান্ডিং করবে সে বিষয়ে আমি বেসিসকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চাই। স্থানীয় বাজারেও অনেক কাজের জায়গা আছে। কোন কোন এ্যাকাউন্টিং কিংবা ইআরপি সফটওয়ার প্রয়োজন হলে কোন্ কোম্পানি কোথায় পাবে তা অনেকেই জানেন না। বেসিসের ওয়েবসাইটেও কে কি করে সেই ক্যাটাগরি অনুযায়ী পাওয়া যায় না। স্থানীয় বাজারের জন্য সেই সংযোগ তৈরি করতে চাই।’ তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীদের আগ্রহী করা, সেইসঙ্গে সহযোগিতার মানসে ফারহানা যোগ দেন বাংলাদেশ উইমেন ইন আইটি বা বিডব্লিউআইটিতে। সহসভাপতি হিসেবে কাজ করছেন প্রযুক্তি খাতে নারী উন্নয়নে। এছাড়াও সামাজিক দায়িত্ব পালনে সাধারণ সম্পাদক যুক্ত আছেন অটিজম শিশু কল্যাণ সমিতির সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি সেবায় নিয়ে আসতে সাপোর্ট সার্ভিস তৈরি করার ইচ্ছা আছে আমার। বেসিসের উইমেন ফোরামকে শক্তিশালী করা আমার লক্ষ্য। অর্টিজমের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কিভাবে কাজ করতে পারে সে বিষয়েও আমি কিছু করতে চাই।’ খ. ‘মুরগিওয়ালা থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তিবিদ’ এটাই এই অংশটির শিরোনাম হতে পারে। “আপনার মনে থাকার কথা নয়। আমি তখন মুরগিওয়ালা। গাজীপুরে আমার একটি মুরগির খামার ছিল। টিভিতে আপনার ‘কম্পিউটার’ অনুষ্ঠান দেখি। মনে মনে ভাবি- এই যন্ত্র দিয়ে কি হয়। একদিন টিকেট কেটে চলে এলাম কম্পিউটারের এক মেলায়। সেখানেই জীবনের প্রথম কম্পিউটার দেখলাম। আপনি অনেক সময় নিয়ে যন্ত্রটি দেখালেন। বোঝালেন যন্ত্রটি দিয়ে কি কাজ কেমনভাবে করা যায়। আপনি তখন প্রকাশনার জগত নিয়ে বেশি ব্যস্ত। আপনার ছেলে বিজয় সেই সময় অনেক ছোট। আপনি বিজয়কে কম্পিউটারটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, দেখ, এই শিশুটি কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে- তুমি কেন পারবে না। আমারও তাই মনে হলো- আমি কেন পারব না। টিকেট কেটে কম্পিউটার দেখার সেই ঘটনার পর গড়ে ওঠে এক অসাধারণ ইতিহাস। একটা টিকেট আমার জীবন বদলে দেয়। আমি কম্পিউটারের জগতে প্রবেশ করি। যেহেতু মুরগির খামারের ব্যবসা করি, সেহেতু এর সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তিকে কেমন করে ব্যবহার করা যায় সেটিই ভাবলাম। দিন দিন কৃষির সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির যোগসূত্র স্থাপন করি।” কথাগুলো বললেন ঢাকার বারিধারার এল২এন-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম রাশেদুল ইসলাম। রাশেদুলের অফিসে এখন প্রায় ২৫ জন প্রোগ্রামার কাজ করেন কৃষির তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে। অন্যদিকে প্রায় সমসংখ্যক লোক কাজ করেন মাঠে এর প্রয়োগ করতে। আমি তার কাছে কৃষির ইআরপির কথা শুনে বিস্মিত হয়েছি। অনেকেই বিস্মিত হতে পারেন। রাশেদুল মনে করেন, কৃষির যে শক্ত ভিতটা আমাদের আছে তথ্যপ্রযুক্তি তাকে বহুগুণ সম্প্রসারিত করতে পারে। তার সর্বশেষ উদ্ভাবন ছাদের বাগান। আমি জানতে চেয়েছিলাম ছাদের ওপর বাগান বানাতে আইসিটি কি করতে পারে। রাশেদুল হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছে, স্যার আপনি তো জানেন অন্য কলকারখানা বা ব্যবসা-বাণিজ্যে যা করা যায় তার চাইতে বেশি কিছু কৃষিতে করা যায়। যদিও জাতীয় আয়ের শতকরা মাত্র ১৬ ভাগ আমরা কৃষিখাত থেকে পাই, তথাপি জনসংখ্যার শতকরা ৬৫ ভাগ মানুষ কৃষিতে যুক্ত। আমরা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি তখন এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে সেটি হতে পারে না। আমাদের নীতিনির্ধারণী মানুষেরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য অনেক কাজ করছেন। সরকার ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার গড়ে তুলেছেন। আমি দাবি করছি এসব ডিজিটাল সেন্টারের সঙ্গে রাশেদুলদের উদ্ভাবিত পণ্য সম্পৃক্ত করা হোক। আমার শত সহস্র শুভ কামনা রাশেদুলের জন্য। রাশেদুলরাই বাংলাদেশের সফটওয়্যার ও শিল্পখাতের প্রাণ। ওরাই গড়বে ডিজিটাল বাংলাদেশ। আসুন রাশেদুলদের পাশে থাকি। ঢাকা, ১৭ জুন, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] w.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×