ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফল প্রদর্শনীতে বিভিন্ন জাতের আমের জয়জয়কার

বউ ভুলানী, মোহন বাঁশি রানী পছন্দ... মন মাতানো সুঘ্রাণ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৮ জুন ২০১৬

বউ ভুলানী, মোহন বাঁশি রানী পছন্দ... মন মাতানো সুঘ্রাণ

আনোয়ার রোজেন ॥ চোখে-মুখে সত্যিকার কৌতুহলের ভাব ফুটিয়েই প্রশ্নটা করলেন ভদ্রলোকÑ আচ্ছা, এইটাতে সত্যিই কী বউয়ের মন ভুলানো যায়! লম্বা টেবিলের ওপাশে বসা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মী স্মিত হেসে জবাব দিলেন, শহুরে গিন্নিদের মন ভুলে কিনা জানি না; তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেয়ে-বউদের মন বোধহয় ভুলানো যায়। তা না হলে আমের নাম ‘বউ ভুলানী’ হবে কেন? পাল্টা প্রশ্নের উত্তরের আর প্রয়োজন পড়েনি। ভদ্রলোক বুঝে গেছেন, ‘বউ ভুলানী’ আমের জাতটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের। ‘বউ ভুলানীর’ মতো বাহারি নামের আরও প্রায় ৮০ জাতের আমের দেখা মিলছে রাজধানীর খামারবাড়ির আ. কা. মু. গিয়াস উদ্দীন মিলকী অডিটরিয়াম চত্বরে। ফলদ বৃক্ষরোপণ পক্ষ ও জাতীয় ফল প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে এখানে দেশীয় বিভিন্ন ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। মধুমাস জ্যৈষ্ঠ আর বৃষ্টির মাস আষাঢ়ের সন্ধিক্ষণ বলে চত্বরজুড়ে আমের জয়জয়কারই বেশি। তবে আম ছাড়াও জাম, জামরুল, কলা, কাঁঠাল, বেল, বেদানা, পেঁপে, পেয়ারাসহ আরও ১২৯ প্রজাতির ফলের একাধিক জাত ম ম সুবাস ছড়াচ্ছে চত্বরের ৭৫টি স্টলে। প্রতিবছরই কৃষি মন্ত্রণালয় দেশব্যাপী ফলদ বৃক্ষরোপণ পক্ষ (১৬-৩০ জুন) এবং জাতীয় ফল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। পুষ্টি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দেশকে ফল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করাই এ পক্ষের উদ্দেশ্য। এর অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার থেকে খামারবাড়িতে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী জাতীয় ফল প্রদর্শনী। শুধু ফলের সম্ভার দেখা নয়, আছে রাসায়নিকমুক্ত বিভিন্ন জাতের ফল কেনারও সুযোগ। তাই তো প্রথম দিন উদ্বোধনের পর থেকেই ফলের মেলা জমজমাট। ছুটির দিন শুক্রবারও ফলের এই মৌতাতে মেতেছেন হাজারও মানুষ। মেলায় অঞ্চলভেদে বিভিন্ন ফলের পৃথক স্টল রয়েছে। উত্তরাঞ্চলের ফল, ভাওয়াল ও মধুপুর গড় অঞ্চলের ফল, উপকূলীয় অঞ্চলের ফল, পাহাড়ি অঞ্চলের ফল ইত্যাদি ভাগে ফলের পসরা সাজিয়েছে স্টলগুলো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ছাড়াও সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ৭৫টি স্টল বসেছে মেলায়। মেলা ঘুরে দেখা গেল, বেশিরভাগ স্টলেই আমের একচ্ছত্র দাপট। কয়েকটি স্টলে পেয়ারা, জাম, লটকন, আনারস, প্রক্রিয়াজাত মধু প্রভৃতির প্রদর্শনী ও বিক্রি চলছে। বিভিন্ন জাতের ফলের গাছ রোপণ, পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সংক্রান্ত তথ্যাদির পুস্তিকা ও লিফলেট দিয়ে স্টল সাজিয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। প্রদর্শনীর মূল থিমের সঙ্গে মিল রেখে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় বিভিন্ন ফলের নমুনা প্রদর্শন ও তথ্য সরবরাহেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে। মেলার প্রবেশপথে ঢুকতেই নাকে আসবে বিভিন্ন ফলের মন মাতানো সুঘ্রাণ। একটু এগিয়ে ডানদিকে আমের স্টল। ৮-১০টি স্টলের প্রতিটিতেই হরেক জাতের আমের প্রদর্শনীর পাশাপাশি চলছে বিক্রি-বাট্টা। আম্রপালি, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর, হাড়িভাঙ্গা প্রভৃতি জাতের আম কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০-১০০ টাকায়। সব স্টলেই ক্রেতা-দর্শনার্থীর ভিড়। তবে খাগড়াছড়ির গ্রীন টাচ এগ্রো ফার্মের স্টলের সামনে ভিড়টা যেন একটু বেশিই। ভিড়ের কারণÑ কলার মতো দেখতে ‘ব্যানানা ম্যাঙ্গো’। আকৃতির জন্য মাহালিশা/বাউ আম-১৪ জাতের আমটি এ নামেই পরিচিত হয়ে গেছে। অন্যান্য জাতের আমের চেয়ে এই আম একটু বেশিই মিষ্টি। তাই দামও বেশি। কেজিপ্রতি ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ব্যানানা ম্যাঙ্গো। এই স্টলের কর্মী মেহেদী হাসান জানালেন, খাগড়াছড়ি সদরের মাস্টারপাড়ায় তাদের ৪০ একর আয়তনের নিজস্ব বাগান রয়েছে। তার বাবা ২০১৩ সালে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যানানা ম্যাঙ্গোর ১০টি চারা কিনে নিয়ে আসেন এবং পরবর্তীতে এই আমের উচ্চফলনশীল গাছগুলো থেকে কলম করে গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। বর্তমানে তাদের বাগানে প্রায় ৪৫০টি ব্যানানা ম্যাঙ্গো জাতের আমগাছ আছে। বাগান থেকে আম তুলে এনে সরাসরি বাজারজাত করার কাজটিও তারা নিজেরাই করেন। ত্রিপলের নিচে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের স্টলের লম্বা টেবিলজুড়ে সাজানো রয়েছে নানা জাতের আমের নমুনা। এসব আমের নামও বাহারিÑ বউ ভুলানী, মাদ্রাজী তোতা, মোহনবাঁশি, তোতাপুরী, আড়িয়া, কুমড়া জালি, কোহিতুর, নাক ফজলী, মিছরি কান্ত, আশ্বিনা, আনোয়ারা, কালিভোগ, ক্ষিরসাপাতি, রানীপছন্দ, মিছরি দানা, গোলগুটি, দাইমানগুটি, সুবর্ণরেখা, কালুয়া, খাসিভোগ, সিন্দরী, দুধসর, দশেরী, মল্লিকা, জালিবাঁধা, মাধবীলতা প্রভৃতি। এই স্টলে দর্শনার্থীদের দৃষ্টি কেড়েছে ‘ব্রুনাই কিং’। উৎসদেশ ব্রুনাইয়ের এ আমের কয়েকটি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে মাগুরা হর্টিকালচার সেন্টার থেকে। একেকটি ব্রুনাই কিংয়ের ওজন তিন কেজি! জানা গেল, পরিপক্ব ব্রুনাই কিংয়ের প্রতিটির গড় ওজন হয় ৪-৫ কেজি! পাকার সময় আগস্ট মাস। আকারে বড় হলেও এটির খোসা পাতলা ও আঁটি ছোট হয়। এই স্টলের পাশেই বিক্রি হচ্ছে ভিয়েতনাম থেকে সরকারীভাবে আমদানি করা উন্নতমানের উচ্চ ফলনশীল খাটো জাতের নারিকেল চারা। প্রতিটি চারার মূল্য ৫০০ টাকা। সঙ্গে থাকছে রোপণ ও পরিচর্যা বিষয়ে লিখিত নির্দেশনা। চারা কেনার জন্য রীতিমতো লাইন ধরে বুকিং দিচ্ছেন অনেকে। জানা গেল, এ জাতের নারিকেল চারা রোপণের তিন বছরের মধ্যেই ফুল-ফল দিতে সক্ষম। গাছে বছরে ২০০টা নারিকেল ধরে। গাছ খাটো হওয়ায় নারিকেল ঝুলে থাকে মাটির কাছাকাছি। দেশীয় নারিকেলের তুলনায় এ নারিকেলে শাঁস বেশি হয়, ডাবে পানিও বেশি থাকে। অডিটরিয়াম চত্বরের সামনে স্টল সাজিয়েছে লাইফ টাচ আইডিয়াস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। স্টলে কোন ফলের নমুনা নেই, আছে গোটা একটি বাগানের নমুনা! প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক মোঃ আলহাজ হোসেন জানান, বিষমুক্ত ও আসল স্বাদের জন্য দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ এবং ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় তারা গড়ে তুলেছেন বিশাল আম ও লিচু বাগান। প্রতিটি বাগান ৩ কাঠা আয়তনের অনেক ইউনিটে বিভক্ত। নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে যে কেউ চাইলে হয়ে যেতে পারেন একখ- বাগানের মালিক। রয়েছে পছন্দের ফলগাছ চাষের ব্যবস্থাও। ফলের মতো মেলায় আগত দর্শণার্থীদের মধ্যেও দেখা মিলল বৈচিত্রের। শিশু, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, বেকার তরুণ, চাকরিজীবী, শখের কৃষিবিদ, বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণী-পেশার মানুষ এসেছেন ফলের মেলায়। কেউ এসেছেন বিষমুক্ত ফল ও চারাগাছ কিনতে, কেউ বা এসেছেন পোকায় ধরা গাছের নিরাময় সম্পর্কে জানতে। কেউ কেউ আবার সপরিবারে এসেছেন প্রদর্শনী দেখতে ও ছোটদের ফল চেনাতে। মোহাম্মদ সাইদুর রহমান তেমনই একজন। স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে মেলায় এসেছেন একটি বেসরকারী ব্যাংকের এই কর্মকর্তা। ত্রিপলের নিচে বিভিন্ন জাতের ফল দিয়ে সাজানো স্তম্ভ ও চারা গাছের বেষ্টনীর চারদিক ঘুরিয়ে সন্তানদের ডালিম, কামরাঙ্গা, ডেউফল, গাব, বেদানা, জলপাই, তেঁতুল, তাল, খেজুর, বেল, বাতাবি লেবু, চালতা প্রভৃতি ফল চেনাচ্ছেন এই বাবা। তিনি বললেন, সন্তানদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। গ্রামে যাওয়া হয় না। গাছে ঝুলন্ত ফল তারা কখনও চোখে দেখেনি। মেলায় এত ফলের সমাহার দেখে সন্তানদের আনন্দ যেন বাঁধ ভেঙ্গেছে। সত্যিই তাই। শিশুর সারল্য নিয়ে সাজানো ফলের সঙ্গে অনেক প্রাপ্তবয়স্কের সেলফি তোলার হিড়িকও সেটাই প্রমাণ করে। ফলের সমাহারের এই উন্মুক্ত প্রদর্শনী চলবে আজ শনিবার রাত আটটা পর্যন্ত।
×