ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে ফেরার অপেক্ষায় কয়েক শ’ নারী

মানবেতর জীবন ॥ সৌদিতে নারী শ্রমিক

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৮ জুন ২০১৬

মানবেতর জীবন ॥ সৌদিতে নারী শ্রমিক

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বিদেশ নামের সোনার হরিণ ধরার জন্য বাংলাদেশী দালালদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সৌদি আরবে শত শত নারীশ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ইতোমধ্যে অনেক নারীশ্রমিক দেশে ফিরে এলেও সৌদির জেদ্দা ও দামমাম শহরে দালালদের অফিসে দেশে ফেরার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষার প্রহর গুনছেন কয়েক শ’ নারী। ওই শ্রমিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য এখন দালাল চক্র পরিবারের সদস্যদের কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্রমতে, সৌদি আরবে বাংলাদেশীদের জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে। দুই লাখ নারীশ্রমিক নেবে দেশটি। তাদের সঙ্গে নিকটাত্মীয় একজন করে পুরুষও (স্বামী বা ভাই) যেতে পারবে। শ্রমিক হিসেবে বিনা খরচে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যাবে এসব নারীশ্রমিক। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা পাঁচ লাখেও ঠেকতে পারে। সম্প্রতি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এ ঘোষণার পর কৌশলে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর দালাল দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে গ্রামের সহজসরল নারীদের ভাল বেতনে সৌদি আরবে পাঠানোর নামে মাঠে নেমে পড়ে। তারা বিভিন্ন প্রলোভনে ফুঁসলিয়ে পাসপোর্টসহ ঢাকায় এক মাসের প্রশিক্ষণের নামে ওই সব নারীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের সপরিবারে সৌদি আরবে পাঠানোর নামে এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে নারীদের সৌদিতে পাঠাতে শুরু করে। সেখানে গিয়েই বিপাকে পড়তে হচ্ছে নারী শ্রমিকদের। দালালদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে গত ৭ জুন দেশে ফিরে আসেন বরিশালের গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের কমলাপুর গ্রামের দিনমজুর সুলতান খানের মেয়ে ঝুমুর। ঝুমুর জানান, আদনান চৌধুরীর মালিকানাধীন ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার রোড নং-১২/এ, হাউজ নং-৬৬/৪, আকুরা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের ট্রাভেলস্রে অফিস সহকারী গৌরনদীর কাছেমাবাদ গ্রামের আসাদুল ইসলাম আসাদের প্রলোভনে গত ১৮ মে তিনি সৌদি আরবে যান। সৌদির জেদ্দা এয়ারপোর্ট থেকে তাকেসহ এক ফ্লাইটের ১০ নারীকে সেখানকার মেঘা কোম্পানির কর্মীরা তাদের অফিসে নিয়ে যায়। ওই অফিসে তাদের আট দিন ভাষার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাদের সবাইকে একটি রুমে রেখে গরুর হাটের মতো বিভিন্ন লোকজনে (সৌদিয়ান) দেখতে এসে পছন্দ করে বাসায় নিয়ে যায়। ঝুমুর আরও জানান, তাকে পাশাপাশি দুটি বাড়ির গৃহকর্মীর কাজ দেয়া হলেও ঠিকভাবে খাবার ও গোসল করতে দেয়া হতো না। রাতে ঘুমানোর জন্য কোন রুম দেয়া হয়নি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঝুমুর বলেন, পাঁচ দিন ওই দুই বাড়িতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও পেট ভরে খেতে পারিনি, গোসল করতে পারিনি, রাতে সোফার ওপর ঘুমিয়েছি। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কোম্পানির লোকজনকে জানিয়ে তাদের জেদ্দার অফিসে চলে আসি। পরবর্তীতে অনেক দেন-দরবার করে চলতি মাসের ৭ জুন আমিসহ সিলেট, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, রাজবাড়ী ও বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের আট নারী দেশে ফেরত এসেছি। ক্ষোভ প্রকাশ করে ঝুমুর বলেন, প্রতারক দালালদের প্রলোভনে পড়ে আমার মতো আর যেন কোন নারী সৌদি আরবে না যান। তিনি বলেন, এখনও শত শত নারী প্রতারক দালালদের জেদ্দা ও দামমামের অফিসে দেশে ফেরার অপেক্ষায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতারক দালালরা এখন মোটা অংকের টাকা দাবি করছে। তিনি ওই সব নারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের বাউরগাতি গ্রামের দিনমজুর মজিবর সরদার জানান, ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার আকুরা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের ট্রাভেলস্রে অফিস সহকারী আসাদুল ইসলাম আসাদের প্রলোভনে গৃহকর্মীর কাজে মোটা অংকের টাকা বেতন দেয়ার আশ্বাসে তার স্ত্রী তিন সন্তানের জননী মইরমকে গত ২১ মার্চ সৌদি আরবে পাঠানো হয়। মোবাইল ফোনে মইরম এ প্রতিনিধিকে জানান, সৌদি আরবের জেদ্দায় মেঘা কোম্পানির মাধ্যমে তিনি পর পর দুটি বাসা পরিবর্তন করার পরও তার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। সব বাসায়ই থাকার জায়গা, খাবার না দেয়াসহ গোসল করতে দেয়া হতো না। এছাড়া সবধরনের মানসিক কষ্ট দেয়া হয়। এজন্য কোম্পানির লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি গত দু’মাস ধরে দেশে ফিরে আসার জন্য মেঘা কোম্পানির জেদ্দার অফিসে অবস্থান করছেন। মইরম বলেন, তার সঙ্গে প্রতিদিনই অসংখ্য নারী একই সমস্যায় সৌদির বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে ফিরে এসে অফিসে অবস্থান করছেন। যাদের মধ্যে অনেকেই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সৌদি আরবে এসেছেন। এখন আবার কোম্পানির লোকজনদের চাহিদা মোতাবেক টাকা যারা দিতে পারছেন তাদেরই দেশে পাঠানো হচ্ছে। বাকিদের ওই অফিসে রাখা হলেও সেখানে তাদের একবেলা খাবার দেয়া হয়। ফলে বর্তমানে খাবার সঙ্কটে তারা ওই অফিসেও নিদারুণ কষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বর্তমানে তার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। মইরমের দিনমজুর স্বামী মজিবর সরদার অভিযোগ করেন, তার স্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি ঢাকার আকুরা অফিসের আসাদুল ইসলাম আসাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আসাদ মইরমকে ফিরিয়ে আনার জন্য তার কাছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দাবি করে। কিন্তু অসহায় পরিবারের পক্ষে এ টাকা দেয়া সম্ভব নয় জানালে আসাদ বলে, ওই দেশে বসে মইরম এ টাকা আয় করে দেয়ার পরই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। আসাদের এ কঠোরতায় চরম অসহায় হয়ে পড়েন মজিবর। তিনি তার স্ত্রী মইরমকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
×