ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাহে রমজান

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৮ জুন ২০১৬

মাহে  রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তাবাহী মাহে রমজানুল মোবারকের আজ ১২তম দিবস। দিবসটি একটি বিশেষ কারণে অধিক স্মরণীয়। এদিন চার প্রধান আসমানী কিতাবের অন্যতম কিতাব যাবুর নাজিল হয়েছিল হজরত দাউদ (আ) এর ওপর। নবী দাউদ (আ)কে শ্রদ্ধা ও স্মরণের জন্য আমাদের ইসলাম ধর্মে সবিশেষ তাগিদ এসেছে। মহাগ্রন্থ আল কোরানের ৯টি সূরাতে হজরত দাউদ নবী (আ)- এর বর্ণনা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৬টি স্থানে তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। কোন কোন সূরায় সংক্ষিপ্ত আর কোন কোন সূরায় বিস্তারিতভাবে তাঁর অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে। হজরত দাউদের (আ) বীরত্ব, সাহসিকতা এবং যুদ্ধ কৌশলের এক হৃদয়গ্রাহী ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। তিনি দুর্ধর্ষ ফিলিস্তিনী নেতা জালুতকে হত্যা করে বনী ইসরাইলীদের এক ভয়াবহ বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন এবং তা দ্বারা তিনি ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে নবী, রাসূল ও বনী ইসরাইলদের বাদশাহ। সূরা বাকারায় বর্ণিত হয়েছে : ‘আল্লাহ তায়ালা তাকে বাদশাহী ও নবুওয়াত প্রদান করেছেন এবং তাঁকে যা ইচ্ছা শিক্ষা দিয়েছেন।’ তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন বিখ্যাত নবী ইবরাহীম (আ)। পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মাত্র ৫ মাইল দক্ষিণে বায়তুল লাহামে তাঁর জন্ম। -(তাওরাত)। তারা ছিলেন ৮ ভাই। দাউদ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। পিতার নাম ছিল ঈসাস। তাওরাতে এও বলা হয়েছে যে, সামুয়েল নবী ইঙ্গিত পেয়েছিলেন যে, সম্রাট তালুতের পর দাউদ নামের একজন লোক বাদশাহ হবেন। সুতরাং তিনি বায়তুল লাহামে গেলেন। ঈসাসের সমস্ত পুত্রদের তিনি দেখলেন। দাউদ ঐ সময় ভেড়া চরাতে গিয়েছিলেন। তাঁকে বিশেষভাবে ডাকা হলো। যেহেতু আল্লাহর দেয়া খোশখবরী মতে তিনি হবেন একজন মহান বাদশাহ। এক সময় সম্রাট তালুতের এমন একজন লোকের প্রয়োজন হলো যিনি বাঁশি বাজাতে খুব পটু। তার কর্মচারীরা বহু খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে এ ক্ষেত্রে একজন বিস্ময়কর প্রতিভা হিসেবে বায়তুল লাহামের ঈসাসের পুত্র দাউদের সন্ধান দিল। এ সঙ্গে তারা তাঁর অন্যান্য গাম্ভীর্যপূর্ণ আচরণ ও বীরত্বেরও সংবাদ দেয়। দাউদ (আ) এবার তালুতের স্নেহভাজন হওয়ার গৌরব অর্জন করলেন। রাজদরবারেই তিনি থাকতেন। শুধু মাঝে মধ্যে এসে পিতাকে ভেড়া চরানোর কাজে সহযোগিতা করতেন। একপর্যায়ে বনী ইসরাইল ও পলেস্টীয়দের মধ্যে যুদ্ধ বাধল। বাদশাহ তালুত সৈন্যদল নিয়ে পলেস্টীয়দের মোকাবেলায় বের হলেন। পথিমধ্যে একটি গভীর নদী। প্রখর রোদের সময় ক্ষুধাতৃষ্ণা কাতর সৈন্যদলকে তালুত কষ্টসহিষ্ণুতার পরীক্ষা করার জন্য বললেন, যারা এ নদীর পানি পান করবে তারা আমাদের সঙ্গী হতে পারবে না, কিন্তু যারা পান না করবে তারাই আমার সঙ্গে জিহাদে যোগদানের সুযোগ পাবে। এ’টা তিনি এ জন্য করেছিলেন যে, জালুতের ছিল বিশাল সৈন্যবাহিনী। আর এ বাহিনীকে পরাজিত করতে হলে প্রয়োজন ছিল ইমানের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সৈন্যদল। অবশ্য, ফল তাই হয়েছিল। জালুত ও তার বিশাল বাহিনী পরাজিত হয়। বাকারা ২৫০,২৫১)। সে সময় দাউদের তিন ভাই ছিলেন ইসরাইলী সেনাদলে। দাউদের পিতা ঈসাস তাঁকে যুদ্ধের ময়দানে ভাইদের কুশলাদি জানার জন্য প্রেরণ করেন। এখানে তিনি প্রসঙ্গক্রমে ভাইদের কাছে জানতে পারেন যে, দুর্ধর্ষ জালুত এখন স্বয়ং মাঠে তার মোকাবেলার জন্য ইসরাইলীদের উদ্দেশে হুঙ্কার ছাড়ছে। কিন্তু কেউ তার সামনে এগোবার সাহস পাচ্ছে না। হজরত দাউদ আরও জানতে পারেন যে, জালুতরা সম্মানিত ইসরাইল জাতিকে অপমানিত ও অপছন্দ করার জন্য এ যুদ্ধের আয়োজন করেছে। সুতরাং এমতাবস্থায় কেউ যদি সাহসিকতার সঙ্গে তাকে হত্যা করতে সমর্থ হয় তাকে বাদশাহ তালুতের পক্ষ থেকে অঢেল সম্পত্তি, ধন-রতœ দেয়ার ঘোষণা রয়েছে। বাদশাহ আরও অঙ্গীকার করেন যে, তিনি স্বীয় কন্যাকে তার সঙ্গে বিবাহ দেবেনÑ। সুতরাং হযরত দাঊদ (আ) হকের ইজ্জত রক্ষার্থে জালিমদের মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সংবাদ বাদশাহ তালুতের কাছে পৌঁছল। তিনি দাউদকে বললেন, তুমি জালুতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সক্ষম নও। তুমি তো একজন বালক মাত্র। আর জালুত কৈশোর থেকে যুদ্ধবাজ। উত্তরে দাউদ আরজ করলেন : আমি এক সময় একাই বাঘ মেরেছি। যে আল্লাহ আমাকে বাঘের পাঞ্জা থেকে রক্ষা করেছেন সে আল্লাহই এ পলেস্টীয়দের হাত থেকে রক্ষা করবেন। অগত্যা তালুত তাকে তলোয়ার, বল্লম ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র প্রদান করলেন। দাউদ কিন্তু এসব অস্ত্র পরিচালনায় অভ্যস্ত ছিলেন না বিধায় সব খুলে রেখে দিলেন। একজন সাধারণ মেষ পালকের ন্যায় তিনি একটি লাঠি ও ঝুলি তুলে নেন এবং জালুতের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন। জালুত নিয়মমাফিক যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধের ময়দানে এসেছে। সামনে রয়েছে দেহরক্ষী বাহিনী। দাউদের প্রতি তার দৃষ্টি গেলে সে উপহাসের হাসি হাসল এবং দাউদ নবীর লাঠির দিকে ইঙ্গিত করে বলল : আমি কি কুকুর যে, লাঠি নিয়ে আমার কাছে এসেছ? দাউদ (আ) বললেন, তোমাকে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, আল্লাহ তায়ালা শুধু তলোয়ার, বল্লম, নেজা অথবা অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রের মাধ্যমে জয়যুক্ত করেন না বরং সদাসর্বদা তাঁর অসীম রহমত দ্বারা সত্যকে সাহায্য করে থাকেন। নিরস্ত্রি অবস্থায় মুখোমুখি হওয়ার জন্য দুর্ধর্ষ জালুত যখন দাউদকে পরিহাস করছিলেন, তখন দাউদ নবী আপন ঝুলিতে হাত দিয়ে একখানা পাথর বের করলেন এবং ফিঙ্গাতে পাক দিয়ে ঐ পলেস্টীয় বীর জালুতের কপালে আঘাত করলেন। আল্লাহর অশেষ কুদরতে পাথরখানা তার কপালে বসে গেল এবং সে ভূমিতে অধোমুখ হয়ে পড়ল। অতঃপর দাউদ (আ) স্বীয় খড়গ খুলে তাকে বধ করলেন। হজরত দাউদের (আ) প্রতি ইসরাইলীদের অত্যাধিক ভালবাসার কারণে তালুতের মৃত্যুর পর জাতি তাঁকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন। তিনি ইসরাইল জাতির বাদশাহ নির্বাচিত হন। ক্ষমতা লাভের পর বনী ইসরাইলীদের চারিত্রিক ও দ্বীনি সংশোধন ছাড়াও ইহলৌকিক কার্যাবলীর দিকনির্দেশনার দায়িত্বও নিজ স্কন্ধে তুলে নেন।
×