ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে অপরাধ, অহরহ হ্যাকিং ॥ সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে দেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৮ জুন ২০১৬

বাড়ছে অপরাধ,  অহরহ হ্যাকিং ॥ সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে দেশ

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ডিজিটাল প্রযুক্তির আবির্ভাবে দিন দিন দেশের সাইবার স্পেস বৃদ্ধি পেলেও অনিরাপদ থাকছে সরকারী-বেসরকারী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। অনুন্নত ডোমেইন, ওপেন সোর্স কোডিং ও কম মূল্যে শেয়ার্ড সার্ভার ব্যবহারের কারণে অরক্ষিত থাকছে গুরুত্বের তালিকায় শীর্ষে থাকা ওয়েবসাইটগুলোও। এতে হরহামেশাই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য চুরি যাচ্ছে, খোয়া যাচ্ছে গোপনীয় নথি! শুধু বাংলাদেশ নয়, সাইবার আক্রমণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সাইবার আক্রমণে বিশ্বে প্রতিবছর অন্তত কয়েকশ’ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। ২০১৪ সালে ইন্টেল সিকিউরিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে সাইবার আক্রমণজনিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৩ সালে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। সাইবার আক্রমণে বিশ্বে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার হচ্ছে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়। তথ্যালোকে স্পষ্টত, দিন যতই যাচ্ছে সাইবার অপরাধে বিশ্বে ক্ষতির পরিমাণ ততই বাড়ছেই। আর হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘঁনা তো রয়েছেই। এসব বিবেচনায় নিরাপত্তা রক্ষার্থে দেশে গঠিত হয়েছে কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (সার্ট)। বিশেষজ্ঞদের ধারণা মতে, বিশ্বে পরবর্তী যে যুদ্ধ হবে তা শুধু রণক্ষেত্রেই নয়, ছড়িয়ে যাবে ভার্চুয়াল জগতেও। সাইবার অপরাধ ও ভবিতব্য ওই যুদ্ধ মোকাবেলায় ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছে উন্নত বিশ্ব। গড়ে তুলছে দক্ষ প্রযুক্তিবিদ ও সাইবার বিশেষজ্ঞ। একই সঙ্গে সচেতনতার মাধ্যমে নিরাপদ করে তোলা হচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের। তবে ক্রমাগত সাইবার অপরাধ বেড়ে চললেও তা মোকাবেলায় বাংলাদেশে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকারীভাবে ফ্রিল্যান্সার তৈরিতে মনোনিবেশ দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত ওয়েবসাইটগুলোর নিরাপত্তা উন্নয়নে কোন প্রকল্প গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। দেশের সাইবার নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সাইবার নিরাপত্তায় আমাদের দেশে আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কোন অবকাঠামো নেই। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ বা দমন করার কোন আইন নেই। এছাড়া দক্ষ জনবলের অভাব তো রয়েছেই। অন্যদিকে দেশ দ্রুত ডিজিটালাইজেশনের দিকে গেলেও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা তেমন দক্ষ বা সচেতন নয়। তাই ইন্টারেনেট ব্যবহারে সর্বাত্মক সচেতনতা কাম্য।’ সোশ্যাল মিডিয়াতে ক্রমবর্ধমান হারে অপরাধ বেড়ে চলছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, অতি দ্রুত সময়ে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট’ অনুমোদন পেলে ভার্চুয়াল জগতে অপরাধের প্রবণতা কমে আসবে বলে প্রত্যাশা। সাইবার জগত ও অপরাধ ॥ সাইবার জগত বলতে ইন্টারনেটকেন্দ্রিক তথ্য ব্যবস্থার বিশাল ভা-ারকে বোঝায়। এর মধ্যে কম্পিউটার সিস্টেম, সার্ভার, ওয়ার্ক স্টেশন, টার্মিনাল, স্টোরেজ মিডিয়া, কমিউনিকেশন ডিভাইস, নেটওয়ার্ক রিসোর্স এবং কম্পিউটারে ডাটা আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া বিদ্যমান থাকে। আর সাইবার অপরাধ বলেতে কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কোন ব্যক্তিকে তার কাজ থেকে বিরত রাখা বা কোন কাজে বাধ্য করাকে বোঝায়। কোন জনগোষ্ঠীকে ভীতি প্রদর্শন করা, কম্পিউটার সিস্টেমের ক্ষতি সাধন করা, কম্পিউটার সংক্রামক, দূষক বা ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে ক্ষতিসাধন, জালিয়াতি, প্রতারণা, দেশের অখ-তা, সংহতি ও জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা বা করার চেষ্টাই সাইবার অপরাধ। এছাড়া পর্নোগ্রাফি বিনা অনুমতিতে ব্যক্তিগত গোপনীয় অঙ্গের আলোকচিত্র বা ভিডিও ধারণ, সংরক্ষণ ও প্রচার, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর শিশুপর্নো উৎপাদনে প্রবেশ, সংরক্ষণ বা ছড়িয়ে দেয়ার কাজে জড়িতরাও সাইবার অপরাধী। সাইবার জগত ও অপরাধ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করতে গিয়ে এসব কথা বলা হয়েছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের অন্তরূপ’ গ্রন্থটিতে। সরকারী প্রতিষ্ঠানে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সতকর্তা ॥ ডিজিটালাইজেশনের জোয়ারে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফেসবুকসহ নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। তথ্যমতে, বর্তমানে সরকারী প্রায় ৮ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে অফিসের দাফতরিক কাজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে এবং একুশ শতকের উপযোগী সক্ষমতা অর্জনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার অত্যন্ত জরুরী। আবার নিরাপত্তার খাতিরে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশিকা মানাও জরুরী বলে মনে করেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ফলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। ওই প্রজ্ঞাপনে ফেসবুক পেজ বা আইডি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দেশনা মানতে অনুরোধ করা হয়। শিশু-কিশোরদের প্রতি পরামর্শ ॥ ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকতে শিশু-কিশোরদের প্রতি কিছু পরামর্শ দিয়েছে আইসিটি বিভাগ। এতে ব্যক্তিগত তথ্য বা ছবি অপরিচিত কাউকে দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এ্যান্টি-ভাইরাস, এ্যান্টি-স্পাইওয়্যার বা ফায়ারওয়াল ব্যবহার করতে এবং তা নিয়মিত আপডেট করতেও বলা হয়েছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে বয়সসীমার নিয়ম, কাজ শেষে কম্পিউটার সর্বদা লগ অফ, জটিল পাসওয়ার্ড ব্যবহার, নিয়মিতভাবে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন, নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে বলা থেকে বিরত থাকার কথাও বলা হয়। তথ্য প্রযুক্তি আইন ॥ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (২০১৩ সংশোধিত)-এ সাইবার অপরাধে দ- সম্পর্কে বলা হয়েছে, কম্পিউটারে যে কোন ধরনের তথ্য চুরি অথবা বিকৃতি ঘটালে অনধিক ১৪ বছরের এবং অন্যূন ৭ বছর কারাদ- বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থ দ- বা উভয় দ-ে দ-িত হওয়ার বিধান রয়েছে। আর কম্পিউটার হ্যাকিং তথা কারো অনুমতি ব্যতীত যে কোন ইলেক্ট্রনিক আইডিতে প্রবেশ করলে অনধিক ১৪ বছরের এবং অন্যূন ৭ বছর কারাদ-ে বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থ দ-ে বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। এছাড়া যে কোন ওয়েবসাইটে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর বক্তব্য, ছবি প্রকাশ করলে তিনি অনধিক ১৪ বছরের এবং অন্যূন ৭ বছর এবং অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থ দ-ে দ-িত হবেন। অনুমতি ব্যতীত যে কোন সংরক্ষিত সিস্টেমে কোন ব্যক্তি প্রবেশ করলেও আইনের বিধান রয়েছে। তবে আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধীরা অহরহ ঘটিয়ে চলছে সাইবার অপরাধ। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দক্ষ সাইবার যোদ্ধা গড়ে তুলছে যুক্তরাষ্ট্র ॥ সাইবার অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ায় পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধটা হতে পারে ভার্চুয়াল জগতেÑ কয়েক বছর ধরেই এমন ধারণা সাইবার বিশেষজ্ঞদের। ফলে বিভিন্ন দেশ এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করছে, আমেরিকাও পিছিয়ে নেই। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দেশটি প্রায় ১০ বছর ধরে দক্ষ সাইবার যোদ্ধা গড়ে তোলার ব্যাপারে কাজ করছে। ‘সাইবারকর্পস’ নামে একটি প্রকল্পের আওতায় প্রতিবছর ১৫০ শিক্ষার্থীকে বিনা পয়সায় লেখাপড়া করানো ছাড়াও তাদের মাসিক খরচের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেয়া হচ্ছে। মোট ৪৬ টি বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। সুরক্ষিত চীনের সাইবার স্পেস ॥ যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাইবারকর্পস’ প্রকল্পের ন্যায় একই রকম প্রকল্পের আওতায় চীনেও গড়ে তোলা হচ্ছে দক্ষ সাইবার যোদ্ধা। দেশটিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে দক্ষ সাইবার যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। আর এসব শিক্ষার্থী দেশের শীর্ষ আইটি প্রতিষ্ঠানে অনায়াসেই কাজ পেয়ে যাচ্ছে। এরা একদিকে যেমন মোটা অঙ্কের অর্থ আয় করছে তেমনি নিরাপদ রাখছে সে দেশের সাইবার স্পেস। বাংলাদেশের ওয়েবসাইটের অবস্থা ॥ ওয়ার্ডপ্রেস, জুমলা, এইচটিএমএল ও ধ্রপালসহ কয়েকটি মাধ্যমে গড়ে ওঠে ওয়েবসাইট। তবে দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অদক্ষ ডেভেলপার দিয়ে তৈরি হয় গুরুত্বপূর্ণ কোন প্রতিষ্ঠানের সাইটও। ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে তথ্য। এছাড়া ওয়ার্ডপ্রেসের সমস্ত নিরাপত্তা পদ্ধতি যার নখদর্পণে রয়েছে, সে সহজেই যে কোন ওয়ার্ডপ্রেসের সাইটে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম। তরুণ ওয়েব ডেভেলপার কাজী মামুন হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা নির্ভর করে মূলত পদ্ধতি অবলম্বনের ওপর। নিরাপত্তা দেয়ার ভাল পদ্ধতি আছে কিন্তু অর্থ সাশ্রয় করতে গিয়ে অনেকেই তা অবলম্বন করেন না। তিনি বলেন, ওয়েবসাইট তৈরির ক্ষেত্রে ওয়ার্ডপ্রেস একটি প্রচলিত পদ্ধতি। মূলত ওয়ার্ডপ্রেস হচ্ছে ওপেন সোর্স সিএমএস (কন্টেট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম)। যে কেউ চাইলেই ওয়ার্ডপ্রেসের ব্যাকগ্রাউন্ড কোডিংয়ের এ টু জেড জানতে পারে। পৃথিবীতে এরকম অসংখ্য মানুষ আছেন যারা ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করেন। যারা ওয়ার্ডপ্রেসের সমস্ত নিরাপত্তা পদ্ধতি নখদর্পণে রাখেন সেসব ব্যক্তি চাইলে খুব সহজেই ওয়ার্ডপ্রেস সাইট হ্যাক করতে পারেন। আবার অনেক সাইট আছে যারা স্ট্রং নিরাপত্তা পদ্ধতি অবলম্বন করার পরও তাদের সাইট হ্যাক হয়েছে। মামুন বলেন, আমাদের দেশে টাকা বাঁচানোর জন্য, সবেমাত্র ওয়ার্ডপ্রেস শেখা ব্যক্তিকে দিয়ে ওয়েবসাইট তৈরি করে সেসব সাইটে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রাখা হচ্ছে। ফলে এসব সাইটের নিরাপত্তা একেবারে দুর্বল। পাশাপাশি ওয়েবসাইটের নিরাপত্তায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সার্ভার। যেকোন ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সার্ভারের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে কোন কোন প্রতিষ্ঠান টাকা বাঁচানোর জন্য অপরিচিত কোম্পানির কাছ থেকে স্পেস কিনে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রাখছেন। পাশপাশি কমমূল্যে শেয়ার্ড সার্ভার থেকে ১/২ জিবি স্পেস কিনে সেখানেও ডাটা রাখছেন। যার ফলে তথ্য হারানো, হয়রানির পাশপাশি, যে কোন সময় ওয়েবসাইট হ্যাক হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন তারা। একই রকম তথ্য জানালেন বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার। দেশের সরকারী-বেসরকারী ওয়েবসাইটগুলোতে নিরাপত্তার বিষয়টি তেমনভাবে প্রাধান্য পায় না উল্লেখ করে এই প্রযুক্তিবিদ বলেন, ‘আমাদের দেশে সরকারী-বেসরকারী ওয়েবসাইটগুলোর ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয় না। সর্বক্ষেত্রেই এ প্রবণতা দৃশ্যমাণ। যারা ওয়েব তৈরি করান তাদের সচেতন হওয়া উচিত। ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি হয়ে গেলে কতটা ক্ষতি হয় তা অনুধাবন করতে হবে। হ্যাক বা তথ্য চুরি রোধে নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে, সচেতন হতে হবে।’ হ্যাকিং থেকে বাঁচার উপায় ॥ হ্যাকিংয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত এমন চৌকস ও সুদক্ষ হ্যাকারও হ্যাকিংয়ের শিকার হন। ফলে সচেতনতার মাধ্যমে একেবারে হ্যাকিং হ্রাস সম্ভব নয়। তবে কিছুটা নিরাপদ থাকা যাবে বৈকি। এম মিজানুর রহমান সোহেল রচিত ‘হ্যাকিং এ্যান্ড হ্যাকার’ বইয়ে এমন তথ্য দিয়ে হ্যাকিং থেকে বাঁচার জন্য কিছু সতকর্তা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে। হ্যাকারদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ফায়ারওয়াল ব্যবহার, কম্পিউটারে পাসওয়ার্ড ব্যবহার, পাসওয়ার্ড শব্দ-নম্বর-সিম্বলের সংমিশ্রণে তৈরি করা, পাসওয়ার্ড ১ থেকে ২ মাস অন্তরে বদলানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে বইটিতে। এছাড়া এ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার, নিয়মিত আপডেট, অপারেটিং সিস্টেম আপডেট, ইমেইল ফিল্টারিং সার্ভিস ব্যবহার করতে বলা হয়। এ্যাডওয়ার, স্প্যাম ও স্পাইওয়ার নিয়মিত দূর না করলে হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়। পঞ্চম ডোমেইনের যুদ্ধ ও করণীয় ॥ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শ্যামসুন্দর সিকদার তার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের অন্তরূপ’ বইয়ে সাইবার নিরাপত্তাকে পঞ্চম ডোমেইনের যুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ‘সাইবার নিরাপত্তা : বিশ্ব ও বাংলাদেশের উদ্যোগ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে যে যুদ্ধ হবে তা যতটা না ভূখ-ের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার জন্য, তার চেয়েও বেশি সাইবার জগতের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। বিশ্বে সাইবার স্পেসের যুদ্ধকে বলা হচ্ছে পঞ্চম ডোমেইনের যুদ্ধ।’ ওই নিবন্ধে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে তিনি কয়েকটি পরামর্শ দেন, তা হচ্ছে ১. আমদানি করা প্রযুক্তিপণ্যে বিশেষ করে সফটওয়্যারের প্রতিরক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও ডাটা চুরির লক্ষ্যে সংযোজিত প্রোগ্রামিং কোড চিহ্নিত করার দক্ষতা অর্জন ২. সরকারী বৈধ কর্তৃপক্ষকে কম্পিউটার সিস্টেমের দুর্বলতা খুঁজে বের করার জন্য অনুসন্ধান আইনি ভিত্তি দেয়া ৩. সার্টিফায়েড ইথিক্যাল কোর্স চালু করার ব্যবস্থা নেয়া ৪. সাইবারসংক্রান্ত গোয়েন্দা তৎপরতা মোকাবেলায় সরকারী কাউন্টার সাইবার ইন্টেলিজেন্স (সিআই) গড়ে তোলা ৫. সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট তৈরির লক্ষ্যে ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। তবে বাংলাদেশ দিন দিন সতর্ক হয়ে উঠলেও তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তবে কার্যকর উদ্যোগ নেইÑএ কথা মানতে নারাজ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শ্যামসুন্দর সিকদার। জনকণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (সার্ট) গঠন করা হয়েছে। আইসিটি বিভাগে বসেই দেশের সরকারী-বেসরকারী কোন্ সাইট হ্যাক হলে তা শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। আমাদের রেসপন্স টিম ফাইট দিচ্ছে, আক্রান্ত কম্পিউটার বা ব্যবহারকারীকে সর্বাত্মক সহায়তা করছে। সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি বিষয়ে ক্যাসপারস্কির ২০১৫ সালের এক তথ্যের বরাত দিয়ে সচিব শ্যামসুন্দর শিকদার জনকণ্ঠকে বলেন, ক্যাসপারস্কির তথ্য অনুযায়ী সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকির শীর্ষে রয়েছে ভিয়েতনাম। তারপরে বাংলাদেশ, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া ও আমেরিকা। আমেরিকা যেহেতু ঝুঁকিতে ৫ নম্বরের তালিকায় রয়েছে তাই সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের দেশে যতটা লাফালাফি হচ্ছে ঠিক ততটা করা উচিত নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ধীরে ধীরে আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি। সামগ্রিক প্রসঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জনকণ্ঠকে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সাইবার নিরাপত্তা ইস্যুটি খুবই গুরত্বপূর্ণ এবং এ ব্যাপারে সরকার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বাস্তবায়নে যথেষ্ট আন্তরিক। সার্বিকভাবে বললে, সাইবার নিরাপত্তায় আমরা মডারেট পর্যায়ে আছি। কিন্তু দিনে দিনে আমরা উন্নতি সাধন করছি। নিরাপত্তা বিধানে সরকারী উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সফটওয়্যারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইতোমধ্যে আমরা ‘ভালনার‌্যাবিলিটি এ্যাসেসমেন্ট এ্যান্ড পেনিট্রেশন টেস্টিং’র ব্যবস্থা করেছি। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল থেকে আমরা ‘বাংলাদেশ গবর্মেন্ট ইনফর্মেশন সিকিউরিটি মেনুয়্যাল’ নামে একটি পুস্তিকা বের করেছি যেখানে ব্যক্তি ও সংস্থার সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পর্কে দিকনির্দেশনা রয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত বাস্তবতায় সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আমরা আইসিটি এ্যাক্ট ২০০৬ ও ২০১৩ (সংশোধিত) এর পাশাপাশি ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট ২০১৬ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি শীঘ্রই ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট ২০১৬ প্রণীত হবে।
×