ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাঁড়াশি অভিযানে ১৯৪ জঙ্গী গ্রেফতার হলেও থেমে নেই ওরা

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৮ জুন ২০১৬

সাঁড়াশি অভিযানে ১৯৪ জঙ্গী গ্রেফতার হলেও থেমে নেই ওরা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সারাদেশে সপ্তাহব্যাপী চলমান সাঁড়াশি অভিযানে ১৯৪ জঙ্গী গ্রেফতার হলেও থেমে নেই জঙ্গী কার্যক্রম। সারাদেশেই পোস্টার সেঁটেছে নিষিদ্ধ আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর। তাদের অনলাইনে সম্মেলন করার পরিকল্পনা প্রায় পুরোপুরি ভেস্তে গেছে। শুক্রবারও খোদ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মসজিদের সামনে মুসল্লিদের কাছে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী লিফলেট বিতরণ করেছে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনটি। হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে মিশে অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা তৎপরতা চালাচ্ছে। সারাদেশে হিযবুত তাহরীর ব্যাপক আকারে লিফলেট বিলিসহ অনলাইন সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিটিআরসির (বাংলাদেশ টেলিযোযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন) সমন্বিত উদ্যোগের কারণে সে পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা একেএম কামরুল আহছান জানান, সপ্তাহব্যাপী চলমান অভিযানের শেষ দিন বৃহস্পতিবার সকাল ছয়টা থেকে শুক্রবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ১৭ জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। এর মধ্যে নয়জন জেএমবি, সাতজন হিযবুত তাহরীর ও একজন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। শেষ দিনের অভিযানে একটি পাইপগান, একটি শাটারগান, এক রাউন্ড গুলি, দুটি ককটেল, একটি রামদা, একটি চাপাতি ও কিছু উগ্র মতাদর্শের বই জব্দ হয়েছে। এ নিয়ে টানা এক সপ্তাহের অভিযানে মোট ১৯৪ জঙ্গী গ্রেফতার হলো, যার মধ্যে ১৫১ জন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), ২১ জন হিযবুত তাহরীর, সাতজন জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), ছয়জন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, তিনজন আনসার আল ইসলাম, একজন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও একজন আফগান ফেরত মুজাহিদ। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টদের মাধ্যমে গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম হয়। এর পর থেকেই একের পর এক নৃশংসভাবে হত্যাকা-ের শিকার হন অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট, ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, শিক্ষকসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। এসব হত্যাকা- ঘটে যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত বিশেষ ইসলামী দলটি ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর সরাসরি মদদ আর ছত্রছায়ায়। এখনও জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। তারই ধারাবাহিকতায় সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যে জঙ্গীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে হিযবুত তাহরীরের ব্যানারে সারাদেশে অনলাইন সম্মেলন ও লিফলেট বিলির উদ্যোগ নিয়েছিল ইসলামী দলটি। বিলি করা লিফলেটে ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ, দেশে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম, জালিম সরকারের পতনসহ নানা বিষয়ে আপত্তিকর বক্তব্যসংবলিত লেখা রয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় শাখার সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক মোঃ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, হিযবুত তাহরীরের আড়ালে কাজ করছে যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত বিশেষ ইসলামী দলটি। আর তাতে নানাভাবে সহায়তা করছে তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো। হিযবুত তাহরীরের পোস্টার সাঁটানো থেকে শুরু করে যাবতীয় কিছুই তাদের নখদর্পণে ছিল। তারা সারাদেশে ব্যাপক শোডাউন দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিটিআরসির উদ্যোগের কারণে জঙ্গী সংগঠনটির সে পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি জায়গায় আচমকা লিফলেট বিলি করেই পালিয়ে গেছে। এর মধ্যে সাতজন গ্রেফতার হয়েছে। তাদের কড়া জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে। দৃশ্যমান অভিযান শেষ হলেও কৌশলী অভিযান অব্যাহত থাকবে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ওই অভিযান চলবে। এর মধ্যে জঙ্গী গ্রেফতারে চলমান থাকবে সাঁড়াশি অভিযান। সারাদেশের দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তাদের এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অভিযানের সার্বিক মূল্যায়ন সম্পর্কে এ কর্মকর্তা বলছেন, বিশেষ অভিযানে অনেক লাভ হয়েছে। বিশেষ করে গ্রেফতারকৃত ১৯৪ জঙ্গীর মধ্যে প্রায় ১০০ জনই বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের নতুন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ চলবে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা কাদের মাধ্যমে, কিভাবে, কোথা থেকে কি কারণে কোন্ জঙ্গী সংগঠনের সদস্য হয়েছে তা জানার চেষ্টা করা হবে। ইতোমধ্যেই অনেক নতুন সদস্যই জঙ্গীবাদের অনেক শিকড় সম্পর্কে পিলে চমকানোর মতো তথ্য দিয়েছে। নতুন সদস্য হিসেবে যেসব জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোন থানায় মামলা পর্যন্ত নেই। এমনকি তাদের সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন কোন ধারণাই ছিল না। ইতোপূর্বে তারা কোন দিন গ্রেফতারও হয়নি। গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই সিøপার সেলের সদস্য। মূলত এ ধরনের নতুন সদস্য দিয়েই নৃশংস হত্যাকা-গুলো সংঘটিত হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাদে তাদের অর্থদাতা, আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা, ট্রেনিং, অস্ত্র-গোলাবারুদসহ নানা বিষয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ওই তথ্যের ভিত্তিতেই জঙ্গী দমনে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে নতুন সদস্য সংগ্রহের আদ্যোপান্ত জানা গেছে। সে অনুযায়ী কাজ করতে পারলে জঙ্গীদের নতুন সদস্য সংগ্রহ করার পথ প্রায় পুরোপুরিই বন্ধ করা সম্ভব। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে গত বছরে সংঘটিত ৪৪টি নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার রহস্য বেরিয়ে আসতে পারে। ইতোমধ্যেই কিছু কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ বিস্তারের পদ্ধতি সম্পর্কিত অনেক তথ্য জানা গেছে, যা জঙ্গী দমনে বিশেষ সহায়ক হবে। সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানে সাধারণ মানুষ হয়রানির অভিযোগটি ভিত্তিহীন বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলছেন, কোন নির্দোষ ব্যক্তি, নিরপরাধ ব্যক্তি কিংবা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হয়রানি করার জন্য এ অভিযান হয়নি। জঙ্গী দমন ও টার্গেট কিলিং বন্ধ করতেই সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান হয়েছে। অভিযানের কারণে টার্গেট কিলিং কমেছে। সব ধরনের জঙ্গী দমনে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। পুলিশ সদর দফতরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, হিযবুত তাহরীরকে যারা চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে তাদের বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়ামাত্রই তাদের গ্রেফতার করা হবে। প্রসঙ্গত, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কতিপয় শীর্ষনেতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের গোপন তৎপরতা শুরু হয়। ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশে জঙ্গী সংগঠনটি আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। ওই সময়ই সংগঠনটি একটি উগ্র মৌলবাদী এবং আন্তর্জাতিকমানের জঙ্গী সংগঠন বলে গোয়েন্দারা সরকারকে রিপোর্ট দিয়েছিল। কিন্তু সরকার বিষয়টি আমলে নেয়নি। ২০০৮ সালে পাকিস্তানে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এর পর খানিকটা টনক নড়ে বাংলাদেশের। দীর্ঘ তদন্তে হিযুবত তাহরীর আন্তর্জাতিকমানের জঙ্গী সংগঠন বলে তথ্য বেরিয়ে আসে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৩টি দেশে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষণার পর সংগঠনটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হলেও গোপনে সংগঠনটি তাদের জঙ্গী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের অনেকেই জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার জঙ্গী কার্যক্রম চালাচ্ছে। জঙ্গী সংগঠনটি নতুন সদস্যও সংগ্রহ করছে। সর্বশেষ মাদারীপুরে বাসায় ঢুকে কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যাচেষ্টায় গ্রেফতারকৃত ফাইজুল্লাহ ফাহিম নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের নতুন সদস্য। শিক্ষককে হত্যার চেষ্টা ছিল ফাহিমের প্রথম অপারেশন।
×