ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতা নেই

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১৮ জুন ২০১৬

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতা নেই

গৌতম পাণ্ডে ॥ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে বলা হয়ে থাকে সকল সঙ্গীতের মূল বা শিকড়। ভাল শ্রোতা হতে হলেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওপর স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র জন্মভূমি বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বর্তমান অবস্থা যে ভাল এ কথা জোর দিয়ে বলা কঠিন। দেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রত্যাশিত ধারায় কেন এগোচ্ছে না, এর জৌলুস কেন হারাতে বসেছে, এ নিয়ে নানা জনের রয়েছে নানা মত। কেউ বলছেন, দেশে ভাল মানসম্মত শিল্পী বা শিক্ষক নেই এ কারণে নতুন শিল্পী তৈরি হচ্ছে না। আবার কেউ বলছেন পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও উপযুক্ত প্লাটফর্ম নেই, প্রচার বা প্রসারের ঘাটতি, সে রকম বোদ্ধা শ্রোতার অভাব ইত্যাদি। বাস্তবে হয়ত কিছু কিছু ঘাটতি আছে। একথা অনস্বীকার্য, বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একদল ভাল শ্রোতা ও প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ গাইয়ে-বাজিয়ে তৈরি হয়েছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে নতুনদের এ সঙ্গীতের প্রতি প্রচুর উদ্দীপনাও লক্ষ করা গেছে। ছায়ানটের শাস্ত্রীয়সঙ্গীত সম্মেলন, চট্টগ্রামের সদারঙ্গ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সম্মেলন, নারায়ণগঞ্জের লক্ষাপার উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সম্মেলন, যশোরের ওস্তাদ মোশাররফ হোসেন স্মরণে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সম্মেলন, রাজশাহীতে হিন্দোল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব এবং ঢাকার শুদ্ধ সঙ্গীত প্রসার গোষ্ঠীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রতি বছর কিছু না কিছু উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আসর বসে কোন না কোন জায়গায়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। প্রচারেই প্রসার কথাটি সর্বজনবিদিত। সে দিক থেকে বলা যায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রচার-প্রসার আমাদের দেশে তেমন নেই। শুধুমাত্র বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের উৎসব আসলেই মনে হয় প্রাণ ফিরে পেল দেশের মৃতপ্রায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। উৎসব শেষে আবার ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে এ সঙ্গীতের উত্তাপ। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট্ট দেশে রয়েছে ২৫ টিরও বেশি বেসরকারী টিভি চ্যানেল। এতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রচার তেমন নেই। যদিওবা দু’একটি চ্যানেলে কখনও-সখনও প্রচার হয়, কিন্তু তার পরিধি এত সীমিত যে কেউই বুঝতে পারে না কখন কি হয়ে গেল। এ প্রসঙ্গে ফরিদপুরের প্রবীণ শিল্পী প-িত অমরেশ রায় চৌধুরী বলেন, আমার বয়স এখন ৮৮ বছর। আমার সঙ্গীত জীবনে কখনই দেখিনি বাংলাদেশে শ্রোতারা রাত জেগে তিন চার দিন ধরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনে, যা কয়েক বছর ধরে ঢাকায় বেঙ্গল আইটিসি উৎসবে দেখেছি। সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছি যে, আমাদের দেশে সারারাত জেগে সঙ্গীত শোনার মানুষ আছে। তবে আরও বেশি বেশি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হওয়া উচিত। দেশের প্রথিতযশা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ও শিক্ষক অসিত দে বলেন, যদি কেউ বলেন, আমাদের দেশে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত চর্চা হচ্ছে না, আমি তাদের সঙ্গে দ্বীমত পোষণ করব। কারণ, এখন নতুনদের অনেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং তারা নিয়মিত চর্চাও করছে। তবে তারপরও বলব, এটা যথেষ্ট নয়। শাস্ত্রীয়সঙ্গীত একটি ভাল শিল্প কিন্তু এর পরিচয় তেমন নেই। এর পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব প্রচার মাধ্যমের। দেশে এতগুলো টিভি চ্যানেল আছে তারা এ সঙ্গীত প্রচারে নিস্ক্রিয়। তাদের বক্তব্য, শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের ক্ষেত্রে স্পন্সর পাওয়া যায় না। প্রিন্ট মিডিয়াও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে উদাসীন। এ সঙ্গীত নিয়ে বছরে দু’একটি লেখা তারা প্রকাশ করে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অনেক বিপত্তির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী আলী এসএম রেজোয়ান বলেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে উল্লেখযোগ্যভাবে দাঁড় করানোর কোন প্লাটফর্ম আমাদের দেশে নেই। দেশে এতগুলো টিভি চ্যানেল আছে তারা কেউই নিয়মিত শাস্ত্রীয়সঙ্গীত প্রচার করে না। শাস্ত্রীয়সঙ্গীতকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের একটা বড় ভূমিকা আছে। সরকার যদি প্রতিটি চ্যানেলে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত প্রচার বাধ্যতামূলক করে দেয় তা হলে কিছুটা হলেও এ সঙ্গীতের প্রতি মানুষের একটা আগ্রহ তৈরি হবে, নতুনরাও এ সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধাভরে এগিয়ে আসবে। বিদগ্ধজনরা বিরক্ত হলেও এ কথা সত্যি যে, এ প্রজন্মের অনেকের কাছে ক্লাসিকেল গান মানেই একটি বিরক্তির বিষয়। এ প্রজন্মের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপও দুষলেন প্রচার মাধ্যমকে। তিনি বলেন, মাঝে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিথিলতা এসেছিল কিন্তু এখন অনেকটা সে ঘোর কেটে গেছে। চর্চা হচ্ছে, নতুনরা আগ্রহ প্রকাশ করছে এবং শ্রোতার সংখ্যাও বাড়ছে। নতুনরা কেন এ সঙ্গীতের প্রতি বেশি আকৃষ্ট নয় এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শাস্ত্রীয়সঙ্গীত হচ্ছে আয়েশী সঙ্গীত। এর ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলে প্রকৃত রস আস্বাদন সম্ভব নয়। যুগের সঙ্গে সঙ্গে সময় স্বল্পতার কারণে এখন চলতে চলতে গান শোনা হয়। এ কারণেই হয়ত নতুনদের কেউ কেউ শাস্ত্রীয়সঙ্গীত পছন্দ করতে চান না। আমাদের দেশে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পীদের উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানী দেয়া হয় না। সে কারণে অনেকটাই এ সঙ্গীতের জৌলুস হারিয়েছে। তবে আমাদের দেশে এ সঙ্গীতকে বাঁচিয়ে রাখতে শিল্পীদের পাশাপাশি প্রচার মাধ্যমেরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্লাসিকেল গানের অডিও সিডি প্রকাশ করতে তেমন আগ্রহী নয়। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে তারা এতে লাভবান তো হয়ই না, রবং লোকসানের ঘানি টানতে হয়। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজার ভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ক্লাসিকেল গান শোনার শ্রোতা কোথায়? আমাদের দেশে আধুনিক গানের শ্রোতাই তেমন নেই, সেখানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতো শুদ্ধ ও কঠিন গানের শ্রোতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবুও নিজেদের সদিচ্ছা থেকে কোন কোন সময়ে শাস্ত্রীয় গানের সিডি প্রকাশ করে থাকি। এ কথা সত্যি যে আমাদের দেশে হাতেগোনা কয়েকজন আছেন তাঁরা রিয়েল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত করেন। অনেকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে প্রথিতযশা ওস্তাদ বা গুরুর কাছে তালিমও নিয়ে থাকেন। কিন্তু তেমন অনুষ্ঠান বা সিডি প্রকাশের সুযোগ না থাকায় অনেকেরই টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। কেউ কেউ নজরুল, রবীন্দ্র অথবা অন্যান্য গানের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন। বাস্তবতার নিরিখে এটা করতে বাধ্য হতে হয় তাদের। প্রশ্ন হলো, শিল্পীর সারা জীবনের শিল্প সাধনার গন্তব্য কি তাহলে টিউশনি? এভাবে চলতে থাকলে দেশের প্রকৃত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভবিষ্যত কি তাহলে অনিশ্চিতের দিকে ধাবিত হবে না? তাহলে আমাদের দেশের শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের বর্তমান ও ভবিষ্যত কি? এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী অসিত রায় বলেন, শাস্ত্রীয়সঙ্গীত কোন এক সময়ে রাজা অথবা জমিদারকেন্দ্রিক ছিল। দেশ বিভাগের পর এর পৃষ্ঠপোষকতা উঠে যায়। সে শূন্যতা আর পূরণ হয়নি। অনেকে ভারত থেকে শিখে আসছেন কিন্তু তা আর চলমান থাকে না। নতুনদের ভেতর সম্ভাবনা কিছু দেখা গেলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে তাদের পক্ষে সেগুলো ধরে রাখা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রশিক্ষণে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী আসা উচিত, তা হচ্ছে না। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত টিকিয়ে রাখা অনিশ্চিত। অনেক গণমাধ্যম রাগসঙ্গীত প্রচার করতে চায় না শ্রোতার রুচি নেই বলে। কিন্তু প্রচার-প্রসার ছাড়া কোন শিল্পকর্মই টিকে থাকা সম্ভব নয়। জনরুচি বাড়ানোর দায়িত্ব শিল্পী ও প্রচারমাধ্যম উভয়ের। চ্যানেলগুলোর উচিত একদিন রকশো দেখালে, আরেকদিন মানসম্মত রাগসঙ্গীতের অনুষ্ঠান দেখানো। বিটিভির মতো রাত ১১টার পর পাঁচ মিনিটের খেয়াল যথেষ্ট নয়। রাগ সঙ্গীতের প্রসারে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, ছায়ানট কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে তা আরও বিস্তৃত আকারে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া উচিত, তা হলেই উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও উস্তাদ বিলায়েত খাঁ’র জন্মভূমি বাংলাদেশে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের সুবাতাস বইবে আশা করা যায়।
×