ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদেরও

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ১৭ জুন ২০১৬

রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদেরও

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের মেধাবী ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর নির্মম এবং পৈশাচিক হত্যাকা-ের কোন সুরাহা হওয়ার আগেই আবারও নৃশংসতার বলী হলেন মাহ্্মুদা খাতুন মিতু। তিনি পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা বাবুল আখতারের স্ত্রী। তনু হত্যাটি সংঘটিত হয় রাতের অন্ধকারে এবং কুমিল্লা সেনানিবাসের নিরাপদ পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে। আর মিতুকে হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে দিবালোকে চট্টগ্রামের জিএসসি মোড়ের জনবহুল সড়কটিতে ধর্মান্ধ জঙ্গী গোষ্ঠী যেভাবে একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে ধর্মের নামে নিষ্ঠুর পাশবিক আক্রমণের মধ্য দিয়ে। তা যেমন বেদনাদায়ক তেমনি নিপীড়নমূলক। এই দুই মহিলা কোন অশালীন পোশাক কিংবা অমার্জিত বেশভূষায় ছিলেন না। দু’জনেই অত্যন্ত পরিশীলিত, পরিমার্জিত এবং শালীনভাবেই জীবনযাপন করতেন। হত্যার সময় তাদের পরিহিত বস্ত্রই এর সত্যতা নির্দেশ করে। তবুও তাদের জিঘাংসার শিকার হতে হলো? কেন? তনু হত্যার পর পর দুটো ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আজ পর্যন্ত সুস্পষ্টভাবে খোলাসা করা হয়নি কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ থেকে। সারাদেশ প্রতিবাদ, বিক্ষোভে সোচ্চার হলেও এই হত্যাকা-ের আজ অবধি কোন কূলকিনারা হয়নি। এর মধ্যে নতুন করে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহ্মুদা খাতুন মিতুর পৈশাচিক হত্যাকা-টি দেশবাসীকে চমকে দেয়। বিস্ময়ে হতবাক সবাই কি করে এমনিভাবে একের পর এক খুনের মতো অমানবিক নিষ্ঠুর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে মাহ্মুদা খাতুন মিতু এখানে জঙ্গীদের জিঘাংসার নির্মম বলী হয়েছেন। স্বামী বাবুল আখতার দক্ষ, সাহসী, নিবেদিত এবং দেশপ্রেমিক পুলিশ কর্মকর্তা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জঙ্গী আস্তানা ও জঙ্গী তৎপরতার বিরুদ্ধে তাঁর সাঁড়াশি অভিযান দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। কোন ভয়, ভীতি, বাধা, প্রতিবন্ধকতাকে তোয়াক্কা না করে দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় জঙ্গী দমনে ভয় দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন তারই পরিণতি পরিবারের এই অসহনীয় দুর্যোগ। মাতৃহারা দুটি অবোধ শিশু। পতœীবিয়োগে বার বার মূর্ছিত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আখতার! কর্মক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা এবং যোগ্যতার পুরস্কার তাঁকে সরকার দিলেও দেশের অশুভ, কালো পেশীশক্তি তাঁর সব আশা-আকাক্সক্ষা এবং ইচ্ছাশক্তিকে নির্মমভাবে আঘাত করে। যেভাবে মিতুকে নিষ্ঠুর এবং পাশবিক উপায়ে খুন করা হয় তাকে যেমন বিবেক-বর্জিত তেমনি মনুষ্যত্বের চরম অপমান। বোরখা এবং হিজাব পরিহিত মিতুকে ঘাতকরা যেভাবে চাপাতির আঘাত এবং গুলি করে তা সত্যিই লোমহর্ষক। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান থেকে এসব তথ্য বের হয়ে আসে। নিরাপরাধ নারীদের ওপরও সশস্ত্র হামলা চালাতে এসব দুর্বৃত্তের এতটুকু হাত কাঁপেনি, বিবেক তাদের দংশিত করেনি, মানবিক মূল্যবোধ তাদের নিবৃত করতে পারেনি। জানি না আজ আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি। কাকে মেরে ফেলছি, কি কারণে একজনের মূল্যবান জীবন এভাবে হরণ করছি, এসবের কোন বোধ বিবেচনাশক্তি আজ নৃশংস মানুষদের মধ্যে কাজ করে না। যে জীবন দেয়ার ক্ষমতা কারও নেই তাকে নেয়ার অধিকার কি কারও থাকা উচিত? কোন ধর্মই অন্যায়, অবিচার, নৃশংসতা, জীবননাশকে সমর্থন করে না। যুগে যুগে ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে বিশ্ব শান্তির জন্য, জনকল্যাণের জন্য। ধর্মীয় অবতারণা সবাই আমাদের সে বাণীই শুনিয়ে গেছেন। অন্যভাবে ধর্মীয় পুরোহিতদের ওপর যে উপায়ে আঘাত হানা হচ্ছে সেটাও কোন মাঙ্গলিক পরিণতি ডেকে আনবে না দেশের জন্য। মুক্তচিন্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সসম্মানে নারীর অধিকার নিয়ে বাঁচা, মনুষ্যত্বের দাবি নিয়ে নিজের অবস্থানে টিকে থাকা সব মানুষের জন্মগত এবং মৌলিক চাহিদা। এই সবের ব্যত্যয় হলে কোন সমাজ সুস্থভাবে এগিয়ে যেতে পারে না, সভ্যতার গতি শিথিল হয়ে যায়, মানবতার জয়গান হুমকির মুখে পড়ে। সুতরাং সবাই মিলে এই নৃশংস, ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে সাহসী পদক্ষেপে দাঁড়াতে হবে। অত্যাচারী অথবা অপরাধী যেই হোক না কেন তাদের চিহ্নিত করার দায়ভাগ আমাদের সবার। শুধুমাত্র সরকার কিংবা আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর নয়। আমরা যদি প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হই আমাদের আশপাশে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা, দুর্বৃত্তরা কখনও পার পেয়ে যেতে পারে না। প্রতিটি নাগরিককেই এই বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।
×