ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিখ্যাত দুই লেখকের জেল জীবন

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ১৭ জুন ২০১৬

বিখ্যাত দুই লেখকের জেল জীবন

‘ডিভাইন কমেডি’র মহাকবি দান্তের পুরোটা জীবনই ছিল যেন একটা কারাবাস। নিজ দেশে পরবাসী, ব্যক্তিগত জীবনের করুণ অবস্থা, নরকোচিত অভিজ্ঞতাই ফুটে উঠেছে ডিভাইন কমেডির অলিতে গলিতে। ‘ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট’ এর লেখক দস্তয়ভস্কির দিকে খেয়াল করলেও দেখব একেবারে মৃত্যুদণ্ড থেকে ফেরা ব্যক্তির সাহিত্যভুবন জয় এবং সমগ্র জীবনই যেন জেলবাস বা নরকবাসের সঙ্গে তুল্য। এত কঠিন, কঠোর ও নির্মম জীবন নিয়ে এত সৃষ্টির ফুল ফুটান কিভাবে এটা আসলেই বিস্ময়ের বিষয়। কথিত আছে যে, স্প্যানিশ সাহিত্যের সেরা সাহিত্যিক মিগেল দ্য সেরভানতেসের ‘ডন কিহাতে’ এর অনেকখানি নাকি জেলখানায় বসে লেখা। ‘ডন কিহাতে’ এমন একটি উপন্যাস যার সঙ্গে তুলনা করে অন্য সাহিত্যের মান নির্ধারণ করা হয়। কিছুদিন আগে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মৃত্যুর পর তার অবস্থান নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। তার ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা’ স্প্যানিশ সাহিত্যের কি সেরা সৃষ্টি এই প্রশ্ন তোলা হলে দেখা যায় যে, ‘ডন কিহাতে’কে প্রথমে রেখে তারপর দ্বিতীয়, তৃতীয়ের তালিকা করা হয়। স্প্যানিশ সাহিত্যের এই সর্বকালের সেরা সৃষ্টিটি জন্ম নিয়েছে জেলখানায়, এটা অনেকেরই মনে বিস্ময়ের জন্ম দিতে পারে। বন্দী ও বদ্ধ জীবনে, জীবনের কষ্টকর অভিজ্ঞতাগুলোর চিরায়ত রূপ দিয়েছেন সেরভানতেস। এই প্রতিকূল পরিবেশে এটি লিখতে গিয়ে তিনি সাহিত্যের অনেক প্রচলিত রীতিনীতি ভেঙ্গে দিয়েছিলেন যা পরবর্তী শতকগুলোতে মান হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ‘ডন কিহাতে’ নিয়ে এডিথ গ্রসম্যান তার ২০০৩ সালের অনুবাদের ভূমিকায় লেখেন, ‘ডন কিহাতে’তে সৃষ্টিশীল উপন্যাসের সব কৌশল, ছলাকলাই ব্যবহার করা হয়েছে যা পরবর্তীতে সব লেখক, সাহিত্যিক তাদের রচনায় নিয়ে এসেছেন।’ সেরভানতেসের লেখায় বাস্তুবাদ, আধুনিকবাদ, উত্তরাধুনিকবাদ, প্রকরণের মিশ্রণ এবং সব আধুনিক কলাকৌশলের যোগাযোগ ঘটেছিল। তিনি তার সময়ের চেয়ে কয়েক শতক এগিয়ে ছিলেন তার চিন্তায়। সেরভানতেসের এই মাস্টারপিসটি বন্দিত্বের কঠোর মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নে বের হয়ে এসেছে। ‘ডন কিহাতে’কে বিভিন্ন সমালোচক, সাহিত্যিক বোদ্ধারা বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাখ্যা করে এসেছে এবং বিভিন্ন সাহিত্যিক, লেখকদের লেখাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে এটি প্রভাব রেখে এসেছে। ফিয়োদয় দস্তয়ভস্কির লেখাতে এর বেশ প্রভাব আছে এবং তিনি এটা স্বীকারও করেছেন। সেরভানতেসের মতো আরেকজন বিশ্বসেরা লেখক দস্তয়ভস্কিরও জেল খাটার অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তার লেখাতেও এর প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে। তিনি ‘পুওর ফক’ নামে একটি উপন্যাস লিখে ফেলেছেন যখন এরপরই তাকে জেলে পুরা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সে বামপন্থী সেন্ট পিটার্সবার্গের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জেলে কয়েক মাস কাটানোর পর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যদের সঙ্গে তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয়। একেবারে শেষ মিনিটে রাশিয়ার মহাপ্রতাপশালী জার মৃত্যুদণ্ড মুলতবি ঘোষণা করেন। কিন্তু তাকে আরও ৪ বছর জেল খাটতে হয় এবং প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। তাকে পাঠানো হয় সাইবেরিয়ান গুলাগ এলাকাতে। দস্তয়ভস্কির জেলখানার অভিজ্ঞতা তার লেখায় ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে। তার সেরা সৃষ্টি ‘ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট ও ‘ব্রাদার কারামাযভ’ লেখার পেছনে জেলখানার জীবনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব অনেক কাজ করেছে। জেমস জয়েস দস্তয়ভস্কিকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘দস্তয়ভস্কি আধুনিক গদ্য সৃষ্টি করেছেন এবং বর্তমানের রাস্তায় তুলে দিয়ে গেছেন।’ ১৮৬১ সালে প্রকাশিত তার ‘হাউস অব দি ডেড’ অথবা ‘প্রিজন লাইফ ইন সাইবেরিয়া’ জেল জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ উপন্যাসটি লেখা হয়েছে এক কয়েদির জবানিতে যে তার স্ত্রীকে খুন করেছিল। জেলের ভেতর কিভাবে ভোদকা আর তামাক বাণিজ্য চলে এবং চুরি চামারি যেন নিত্য ঘটনা এর কথাও বলা হয়েছে। উপন্যাসটির কাল্পনিক কয়েদিরা বার বার শুধু মুক্তির স্বপ্ন দেখে যেমনটা দেখত হয়ত তার লেখক! -টুটুল মাহফুজ
×