ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পিন্টু রহমান

হাওড় পাড়ের কইন্যা

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ১৭ জুন ২০১৬

হাওড় পাড়ের কইন্যা

রামদা! সরু এবং ধারালো, রূপজান ঈর্ষান্বিত চোখে ওই রামদাটার পানে তাকায় আর ভাবে, ভাবে আর তাকায়। হায়, দা’টার যেন এখন ভরা যৌবন, শরীরে উথাল পাথাল ঢেউ! সূর্যের আলোয় এক একবার ঝিলিক দিয়ে ওঠে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে গায়ে হাত বুলায়। তারপর এক ঝাটকায় রসুই ঘরের সামনে ফেলে দেয়। খুচরা পয়সার মত তখন ঝনাৎ করে শব্দ হয়। ফুলি আড়চোখে তাকায়। বুঝতে পারে, এবার আওলা বাতাস উঠবে। রূপজান গলা ছেড়ে চিৎকার দেয়, এ্যাই ফুলি কি হইতিছে রে, হারামজাদাটা অমন কইরি কানতিছে ক্যান, এখনো সময় আছে, ওরে থামবার ক। মিজাজটা কিন্তুক ভালা না। আছাড় দিয়া ফ্যালাইয়া দিমু কইলাম! মামুনকে থামানোর জন্য ফুলি প্রাণপণ চেষ্টা করে কিন্তু কাজ হয় না, উল্টো পান্তার বাটিতে লাত্থি মেরে ফেলে দেয়। সে এখন গরম খাবে, গরম ভাত। বোনের কোলে চড়ে মায়ের কাছে পুনঃপুন ভাতের আবদার করে, আমালে ভাট দেও মা, আমি ভাট খাব। পরিশ্রান্ত শরীরে এতসব জ্বালাতন রূপজানের সহ্য হয় না, ছেলেটাকে শূন্যে তুলে আছাড় মারে। চকির উপর থেকে ফেলে দেয়। তারপর সর্বশক্তি নিয়োগ করে কিলঘুষি চালায়, কুত্তার বাচ্চার কত্ত বড় সাহস, পান্তার বাটিতে লাত্থি দেয়! ঐ খানকির পোলাই কি জানবার পারে, পান্তার জন্য কত কষ্ট কইরিছি! নিজির পেট খালি কইরি ওর জন্যি রাইখি দিছি! এত জ্বালা আর সহ্য হয় না। মরণ দেও খোদা, আমি মরবার চাই। মার খেয়েও তার কান্নায় কোন হেরফের হয় না। ভাতের দাবিতে অনড় সে। অগত্যা মামুনকে কোলে নিয়ে ফুলি পাশের বাড়ি চলে যায়। রূপজান কপাল চাপড়িয়ে নিরিবিলি কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে। আল্লাহর দরবারে অসংখ্য ক্ষোভ-আক্ষেপ তার। জন্মদাতা পিতার প্রতিও অসংখ্য অভিমান! ধনীর ঘরে জন্ম নিলে জীবনের হিসেবটি নিশ্চয় অন্যরকম হতে পারতো, কিংবা বিনা চিকিৎসায় মরতে হতো না! অভিমানের আড়ালে চোখের পাতায় জলের ধারা বয়ে যায়। এমন কান্নার অবশ্য কিছু ভাল দিকও আছে। বুকের নানা রকম ক্ষোভ, দুঃখ জলের সাথে বেরিয়ে যায়। দিলটা পরিষ্কার হয়। কাজে কামে উদ্দামতা ফিরে আসে। খালুই আর জাল হাতে রূপজান হাওড়ের পথ ধরে। এভাবে বসে থাকলে তো আর চলবে না! মাছ না ধরলে তিন তিনটি প্রাণী অভুক্ত থাকবে। কারো মুখে হাত উঠবে না। আর যা দিনকাল পড়েছে, ক্ষুধার জ্বালায় কোলের শিশু চিৎকার করে কাঁদলেও কেউ একমুঠো ভাত দেয় না। হাওড়ের বুক চিরে সে অনেক দূর পর্যন্ত যায়। চারদিকে অথৈই জলরাশি। জলের কাছে এলে রূপার কিন্তু মন্দ লাগে না, মনে হয় জল আর সে অভিন্ন! আর যাই হোক জলের কল্যাণে সংসারের অচল চাকা সচল রাখতে পেরেছে, দু’মুঠো ভাতের বন্দোবস্ত হয়েছে। রূপজান একা না, তার মতো অসংখ্য মানুষের জীবন এই হাওড়ের কাছে বাঁধা। বাতাস পড়ে গেলে খুব অস্থির লাগে। সেদিন আর হাওড়ে মন বসে না, তিরতির করে শরীর ঘেমে ওঠে। কপালের জল হাওড়ের জলের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যাদের নৌকা আছে তারা নৌকার ওপর গড়াগড়ি দেয়, ক্লান্তির রেশ কাটাতে পাতার বিড়িতে বুন্দার আগুন লাগায়। কিন্তু আজকের অবস্থা আলাদা, আকাশে মেঘ থাকলেও বাতাসের অভাব নেই। ডাঙা থেকে জলে ধোয়া বাতাস এসে শরীরময় লুটিয়ে পড়ে। আহ, কি প্রশান্তি! মাথার উপর দিয়ে একটা জলপাখি উড়ে যায়। হাওয়ার ডানায় ভর করে উড়ে যায় দুধ-সাদা মেঘের ভেলা! অন্যান্য দিনের তুলনায় মাছের আমদানি বেশ ভাল। তার জালে টপাটপ কতগুলো মাছ বাঁধে। কি চমৎকার সব মাছ! খালুইর মধ্যে মাছগুলো লাফালাফি করে- তার নিজের মধ্যেও খুশির উচ্ছ্বাস! একটু একটু করে মনের বিক্ষুব্ধ ভাব কেটে যায়। সে এখন নূপুর পরা কিশোরীর মতো উৎফুল্ল যেন-বা! গুনগুন করে গান আওড়ায়। ইউনিয়ন বোর্ডের এবড়ো-থেবড়ো হেরিং রাস্তা ধরে ভুবনডাঙার দিকে হাঁটতে থাকে। স্থানীয় ফড়িয়াগুলো বেজায় বজ্জাত। মাছের ঠিকঠাক দাম দিতে চায় না। নানারকম ফন্দিফিকির। ওজনেও হেরফের। শুধু ঠকানোর তালে ব্যস্ত। গতরে কষ্ট হলেও রূপা তাই ভুবনডাঙায় যায়। যাচাই-বাছাই করে দরদাম করতে পারে। তাতে দুটো পয়সা বেশি আসে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। দূর থেকে পিদিমের আলোয় মামুনের মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়। ভাই বোন মিলে সুর করে কবিতা আওড়াচ্ছে। রূপাকে দেখে ছেলে তার গলা জড়িয়ে ধরে, আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে, এটো ডেলি কল্লি ক্যান মা? সকালের মারের কথা আর মনে নেই। ভালবাসার ছোঁয়ায় সব ভুলে গেছে। মামুনের গালে মুখে রূপজান চুমা দেয়। কোলের মধ্যে নিয়ে আদর করে। মিহি সুরে মেয়ের নাম ধরে ডাকে, ফুলি, এই ফুলি। রসুই ঘরের দুয়ার বন্ধ করে ফুলি মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। মায়ের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, কি বলতিছ মা? কিছু রানছিস? হ, রানছি; তয়, এখনো খায়নি। রূপার মেয়েটা বড়ই লক্ষ্মী। সহজ সরল। কাজে কামে উদ্যম আছে। মা’র সাথে এক আধদিন মাছ ধরতেও যায়। রাত্রে ওরা তৃপ্তি করে খায়। তারপর শুয়ে শুয়ে ঘুম পাড়ানি গান করে। হরেক পদের গল্প শোনায়। ছেলে মেয়ে ঘুমালেও অনেক রাত পর্যন্ত রূপার ঘুম হয় না। থেমে থেমে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। মাথার মধ্যে অগোছালো চিন্তা। মেয়েটা ডাঙর হয়েছে। ওর স্ফীত বুকের দিকে তাকালে ভয় হয়। কখন যে কার কু-দৃষ্টি পড়ে, ঠিক ঠিকানা নেই! এই নিয়ে ভীষণ চিন্তা হয়। অন্ধকারে বাড়ির চারপাশে পায়চারী করে। তীক্ষè দৃষ্টিতে কি যেন অনুসন্ধান করে। আনমনে হাওড়ের তীরে এসে দাঁড়ায়। ভরা বর্ষা মৌসুম। মেঘের আড়ালে নক্ষত্রগুলো হারিয়ে গেছে। অথৈই জলের ঢেউ এসে পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হয়তো বশ্যতা স্বীকার করা। কিন্তু রূপজান একথা বিশ্বাস করে না। মেয়ে মানুষের মত হাওড়েরও ষোলকলা, ক্ষণে ক্ষণে ওরা খেলা দেখায়- ষোলকলার খেলা! জন্মের পর থেকে রূপা এই খেলা দেখে আসছে। ফুলির বাপের কথা মনে হয়, এমন বর্ষা মৌসুমে হাওড়ের বুকে মানুষটা একদিন মাছ ধরতে গিয়েছিল আর ফিরেছিল লাশ হয়ে। মামুন তখন কোলে। পূবালী বাতাসে শরীরটা হীম হয়ে যায়। লোমগুলো কাঁটা দিয়ে ওঠে। জীবনের ঐ দুঃসহ স্মৃতি ধবল মেঘের মত সারাক্ষণ তার পিছু নেয়। রূপজান দৌড়ায় আর দৌড়ায়। দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে ক্লান্ত, অবসন্ন সে। বুঝতে পারে না, আর কত ছুটবে, কোথায় তার গন্তব্য! মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীটা অর্থহীন, মরণের গহীন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়াই বোধহয় জীবনের একমাত্র ধর্ম-বাকি সব মিথ্যা, অলিক। যেদিন কাজে-কর্মে মন বসে না, অফুরন্ত অবসর থাকে রূপজান সেদিন রামদাটায় ধার কাঁটে, ঠিক আছে কি না হাত বুলিয়ে পরখ করে। দা নিয়ে ফুলির মধ্যে অসংখ্য কৌতূহল। সপ্তর্পণে মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে গালে হাত রেখে প্রশ্ন করে, ওমা, ইডা দিইয়ে তুমি কি করবা শুনি? রূপা আড়চোখে মেয়ের মুখের পানে তাকায়। একটু ভেবে উত্তর দেয়, ইডা দি শিয়াল কাইটবো। আইচ্ছা, আজো কি একখান শিয়াল মাইরিছ! রূপজানের হাতের মুষ্টি আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়। উত্তর দিতে গিয়ে শক্ত চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, নাঃ! বার বার ফস্কাইয়ি গিইছে, তয় এইবার আর না, শিয়ালের জন্যি সারারাইত কান খাড়া কইরি শুয়ি থাকি, একবার সুযোগ পাইলি হয়, কচুকাটা কইরি ফেলামু! রূপজান দৃঢ় প্রত্যয়ে রামদাটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। বিস্ফোরিত চোখ। ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাস। ফুলির বাপ যেবার মারা যায়, সেবার হঠাৎ করেই শেয়ালের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যা নামলেই বাড়ির আনাচে কানাচে ওঁৎ পেতে বসে থাকতো। টর্চের আলোর মতো জ্বলজ্বলে চোখ। লোলুপ দৃষ্টি। কখনো একা, কখনো বা দল ধরে আসতো। তৃষ্ণার্ত বুকে আকুপাকু করতো। ভয়ে রূপার ঘুম হতো না। পিদিমের আলোয় রক্তে আগুন ধরাতো। ভাগ্যিস রামদাটা ছিল, তা না হলে শরীরটা ছিঁড়ে ফুঁড়ে খেত। জীবনের ঐসব দিনগুলোর কথা মনে হলে রূপজান এখনো আঁতকে ওঠে। মাঝে মাঝে মনে হতো সে বাঁচবে না, শিয়ালগুলো তাকে বাঁচতে দেবে না। কতদিন পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছে কিন্তু ঐ ভাবনাও ছিল অস্থায়ী। কেননা, শিয়ালহীন পৃথিবী তার কল্পনারও অতীত! নিরুপায় হয়ে মাজা শক্ত করে দাঁড়িয়েছে, যুদ্ধের মন্ত্র জপেছে। নতুন করে আবার শেয়ালের আনাগোনা শুরু হয়েছে। এবার আর তাকে নয়, শেয়ালগুলো ফুলিকে চায়। ওর ডাঙর শরীরের উপর নজর পড়েছে। কদিন আগে একটা তাড়া করেছিল। কিন্তু অল্পের জন্য ধরতে পারে নি। গত দু-দিন ধরে জ্বর ছেলেটার। এই নিয়ে মা মেয়েতে বাদানুবাদ হয়। কাজ নি, কাম নি, সারাদিন কি করিস তুই, ভাত খাইতি লজ্জা করে না? ক্যান, কি কইরিছি আমি? মামুন্যারে দেইখি রাখতি পারিস নি, হাওড়ের জলে ভিইজি ভিইজি যে জ্বর বাঁধাইছে! নিচু গলায় ফুলি তার মার কথার প্রতিউত্তর করে, ও জ্বর বাঁধাইছে, তয় আমি কি করুম? তুমার ছাওয়াল কি আমার কথা শুনবার চায়? তেচোখা মাছের লাইগি ছুইটি বেড়ায়। ক্রোধের উত্তাপে রূপজান ফুঁসে ওঠে। মেয়েকে উদ্দেশ করে গালিগালাজ করে, ও ছুইটি বেড়ায় আর তুই ঘোড়ার ঘাস কাটিস, তাই না? লজ্জা শরম কিচ্চু নি, মাগি খালি পাড়ায় পাড়ায় ঘুইরি বেড়ায়! তোর ভাত খাইতি লজ্জা করে না! ফুলি নির্বাক। মায়ের পানে তাকাতেও তার ভয় হয়। রূপা বকতে বকতে হাওড়ের পথে পা চালায়। ফুলির মনটা মেঘলা আকাশের মত অন্ধকার। অভিমান করে সারাদিন ভাত খায় না। ঘরের দাওয়ায় বসে অঝোরে চোখের জল ফেলে। মামুন ফুলির কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিলে ডিডি, তুই কান্টিছিস? গালায় ঝাঁঝ মিশিয়ে ফুলি বলে, হ কানতিছি। তোর জন্যিই তো মা আমাকে বকতিছে। মামুন ওকে শান্ত¡না দেয়, কান্ডিসনি ডিডি, মা বকলি কান্টি হয় না। মামুনকে নিয়ে ফুলি শালুক তুলতে যায়। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। কাঁচা শালুক চিবিয়ে-চিবিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে। শালুক চিবাতে দেখে মামুন ফোকলা দাঁতে হাসে, তারপর কাছে সরে এসে জিজ্ঞেস করে, খাটি কেলাম লাগছে লে ডিডি? খুউব মজা, তুই খাইবি? মামুন মাথা ঝাকায়, না, আমি মাছ ঢলবো, যাবি আমাল সাটে? ফুলি রাজি হয় না। মা বকবে। ভাইটাকে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে আসে। দুই. উঠানে যেন কেউ একজন দাঁড়িয়ে! রূপজান সারসের মতো ঘাড় উঁচু করে তাকায়। আবছা অন্ধকারে লোকটাকে ছায়ামূর্তি মনে হয়। গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়ে, এত রাইতি কিডা ওখানে? লোকটি খুশ খুশ করে কেঁশে তার উপস্থিতি জানান দেয়, রূপা বু আমি, আমি মজু ব্যাপারি। রূপা খানিকটা হতাশ হয়! কিংবা এইমাত্র একটা শিয়াল যেন তার হাত-ফসকে বেরিয়ে গেল! অ মজু, তা এত রাত্রি কি মনে কইরি? এদিক দিয়ে যাইতিছিলাম, তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু গপ্ সপ্ করি। ব্যাপারি চৌকাঠের উপর বসে। এক খিলি পান মুখে পুরে গরুর মতন জাবর কাটে, বুজান, খাইবা নাকি এক খিলি? জব্বর মিঠাই, গঞ্জ থ্যিইকা লইয়ি আইছি। পানের প্রতি রূপার অরুচি, না, আমি খাইতাম না। মাথার মইধ্যে চক্কর দেয়, চক্ষে আন্ধার দেখি। ক্যান, কি হইতিছে তুমার? রূপা উত্তর দেয় না। মজুকে লক্ষ করে। লোকটা আড়চোখে কাকে যেন খুঁজছে! রূপা বু, ফুলি কই, তারে দেখতিছিনি তো? ঘুমাইতিছে। মজু ব্যাপারি উচ্চস্বরে হাসে, অকারণ হাসি। ফুলির প্রশংসায় পঞ্চমুখ সে, খুব লক্ষ্মী ম্যাইয়ি। মাইনষের মুখে মুখে সুনাম। দেখতি নাকি রাজকন্যির মতন! এক্কেবারে তুমার গড়ন পাইছে। রূপজানের হাতদুটো নিশ্পিশ্ করে। চোখে মুখে আগুনের ফুলকি। ব্যাপারি লোকটাকে তার একদম পছন্দ হয় না, মজু ব্যাপারি, তুমি কি কিছু কইবার চাও? মজু লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কি আর কইবোরে বোইন! তোমাগোরে ল্যাইগি দুঃখ হয়, বুকির মইধ্যি ফাইটি যায়। আহাঃ রে, ফুলির বাপ থাকলি কি আর এমুন হইতো? তুমার বাড়িত চাঁন্দের বাজার বসতো। ফুলজান ইচ্ছে করে প্রসঙ্গ বদলায়, ও মজু, তুমার বৌ কি বাড়িত নাই? মজু শুষ্ক হাসি হেসে জানায়, ক্যান, তুমি জানো না, হেই তো ম্যালাদিন থ্যাইকা বাপের বাড়ি। পয়লা পোয়াতি। তাই বাপ-মা এইখানে রাখবার চায় না। রূপার মনটা অন্ধকারের মধ্যে মিশে যায়। বুকের মধ্যে গুমরে ওঠে। রাতে ভাল ঘুম হয় না। হাওড়ের বুকে এলোমেলো বাতাস। মনে হয় বাতাসটা বড় অপয়া, অলক্ষুণে। মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে গভীর দৃষ্টিতে মেয়ের পানে তাকায়। মজু ব্যাপারি মিথ্যা বলেনি, তার মেয়েটা সত্যি সত্যি সুন্দরী, রাজকন্যার মত। হাতের ইশারায় ফুলিকে কাছে ডাকে। ডাকতিছ মা ? হ, আমাগোরে বাড়িত কি মজু ব্যাপারি রোজ রোজ আইসে? কয়েক মুহূর্ত ভেবে ফুলি উত্তর দেয়, হ আইসে, তুমি যখন থাক না ঠিক তখন আইসে। কি কইবার চায় লোকটা? রূপজানের জলে ভেজা শরীরে আগুনের আঁচ অনুভব করে। জাল বিছানো বন্ধ করে মাজা শক্ত করে দাঁড়ায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবেগ হঠাৎই উর্ধমুখী হয়। পুনরায় মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, কিরে, কি কইবার চায় সে! ফুলির সরল অভিব্যক্তি, নাহ, বুঝবার পারিনি। তয় মেলা রং ঢংয়ের কতা। আমারে লইয়ি সিনিমা দেখবার যাইতি চায়। তার নাকি সিনিমা দেখা খুব শখ। তুই কি কইস? কি কইবো, চুপ করি বইসি থাকি, সংসারের কাজকাম করি। মেয়েকে কটাক্ষ করে রূপা বলে, ক্যান, তর কি সিনিমা দেখতি যাইতি মন চায় না! ফুলি না সূচক মাথা নেড়ে মাছ ধরায় মনোনিবেশ করে। রূপা তখনো দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো গভীরভাবে মেয়ের মনের ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করে! ফুলির চিন্তায় রূপজান ইদানীং খুবই চিন্তিত। ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। মাছ ধরতে বা বাজারে গেলে মনের ঘরে অন্ধকার বিরাজ করে। নানামুখী আশংকা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। গরিব মানুষের এত রূপ থাকতে নেই, পদে পদে যন্ত্রণা। নিজে একবার সারাজীবন জ্বললো, আবার মেয়ের কপালেও তাই। ফুলিকে আজকাল চোখে চোখে রাখে। একটু আড়াল হলেই চিন্তা হয়। সন্ধ্যার আগেই ভুবনডাঙা থেকে ফিরে আসে। কিন্তু আজকে তার ফেরা অনিশ্চত। পরিবেশ প্রতিবেশ তার বিপক্ষে। আকাশের পানে তাকিয়ে বিচলিত হয়। মেঘগুলো পাথরের মত ভারি আর অনেক নিচে নেমে এসেছে। একটু পরেই হয়তো বৃষ্টি নামবে। বাজার শূন্য করে যে যার মত ঘরমুখো। তবুও একটু দামের জন্য রূপা অপেক্ষা করে। কিন্তু খদ্দেরের অভাব। ফলে পানির দরে মাছগুলো বিক্রি হয়। মোটা মোটা ফোঁটায় দড়বড়িয়ে বৃষ্টি নামে, প্রথমে আস্তে তারপর জোরে জোরে। নিজেকে রক্ষার জন্য সে এদিক ওদিক দৌড়ায়; মানকচুর পাতার আড়ালে লুকায়। ভুবনডাঙা থেকে ভরাম, রাস্তাটা তার মুখস্থ। জন্মের পর থেকেই যাতায়াত করছে। তরল অন্ধকারে চোখের পলকে কয়েকটা বাঁক পার হয়ে সম্মুখে এগোয়। স্থানে স্থানে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় কচুর পাতা উড়ে যায়। বৃষ্টির কাছে রূপা এখন সম্পূর্ণ অসহায়। কতদিন ভাবে একটা ছাতা কিনবে, কিন্তু সাধ্যে কুলায় না। গরিব মানুষের সাধ আহ্লাদ খুব সীমিত, অথচ পূরণের ব্যবস্থা সুদূর পরাহত। রূপজান বৃষ্টির গতির সাথে ছন্দ রেখে জোরে জোরে পা চালায়। বাড়ির জন্য চিন্তা হয়। দুদিন ধরে ডিব্বায় তেল নেই। ছেলে মেয়েগুলো বোধ হয় ঘোর অন্ধকারে! রূপজানের এবার অবাক হওয়ার পালা, এমন অবাক আগে কোনদিন হয়েছে কি না মনে করতে পারে না! উঠানে এসে শূন্য খালুইটা হঠাৎই তার হাত থেকে খসে পড়ে। ঘরের মধ্যে গোঙানীর শব্দ। লিপিস্টিক, চুড়ি, ফিতা উঠানের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ভিতরে মজু মজু ব্যাপারি জোকের মত ফুলির শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। মেয়েটি গলাকাটা মুরগির মতন হাত-পা ছুঁড়ে লাফাচ্ছে। কাতর কণ্ঠে অনুনয় বিনয় করছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ফুলির আহাজারী শূন্যে প্রতিধ্বনিত হয়। ব্যাপারি আদিম উল্লাসে দাঁত বিচড়িয়ে হাসে। তার বুকে যেন রক্তপিপাসা! আর কত, আর কত, এ দৃশ্য রূপজানের পক্ষে হজম করা অসম্ভব। নিঃশ্বাস বন্ধ করে মজুর ঘাড় বরাবর রামদাটা বসিয়ে দেয়। ব্যাস, এক কোপেই শেষ! মজুর শরীর হতে কল্লাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফুলি বাকরুদ্ধ। হাত-পাগুলো থরথর করে কেঁপে ওঠে। ঘটে যাওয়া ঘটনা পুনরায় মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। মনে হয়, পৃথিবীর কোন প্রান্তে যেন ভূমিকম্প শুরু হয়েছে, যেন এই মুহূর্তে পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবে! অথচ রূপার মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই, কোন অনুশোচনা নেই! মজুর লাশের উপর হাত উঁচিয়ে নাচানাচি করে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেয়, কে কুথায় আছ গো, তুমরা দেইখি যাও, আমি শিয়াল মাইরিছি- জব্বর একখান শিয়াল! রূপজানের ছোট্ট আঙ্গিনাটা লোকে লোকারণ্য। শুধু মানুষ আর মানুষ। কারো মুখে কথা নেই। মজুর শরীর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় কাঁচা রক্ত চুঁইয়ে পড়ে। পুলিশ আসতে আসতে দুপুর। রূপজানের হাতে হ্যান্ডক্যাপ লাগায়। সে আপত্তি করে না। পুলিশের পানে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে একবার তাকায় মাত্র। তারপর স্থির দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে অন্যত্র সরিয়ে নেয়। মাথার লম্বা চুল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ে। চেনাজানা মানুষ তাকে দেখে হতবাক হয়। কেমন অচেনা রূপ, অনেক বেশি শান্ত ও নির্ভার। ফুলির বাপ যেদিন মারা যায় সেদিনও এমন শান্ত ও নির্ভার মনে হয়েছিল! মামুন বুঝতে পারে, তার মাকে এবার নিয়ে যাবে। দারোগার জামা ধরে অবোধ শিশু টানাটানি করে, ওগো পুলিশ আমাল মাকে টুমলা কনে নি যাবা ? মা না ঠাক্লি আমাগেলে কিডা দেকবিনে ? পুলিশের মুখে কোন উত্তর নেই। ফুলি ভাইটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। মায়ের পানে তাকিয়ে কান্নাকাটি করে। রূপা তখন মুখ খেঁচিয়ে ওঠে, ওই ফুলি, কানতিছিস ক্যান, তর চোখের পানির কোন মূল্যি নি, মুইছি ফেল। আমার মতন শক্ত হ। তোর এখন ম্যালা কাম, মামুন্যারে বড় করতি হবি, শিয়াল মারতি হবি...।
×