ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

মায়াবতী ধলাই...

প্রকাশিত: ০৭:২২, ১৭ জুন ২০১৬

মায়াবতী ধলাই...

যদি কেউ এই অভিযোগ করে যে বাংলাদেশে দেখার মতো স্থান নেই তবে তার এই অভিযোগের জন্য তাকে শাস্তি দেয়া যায় না বরং তাকে জানিয়ে দেয়া যায় যে, আমদের এই দেশটিতে দেখার মতো কী কী আছে। বিশ্বাস করুন যদি আপনি বাংলাদেশ ভ্রমণে বের হন তবে বছরেও শেষ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। বাংলাদেশর প্রায় প্রতিটি স্থানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সৌন্দর্যের সমাহার। তেমনই এক নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশের ভোলাগঞ্জ স্থানটি। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সিলেটের সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্য অনন্তকাল ধরে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের মুগ্ধ করেছে। ভোলাগঞ্জের রোপওয়ের কথা শুনেছি সেই ছোটবেলা থেকেই কিন্তু সময়ের অভাবে দেখার সময় হয়ে ওঠেনি। অনেক দিন ধরে প্ল্যান করি ভোলাগঞ্জ যাব কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠছিল না শেষ পর্যন্ত আমরা রওনা দিলাম। আগে থেকেই ভোলাগঞ্জের আলিম ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলাম। তার কথা মতো ভোরে সিলেটে পৌঁছে আমরা রওনা দেই গন্তব্য পানে আর ভ্রমণসঙ্গী আমার মা। আকাশ একটু মেঘলা, মিষ্টি রোদ, অজানা পথ আর দূরে পাহাড়ের হাতছানি; আমাদের কেমন মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। মায়াময় পথে ভুলেছিলাম সবকিছুই। মাঝে মাঝে বেরসিক রাস্তার কারণে খুব রাগ হচ্ছিল নিজের ওপরে আমরা চাইলেই এই রাস্তাগুলো যেন সুন্দর করে রাখতে পাড়ি। মজা শুরু“হলো যখন দূরের পাহাড় চোখে পড়ল। পথে গাড়ি ছিল না মোটেই, একটু পরপর দুই একটা সিএনজি অটোরিক্সা ছাড়া আমরা ছিলাম একরকম নির্জনতায়। পরে খেয়াল হয়েছিল যে পথের দুপাশে ধানক্ষেত ছিল কিন্তু তখন চোখে ছিল একটা জিনিসই; সামনের ছায়ার মতো পাহাড়, হাল্কা কুয়াশা ঘেরা দিগন্ত। সেসব মাঠে মাঠে কচি ধানগাছ হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। মাসের শেষে ধান কাটা হবে এমন দৃশ্য দেখে জীবনানন্দ দাশের গ্রাম-বাংলার কথা মনে পড়ে গেল। বাংলার সে রূপ দেখে দেখে আমরা ভোলাগঞ্জের পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। পথের অবস্থা খুবই খারাপ। শেষে কবে এই পথে পিচ বা ঢালাই পড়েছিল, সেটা বিশাল এক গবেষণার বিষয়। তবুও এর মধ্যেই রাস্তার দু’পাশের শোভা দর্শনের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। মা বলছিলেন ভারতের অসম প্রদেশের রাজধানী শিলংয়ে একসময় লোকজন এ রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করত। কালের পরিক্রমায় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রজ্জুপথ। আমরা চলছি হঠাৎ করে গাড়ি নষ্ট হয়ে যায় অগত্যা গাড়ি ধাক্কা দিতে হলো। গাড়ি নষ্ট হওয়ার দরুন আমরা গাড়ি থেকে নেমে সকালের নাস্তা করার চেষ্টা করছিলাম থানা বাজারে গিয়ে গরম গরম পরাটা আর ডিমভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। নাস্তা করার ফাঁকে আমাদের পাইলট সাহেব গাড়ি ঠিক করিয়ে নিলেন। চলতি পথে ধানক্ষেত দেখছি, মাছ ধরার নৌকা আর রাস্তার পাশে মাছ বিক্রেতার দল। এই পথে মাছ খুব সস্তা। তবে পথের ভোগান্তির কারণে সিলেট শহরবাসীর এখানে মাছ কিনতে আসা হবে না। তবে ধান কাটা আর ধানের শীষে ভরা মাঠের শাশ্বত রূপ দেখতে সবাই কে অন্তত একবার আসা উচিত। পথের মায়াবী রূপ দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম ভোলাগঞ্জে। আলিম ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাকে নিয়ে সরাসরি চলে যাই পাথর কোয়ারিতে। পাথর কোয়ারির লাখ লাখ মানুষের কর্মযজ্ঞ আর ধলাই নদীর মায়াবী রূপ পথের সব ক্লান্তি দূর করে দিল। আলিম ভাই বলছিলেন ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে শুষ্ক মৌসুমে প্রধানত গর্ত খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে শ্রমিকরা প্রথমে কোয়ারির ওপরের বালি অপসারণ করে। পর্যায়ক্রমে গর্ত খুঁড়ে নিচের দিকে যেতে থাকে। ৭-৮ ফুট নিচু গর্ত খোঁড়ার পর কোয়ারিতে পানি উঠে যায়। পানি উঠে গেলে শ্যালোমেশিন দিয়ে কোয়ারির পানি অপসারণ করে শ্রমিকরা পাথর উত্তোলন করে। এর বাইরে ‘শিবের নৌকা’ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের উপায় হচ্ছেÑ একটি খালি নৌকায় শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিন লাগানো হয়। ইঞ্জিনের পাখা পানির নিচে ঘুরতে থাকে। পাখা অনবরত ঘুরতে ঘুরতে মাটি নরম হয়ে পাথর বেরোতে থাকে। সংশ্লিষ্টরা ঝুঁকির সাহায্যে পাথর নৌকায় তুলে। এ পদ্ধতিতে সহস্রাধিক শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে থাকে। এরপর আমরা ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের ১২৪৯- ১-ঝ পিলারের কাছে গেলাম। সেখানে সন্ধান পেলাম সেই পাকিস্তান আমলের পিলার। এর পরে গেলাম ভোলাগঞ্জ ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশনে। এ স্টেশন দিয়ে আমদানি রফতানি কার্যক্রম চলে। এ স্টেশন দিয়ে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা প্রধানত চুনাপাথর আমদানি করে থাকেন। চুনাপাথর নিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সীমান্তের জিরো লাইনে এ কাস্টমস স্টেশনের অবস্থান। সেখানে আমদানি রফতানি বন্ধ থাকায় এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে তার পরে ও আমরা সীমান্তের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে এলাম দেখা পেলাম পিলার ১২৪৮- ১৩-ঝ পিলারের। এর পর দেখা পেলাম সেই রোপওয়ের। রোপওয়ের ইতিহাস বলতে গিয়ে আলিম ভাই বললেন, ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর সঙ্গে প্রতিবছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। ধলাই নদীর তলদেশেও রয়েছে পাথরের বিপুল মজুদ। এই পাথর দিয়ে পঞ্চাশ বছর চালানো যাবে- এই হিসাব ধরে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে সোয়া দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প। ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ রোপওয়ের জন্য নির্মাণ করা হয় ১২০টি টাওয়ার এক্সক্যাভেশন পয়েন্ট। মধ্যখানে চারটি সাব স্টেশন। দু’প্রান্তে ডিজেল চালিত দুটি ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউস, ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে কলোনি, স্কুল, মসজিদ ও রেস্ট হাউস নির্মাণও প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছিল। এক্সক্যাভেশন পয়েন্টের সাহায্যে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করা হলেও বর্তমানে এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। সংশ্রিষ্টরা জানান, পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব, পাথরের অপর্যাপ্ততা ও বিকল ইঞ্জিনের কারণে দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর ধরে এক্সক্যাভেশন মেশিন বন্ধ রয়েছে। আগে উত্তোলিত পাথর ভাঙ্গা, ধোঁয়া ও টুকরোর আকার অনুসারে বালু, স্টোন চিপস ও ট্রাক ব্যালাস্ট ইত্যাদি শ্রেণীতে ভাগ করা হতো। শ্রেণী অনুসারে সেগুলো পৃথক পৃথকভাবে বের হয়ে রোপওয়েতে ঝুলানো চারকোনা বিশিষ্ট স্টিলের বাকেটে জমা হতো। প্রতিটি বাকেটের ধারণক্ষমতা ২৩৭ কেজি (প্রায় ১২০ ফুট)। পাথর ভর্তি বাকেট পাঠানো হতো ছাতকে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ঠিকাদাররা স্থানীয়ভাবে বোল্ডার পাথর ক্রয়ের পর তা ভেঙ্গে বিভিন্ন সাইজে বিভক্ত করে। তারপর তা বাকেটে পুরে ছাতকে প্রেরণ করা হয়। মজার ব্যাপা হলো, এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। ধলাই নদী বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পয়েন্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই নদী মিলিত হয়েছে-পিয়াইন নদীর সঙ্গে। রোপওয়ের আয়তন প্রায় একশ’ একর। দেখতে দেখতে সূর্যাস্তের সময় হয়ে গিয়েছিল। এর আগেও অনেক সূর্যাস্ত দেখেছি অন্য কোন নদীর বুকে বা সমুদ্রের বুকে কিংবা পাহাড়ের গায়ে তাই আমার চোখ সেদিকে ছিল না। আমি চেয়েছিলাম ওই দুই পাহাড়ের কোনায় যেখানে ধলাই নদী হারিয়ে গেছে ভারতের মধ্যে। একই নদী, সীমানার ওপারে হয়ত একই রকম পাহাড়, মানুষজনও একই। কিন্তু কেমন যেন ভুতুড়ে লাগছিল দূর থেকে। আমার দেখতে ইচ্ছা করছিল নদীটা সেখানে কেমন! হয়ত এই কারণে যে ওপাশে গমন নিষেধ। আর মানুষের সুলভ জিনিসের চেয়ে নিসিদ্ধের প্রতি টান বেশি।
×