ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জাভেদ বিন এ হাকিম

ঢেউ খেলানো পাহাড়ের পথে

প্রকাশিত: ০৭:২২, ১৭ জুন ২০১৬

ঢেউ খেলানো পাহাড়ের পথে

তারিখটি ছিল ২৫ মার্চ। ওইদিন দিবাগত রাতে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের ১১ বন্ধু চেপে বসি পাহাড়ী পথের রাজা বলে খ্যাত শান্তি পারিবহনে। রাত ১১টা ১০ মিনিটে কমলাপুর হতে গাড়ি ছাড়ে। সবার আসন সামনের সারিতে হলেও ভাগ্য বিড়াম্বনায় মনি আর ডেন্টিস ইমন ভাইয়ের সিট হয় একদম পেছনে । এরপরও যেন দুজনের আনন্দের কোন কমতি ছিল না। গাড়ি চলছে দ্রুতগতিতে, অবরোধের কবলে রাস্তা পুরাই ফাঁকা। মধ্যরাতে কুমিল্লায় এক বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে ব্রেক। তেল ছাড়া পরাটা আর গরুর গোস্ত ভুনা, আহারে খেতে ভারি মজা। মুখে দিতেই কম্ব সারা, স্বজোরে চিবিয়েও যেন গলা দিয়ে নামে না। পেটে ক্ষুধা মুখে হাসি আবারও যে যার মতো করে গাড়ির সিটে বসি। সকাল ৮টা ২০ মিনিটে দীঘিনালা বন বিহারের সামনে নামি! শ্রমিক নেতা সুনিল দা মান্ধাতা আমলের চান্দের গাড়ি নিয়ে আগে থেকেই রেডি, যৎসামান্য কুশল বিনিময়। অতঃপর খানিকটা সময় বন বিহারের সৌন্দর্য দর্শন। সেলফোনে মফিজ ভাইয়ের তাড়া, একটু তাড়াতাড়ি আসেন না ভাই, বাজার সদাই করে যেতে হবে সাজেক ভ্যালি। চাদের গাড়ি স্টার্ট, ১০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাই বাজারের কাছের গেস্ট হাউসে, সাফ সুতর নাশতা আর বাজার সদাই চলে সমান তালে। চাল, তেল ও মুরগি গাড়িতে তুলি। সবকিছু পেছনে ফেলে গাড়ি ছুটছে সাজেক ভ্যালি! খাগড়াছড়ি জেলাকে টাটা দিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছেই ব্রেক। একজন গিয়েই করে এলো নাম ঠিকানা এন্ট্রি! অথচ ২০০৪ সালে যখন গিয়েছিলাম, তখন জবাবদিহিতা করতে হয়েছিল, প্রায় ঘণ্টা খানেক। গঙ্গারাম মুখ নন্দরামপাড়া পেরিয়ে নিরিবিলি পাহাড়ী আঁকা বাঁকা পথে গাড়ি চলে, যতই এগিয়ে যাই ততই সামনের পাহাড়গুলো যেন দূরে সরে যায়, যাচ্ছি আর থামছি, কখনও কখনও চারপাশের মায়াময় প্রকৃতির ঘোরে আছন্ন হয়ে পড়ি, টনক ফিরে যখন একশত কেজি ওজনের আরাফাত হুংকার দিয়ে উঠে, চলেন তো ভাই তাড়াতাড়ি। ভিডিও নির্মাতা মুজাহিদের জন্য যত হয় দেরি। আবারও গাড়ি স্টার্ট। উচ্ছ্বাসে কয়েক বন্ধু ছাদে চড়ে বসে। কাচালং নদী পেরিয়ে মাচালং বাজারে খনিকটা সময় বিরতি। কচিডাবের পানি আর পাহাড়ী বালিকা তরুণীদের সঙ্গে চলে অম্ল-মধুর খুনসুটি। তবে ভাব জমানোর আগেই ফটোগ্রাফার ইফতেখারের জন্য মাঠে মারা যায় সবই। বাজারে অপেক্ষায় থাকা কংলাকপাড়ার হেডম্যানকে সঙ্গে নিয়ে আবারও ছুুটি। সাজেক পৌঁছার ঠিক ৫ কি. মি. আগে পথের এমন সৌন্দর্যময় বাঁক পড়ে যেখানে গাড়ি ব্রেক না করে আর পারি। আমরা যখন ফটোসেশনে ব্যস্ত তখন আবু নাসের কচি খুঁজে বের করে ঝিরি। এবার দামালদের আর পায় কে? আবার জিগায়! সবার আগে রাজু টুপ করে ডুব দেয়। কালাম গিয়ে দেখে ঝিরির চারপাশে বিবেকহীন ইনসানদের মহোৎসবে মলত্যগের শুকনো স্মৃতি। হায়রে মানুষ তোর বিচিত্র রুচি, প্রকৃতির দরদ বুঝলি না। টঙ দোকান থেকে দু-চারটা বাংলা কলা পেটে পুরে চলছি এবার ওপর দিকে। একটা সময় মনে হলো ধরতে যাচ্ছি যেন আকাশটাকে তবে ধরার আগেই পৌঁছে যাই সাজেকের প্রথমপাড়া রুইলুইতে। প্রথম দেখাতেই যেন চোখ কপালে। জনপ্রতি বিশ টাকা টিকেট কেটে ঠুকে পড়ি ভেতরে। কৃত্রিম আর প্রাকৃতিক এই দুয়ের মিশ্রণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাজেকের রূপে এনে দিয়েছে এক অন্যরকম ভাললাগার অনুভূতি, দেখলে মনে হবে যেন সাজেক ভ্যালি উন্নত বিশ্বের কোন পাহাড়ী জনপথের প্রতিচ্ছবি। আমাদের রাতে থাকার জন্য ব্যবস্থা হয় সাজেক ক্লাব হাউসে। কাঁধের-পিঠের ঝোলা রেখে বের হয়ে যাই সাজেক দর্শনে। কয়টার সময় খেতে আসব জানতে চাইলে, রসুই ঘর থেকে খবর আসে ঘুরতে থাকেন মনের সুখে! দুপুরের খাবার সন্ধ্যার আগে হবে না যে কোন মতে। চোঁ-চোঁ করা পেটে কিছু দিতে ঢুঁ মারি টি-স্টলে। চানাচুর, বিস্কুট আর সঙ্গে এক কাপ লিগার চা, শরীর এখন পুরাই চাঙ্গা। বিমুগ্ধ নয়নে সাজেকের রূপ দেখি আর বিগত ১০ বছর আগের স্মৃতি হাতরে ফিরি। সরকার চাইলে কিনা পারে তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই সাজেক ভ্যালি। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ২৭শ ফিট উচ্চতার সাজেক ভ্যালি এখন দেশের অন্যতম দর্শনীয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি। খোলা চোখে হেলিপ্যাডে দাঁড়িয়ে দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত সাজেকের চারপাশের ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে যে কেউ তার রূপে আচ্ছন্ন হবেই। বসন্তের ছোঁয়ায় পাতাঝরা গাছগুলো যেন একেকটি ভিন্ন রকম শিহরণ জাগানো ছবি। সাজেকের আইকন বিজিবি পরিচালিত রুন্ময় কটেজটি সাজেকের রূপের পসরায় যোগ করেছে আশ্চর্য রকম ভাললাগা সৌন্দর্যের দূতি। পাহাড়ের গায়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পিচঢালা পথ গিয়ে শেষ হয়েছে বিজিবি ক্যাম্প পর্যন্ত। সাজেক ভ্যালি হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। দুর্গম সাজেক আজ পরিণত হয়েছে সৌখিন ভ্রমণপিপাসুদের মেলাবন্ধনে। সাজেকের মোহনীয় রূপের ঘোরে পেটের ক্ষুদা যেন পালিয়ে ছিল কংলাকপাড়ার দিকে। বিকেল ৪.১৫ মিনিট ক্ষুদাকে পাকড়াও করার জন্য ছুটি কংলাকের পথে। জিপে মাত্র ১০ মিনিটের পথ এরপর ১৫ মিনিটের চড়াই-উৎরাই। কংলাক সাজেকের সবচেয়ে উঁচু সিপ্পু পাহাড়ে অবস্থিত। শুধু সাজেক ভ্যালি নয় পুরো রাঙ্গামাটির জেলার মধ্যে সবচেয়ে উঁচুতম পাহাড়। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ২৮শ ফিট ওপরে। সিপ্পু পাহাড়ের চূড়ায় বসে সবাই যখন নজরকাড়া প্রকৃতির মোহে বিভোর তখন মোস্তাক অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে কি যেন খুঁজে বেড়ায়। কংলাকের প্রকৃতি যেন আরও একটু বেশিই উদার। পাহাড়ের চূড়া থেকে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের বুকে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি কমলাগাছের বাগান যে কোন ভ্রমণপিপাসুকে মুগ্ধ করবে নিঃস্বন্দেহে। রুইলুই ও কংলাকপাড়ায় আদিবাসী লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরাদের বসতি। মোট ৯৬টি পরিবারের আবাস। প্রতিটি বাড়িই সাজানো-গুছানো। বাড়ির আঙ্গিনায় ফুটে আছে নানা রঙের ফুল। হেডম্যান লাল থ্যাঙ্গগা লুসাইর সঙ্গে কথা বলে সাজেকবাসীর যাবিতজীবন সম্পর্কে জানা হলো। রুইলুই ও কংলাক এই দুই পাড়ার আদিবাসীরা অধিকাংশই ইংরেজী শিক্ষিত। পাশেই ভারতের মিজোরাম প্রদেশের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বেশি। অধিকাংশ বসিন্দা পড়ালেখাসহ হাট-বাজার পর্যন্ত মিজোরাম থেকেই করে থাকেন। তাদের পোশাক ও আচার-আচরণ পুরোটাই আধুনিক। অত্যন্ত বিনয়ী স¦ভাবের আদিবাসী জনগোষ্ঠী এক কথায় বন্ধু বৎসল। সাজেকের চারপাশে বড় বড় পুরনো সেগুন হরেক প্রকারের বিশাল বাঁশের বন আর প্রাচীন বট বৃক্ষের মায়াবী পরশে ঘেরা। পুরো বিকেলটা কংলাকপাড়ার সিপ্পু পাহাড়ের চূড়ায় কাটিয়ে ঘোর সন্ধ্যায় ফিরি ক্লাব হাউসে। শুরু হয় খানাপিনা, খাবার শেষে সবাই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলি আহ্ কি স্বাদ। রাতে হবে বার বী কিউ, সঙ্গে ক্রিকেটে ভারত হেরেছে সেই আনন্দে মাওকা ডেন্স! রাত ৯টা, শুরু হয় আয়োজন। সবাইকে ছাড়িয়ে তাল গাছের মতো দেখতে সালমান পাপনও নাচল বেশ। আনন্দ উল্লাসের মাঝেই বেজে যায় রাত ১টা। পরেরদিন সকালেই ফিরতে হবে ঢাকা, তাই এবার ঘুমানোর পালা। ফজরের নামাজ আদায় করে পাতলা খিচুড়ি পেটে পুরে সোনামাখা রোদ গায়ে মেখে ছুটি এবার বাড়ির পথে। এক জায়গাতেই দেখতে পাওয়া নৈসর্গিক প্রকৃতির হরেকরূপের নয়নাভিরাম পসরা আপনাকে সাজেক ভ্যালি নিয়ে যেতে চাইবে বার বার। কিভাবে যাবেন ॥ সাজেক রাঙ্গামাটি জেলাতে হলেও খাগড়াছড়ি দিয়ে যোগাযোগের সুবিধা বেশি। ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি খাগড়াছড়ির দীঘিনালা বাজার। সেখান থেকে চাঁদের গাড়িতে সাজেক ভ্যালি। কোথায় থাকবেন ॥ সাজেক ক্লাব হাউস, ভাড়া মাথা পিছু ২০০ টাকা। এছাড়া আরও রয়েছে সেনাবাহিনী পরিচালিত সাজেক রিসোর্ট ও বিজিপি পরিচালিত সাজেকের আইকন রুন্ময় কটেজ ।
×