ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজিম উদ্দিন

সিসিলির দিনগুলো

প্রকাশিত: ০৭:২১, ১৭ জুন ২০১৬

সিসিলির দিনগুলো

সিসিলি নিয়ে আমার ব্যাপক আগ্রহ ছিল। তাই এ ভ্রমন নিয়ে বহু আগে থেকেই নিয়েছি প্রস্তুতি। এ দ্বীপে যাওয়ার পূর্বেই আমি ও আমার পরিবার ইতালিয়ান ভাষার কোর্স করি। ভাষা বলতে অল্প বিস্তর শব্দ। যা দিয়ে একজন আগন্তুক একটি নতুন জায়গাই ভাব আদান-প্রদান করতে পারে। তাছাড়া ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও সিসিলি নিয়ে একটি প্রদর্শনীতে হাজির হয়। যাতে এ দ্বীপে যাওয়ার আগেই এ দ্বীপের নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে জানতে পারি। কেবল আমি একা নই, আমার ছয় বছরের ছোট কন্যা শিশুটিও দু-একটা ইতালিয়ান ভাষা শেখে। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে অবশেষে বছরের মে মাসে বেড়াতে যায় সিসিলি। ব্রিটেনের শ্রমিক দিবস উপলক্ষে ব্যাংক হলিডে ছিল তাই পরিবার নিয়ে যেতে খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি। পরিবার বলতে আমি, আমার স্ত্রী ফারহানা ও আমার কন্যা নোহা। সঙ্গে ছিল একজন বন্ধু ও তাঁর স্ত্রী। জীবনে প্রথম এ উপদ্বীপে যাওয়া। জানি না, ভূ-মধ্যসাগরের এ দ্বীপের প্রেমে পড়ব কিনা। এটি একটা ভোলকেনিক আইল্যান্ড। যার আয়তন প্রায় ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। জানি না কতটুকু প্রেম, মায়া-মমত্ব থাকবে এ দ্বীপের জন্য। কত দিনই বা তা স্থায়ী থাকবে। সত্যি বলতে কি আমি আমার জীবনে কেবল ঊীঢ়ষড়ৎব করতে চেয়েছি। ছবির মতো সুন্দর নৈসর্গিক সাগর কিংবা শান্ত পাহাড় বেষ্টিত এ দ্বীপ। ভৌতিক সব ঐতিহাসিক স্থাপত্য। সন্ধ্যার সময় চমৎকার ঈড়ষড়ৎভঁষ ঠরনৎধহঃ থাকে এ শহরে। এমন শহরের প্রাকৃতিক আবহে পাখির কলরবে হাঁটার মধ্যে যে নিঃসঙ্গতা ঘিরে রাখে তা আমার মন, শরীর, চিন্তা-চেতনা ও সৃৃজনশীলতাকে ছাপিয়ে নতুন উদ্যমে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। সে সঙ্গে সিসিলিতে দেখব মানবসভ্যতার প্রায় ৪ হাজার বছরের ইতিহাস। এত আশা নিয়ে যে শহরে যাচ্ছি জানি না, তা আমার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে কি না। দেখা যাক কেমন হয় সিসিলি। এই শহরের সঙ্গে আমার একটি যোগসূত্র রয়েছে। আমার নিজেরও সমুদ্র ঘেরা এক শহরে জন্ম। যার নাম চট্টগ্রাম। যে শহর সম্পর্কে সপ্তদশ শতাব্দীতে বিখ্যাত চীনা পর্যটক মন্তব্য করেছিলেন, অ ঝষববঢ়রহম নবধঁঃু জরংরহম ভৎড়স সরংঃ ধহফ ধিঃবৎ. কারণ চট্টগ্রামে আছে পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য ও নদীর মিশেলে অদ্ভুত স্বতন্ত্র এক সংস্কৃতি। সে যাই হোক লন্ডনের গোথিক বিমানবন্দর থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি। এটি লন্ডনের চারটি বিমানবন্দরের একটি। সিসিলিতে আমরা মোট চারদিন থাকি। মে ২০১৬ ইন্টারন্যাশনাল লেবার হলিডে। যা কিনা ব্রিটেনে ব্যাংক হলিডে নামেও পরিচিত। এটি একটি বীঃবহফবফ বিবশবহফ. আমাদের ফ্লাইট ৪৫ মিনিট দেরিতে ছাড়বে। তাই, যে বিমানে যাব সেই ইজি জেট সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করলাম। ইজি জেট একটি ঘড় ভববং অরৎষরহবং. এখানে কেবল মৌলিক সেবাসমূহ প্রদান করা হয়। ফ্লাইটে ওঠার পর মাথার মধ্যে কেবল একটাই চিন্তা ঘুরপাক করছে। কিভাবে একজন ব্রিটিশ উদ্যোক্তা এমন অভিনব ধারণায় বিমান ব্যবসা শুরু করেছেন। ব্রিটিশ ব্যবসায়ী তবে গ্রীক বংশোদ্ভূত। তাঁর বাবা ছিলেন একজন বিখ্যাত জাহাজ ব্যবসায়ী। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে পড়ার সময়েই তার ঘড় ভববং অরৎষরহবং-এর আইডিয়া তৈরি হয়। এই ধরনের বিমানের টিকিট অনেক সস্তা হয়। অরৎ ঈৎধভঃ এ কোন খাবার দেয়া হয় না, থাকে না কোন অরৎ যড়ংঃধমব। এমনকি যাত্রীদের বোর্ডিং পাসও কর্তৃপক্ষ প্রিন্ট করে দেয় না। নিজ তাগিদেই সব যাত্রীদের করতে হয়। বিমানে উঠে বুঝলাম ক্যারিয়ারের কোয়ালিটি যথেষ্ট ভাল। তুলনামূলকভাবে বেশ আধুনিক এ বিমান। মাত্র আট বছরের পুরনো। ভেতরটা খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রয়েছে পেশাদারিত্বের ছাপ। এয়ার ক্রাফটের ভেতরে ও বাইরে চমৎকার ঈড়ষড়ৎ ঈড়সনরহধঃরড়হ করা। ইজি জেটের থিম কালার চমৎকারভাবে ঈড়হঃরহঁব করা হয়েছে। স্টুয়ার্ডদের ভূমিকা অন্য পরিবহন সংস্থার মতো নয়। বরং কিছুটা ভিন্ন। যাত্রীদের তারা দুই ধরনের সেবা প্রদান করেন। একটি হলো বিক্রয় ও কাস্টমার সার্ভিস। অপরটি নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা। তারা বিমানে স্নাক্স, পারফিউম, ড্রিঙ্কস এসব বিক্রি করে। এসব বিক্রয়লব্ধ অর্থ হতে তাদের অধিকাংশ আয় হয়। এটি একটি চমৎকার ধারণা। কেন তা অভিনব? কারণ, আপনি সে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবেন যা আপনি ভোগ করবেন। এ ই ফ্লাইটে আপনি আগে থেকে কোন ফ্লাইট রিজার্ভ করতে পারবেন না। যদি রিজার্ভ করতে চান, পছন্দসই সিট বুকিং করতে চান, তবে আপনাকে সে জন্য অর্থ প্রদান করতে হবে। যদি আপনি এক্সপ্রেস চেকিং করতে চান কিংবা ঊসনধৎশ ও ংপঁৎরঃু মধঃব এ ভধংঃ ঃৎধপশ করতে চান কিংবা ধরুন লাগেজ চেক করতে চান সবকিছুর জন্যই আপনাকে আলাদা ফি প্রদান করতে হবে। এ ধারণা বেশ আধুনিক। যদিও তা বিশ বছরের পুরনো। বিগত বছরগুলোতে তারা একটি বিশাল কোম্পানি হয়ে দাড়িয়েছে। আজকে তাদের প্রায় ৭৩৫টি রুটে ২৪১টি বিমান চলাচল করে। সে যাই হোক, এসব ভাবতে ভাবতে সিসিলির দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ক্যাথানিতে জেট এয়ারওয়াইজের চাকা স্পর্শ করে। আনন্দ প্রত্যাশাকেও হার মানায়। আমরা ছিলাম একটি ভৌতিক রোমান্টিক ধাঁচের পাঁচতারা হোটেলে। যার চারপাশ জুড়ে ছিল বাগান। সামনে অসাধারণ ওধহফ ংপধঢ়ব সামনে ও পেছনে বাগান। হোটেলের সামনের রাস্তা পেরোলেই সমুদ্র। যার নৈসর্গিক দৃশ্য অসাধারণ। একদিকে ইউরোপের সবচেয়ে অপঃরাব ঠড়ষপড়হড় মাউন্ট এটনা। যার উচ্চতা প্রায় দশ-এগারো হাজার ফুট লম্বা। অন্যদিকে আয়োনিয়ন সাগর। অসি প্রাসাদ : চারপাশের সাগরবেষ্টিত এই প্রাসাদ সিসিলির অসাধারণ একটি প্রদর্শনীয় স্থান। মাত্র তিন ইউরোতে এই প্রাসাদ দর্শন করা যায়। উঁচু পাহাড়ের খাঁজ কেটে এই প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছে। যার অর্ধেক প্রাকৃতিক ও অর্ধেক মানুষ্য তৈরি পাথর। এমন মুন্সিয়ানায় তা তৈরি, বোঝা মুশকিল পাথরের কোনটি প্রাকৃতিক আর কোনটি কৃত্রিম। প্রাসাদের চারপাশেই স্থাপত্য। ভূমধ্যসাগরের বুক চিরে গড়ে ওঠা এসব স্থাপত্য পুরো এলাকাটিকে ভিন্ন রঙে সাজিয়েছে। প্রাসাদটি একটি শৃঙ্গের ওপর স্থাপিত। সাগরের ঢেউ এ প্রাসাদের চারপাশের পাহাড়ে এসে আঘাত হানছে। এ স্রোত আছড়ে পড়ার শব্দ প্রাসাদজুড়ে অসাধারণ এক দৃশ্যের পরিবেশের অবতারণা করছে। নান্দনিক এই শব্দে বিমোহিত প্রকৃতি। এটা হিডেন ট্রেজার। প্রাকৃতিক পাথর দিয়েই এ প্রাসাদ নির্মিত। আবার শৃঙ্গের উপরের পাথরও নেয়া হয় এ প্রাসাদ নির্মাণে। কাছ থেকে বোঝা সম্ভব নয় কোন্টি প্রাকৃতিক আর কোন্ কৃত্রিম। সবুজের চমৎকার সমারোহ। প্রাসাদের উপরেই অদ্ভুত সুন্দর কিছু গাছ। এই প্রাসাদ থেকে সমুদ্রের মাঝখানে কিছু ছোট ছোট দ্বীপ চোখে পড়ছে। (চলবে)
×