ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাঁড়াশি অভিযানে ছয় সংগঠনের ১৮৪ জঙ্গী গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৭ জুন ২০১৬

সাঁড়াশি অভিযানে ছয় সংগঠনের ১৮৪ জঙ্গী গ্রেফতার

শংকর কুমার দে ॥ সারাদেশের ৬৪ জেলায় জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, গ্রেফতারি পরোয়ানা, মাদকবিরোধী ও অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে ১৫ সহস্রাধিক লোক। এর মধ্যে জেএমজেবি, জেএমবি, হুজি, হিযবুত, আল্লার দল, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এই ৬ জঙ্গী সংগঠনের প্রায় ২শ’ জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। সপ্তাহব্যাপী অভিযানের শেষ দিনে টার্গেট কিলিংয়ের সঙ্গে জড়িত প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের স্বত্ত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুলকে হত্যাচেষ্টার আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য সুমন হোসেন পাটোয়ারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ৬ জুন থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত গ্রেফতারি পরোয়ানা, মাদকবিরোধী ও অস্ত্র উদ্ধার অভিযান এবং গত ১০ জুন থেকে সপ্তাহব্যাপী জঙ্গীবিরোধী ঘোষিত সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে; যা শুক্রবার সকালে এ অভিযানের সমাপ্তি ঘটবে। দেশব্যাপী এ অভিযানের ফলে টার্গেট কিলিং বন্ধ, অপরাধ দমন, অপরাধীরা গা ঢাকা দিয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ড শান্ত রয়েছে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে বলে পুলিশ সদর দফতরের দাবি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়াও ৬৪ জেলায় ৬২৩ থানা এলাকা থেকে এমনিতেই প্রতিদিন গড়ে নিয়মিতভাবেই ৩ জন করেও যদি গ্রেফতার হয় তাহলে প্রতিদিনের মোট গ্রেফতার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৬৯। তাহলে নিয়মিতভাবেই এক সপ্তাহে সারাদেশে গ্রেফতার হয় ১৩,০৮৬। সেই হিসাবে ঘোষণা দিয়ে অভিযান পরিচালনায় প্রায় ১৫ হাজার গ্রেফতারের সংখ্যা বেশি তো নয়ই বরং অনেক কম বলে পুলিশের দেয়া পরিসংখ্যানে দাবি করা হয়েছে। তবে ঈদ সামনে রেখে পবিত্র রমজান মাসে টার্গেট কিলিং বন্ধে যে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে তাতে অন্যান্য বছরের তুলনায় শুধু কয়েকটি টার্গেট কিলিং বাদে এবারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক উন্নত বলে পুলিশ সদর দফতরের দাবি। দেশব্যাপী ঘোষিত এক সপ্তাহের জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুক্রবার সকালে শেষ হয়ে গেলেও পবিত্র রমজান মাসে ঈদ পর্যন্ত কোন ঘোষণা না দিয়েই অভিযান পরিচালনা অব্যাহত থাকবে, যাতে টার্গেট কিলিং বন্ধসহ জঙ্গীদের গ্রেফতারের বিষয়ে প্রাধান্য থাকবে বলে জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, জঙ্গী দমন ও সন্ত্রাসবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৮৪ জন নিষিদ্ধঘোষিত উগ্রপন্থী সংগঠনসহ জঙ্গী সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে এর মধ্যে সাম্প্রতিক টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যাকা-ের সঙ্গে সন্দেহভাজন অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে, যাদের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সন্দেহভাজন জঙ্গীদের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের তালিকা ধরে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ অভিযানের সময় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১১,২৮১ জন গ্রেফতার হয়েছে, যা শুক্রবার সকালে অভিযান শেষ হলে আরও গ্রেফতারের সংখ্যা বেড়ে যাবে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৮৪ জঙ্গী সদস্য ছাড়াও জামায়াত-শিবির ও বিএনপির ৪৩৫ নেতাকর্মী রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে নাশকতা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। গত ৫ থেকে ১১ জুন পর্যন্ত জঙ্গী কায়দায় হামলায় নিহত হয় চারজন। চট্টগ্রামে খুন করা হয় পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে। আর নাটোরে খ্রীস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজ, ঝিনাইদহে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী ও পাবনায় আশ্রমের সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পা-ে খুন হন। গত ৫ জুন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার বাবুল অক্তারের স্ত্রী মিতু খুন হওয়ার পরদিন ৬ জুন থেকে মূলত গ্রেফতারি পরোয়ানা, মাদকবিরোধী ও অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের নামে অভিযান শুরু হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক বিদেশ থেকে ফিরে এসে পুলিশ সদর দফতরে আয়োজিত সভা শেষে গত ১০ জুন থেকে এ সাঁড়াশি অভিযান চালানোর ঘোষণা দেন। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত ১৮৪ জঙ্গীর মধ্যে জেএমবি, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও হরকাতুল জিহাদ (হুজি), আল্লাহর দল, জেএমজেবিসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্য রয়েছে। আটকের সময় অনেকের কাছ থেকে দেশী-বিদেশী অস্ত্র, গুলি, ককটেল, গানপাউডার, পেট্রোলবোমা এবং উগ্রপন্থায় উস্কানোর মতো জিহাদী বই উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এর মধ্যে গাইবান্ধার খোলাহাটির ফারাজিপাড়া গ্রাম থেকে জেএমবি সদস্য মানিক মিয়াকে আটক করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে নাশকতা সৃষ্টির মামলা রয়েছে। রাজশাহী থেকে এক জেএমবি সদস্যকে আটক করা হয়েছে। টাঙ্গাইল থেকে হাবিবুর রহমান নামের এক জেএমবি সদস্যকে আটক করা হয়। রংপুর থেকে এক জেএমবি সদস্যকে আটক করা হয়। নওগাঁর রানীনগর থেকে বাংলা ভাইয়ের অন্যতম সহযোগী খাইরুল আলম মন্টুসহ দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নীলফামারী থেকে হাফিজ নামের এক জঙ্গী সংগঠনের সদস্যকে আটক করা হয় বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের সঙ্গে বৈঠকের পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, আমরা কোন ইল মোটিভ (খারাপ উদ্দেশ্য) ও পলিটিক্যাল (রাজনৈতিক) নিপীড়নের উদ্দেশ্যে কাউকে আটক করিনি। আগে প্রতিদিন কমবেশি দুই হাজারের মতো আটক করা হতো। এখনও তা-ই হচ্ছে। পুলিশের বিশেষ অভিযান পরিচালনাকে রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা করতে তাদের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি। গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগও করেছে তারা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান এ অভিযানের বিষয়ে পুলিশের সমালোচনা করেছেন। পুুুলিশ সদর দফতরের একজন উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, মেট্রোপলিটন সিটি ছাড়াও সারাদেশে ৬২৩ থানায় যদি প্রতিদিন ৫ জন করেও গ্রেফতার করা হয় এবং এক সপ্তাহে সেই গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়াবে গিয়ে ১৭ সহস্রাধিক। অথচ এ অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে প্রায় ১৫ হাজারের মতো। তাহলে গ্রেফতারের সংখ্যা বেশি কোথায়? এ অভিযানের ফলে টার্গেট কিলিং বন্ধসহ অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক উন্নতি ঘটেছে, যা মানুষের জানমাল রক্ষায় সহায়ক হচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা অভিযানের বিষয়ে বলেন, জঙ্গীবিরোধী অভিযান চালানো উচিত ছিল খুব সূক্ষ্মভাবে। পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য, গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি, কাউন্টার টেরোরিজম, আন্ডার কাভার অভিযান ইত্যাদিভাবে জঙ্গীদের বিষয়ে বিশদ খোঁজখবর সংগ্রহ করতে হবে। এরপরই অভিযান চালানো উচিত ছিল। তা না করে ঘোষণা দিয়ে যে অভিযান করা হচ্ছে তাতে প্রকৃত জঙ্গীদের গ্রেফতার কখনই সম্ভব হয় না। তবে অভিযানের ফলে ঈদকে সামনে রেখে পবিত্র রমজান মাসে যে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, খুন, অজ্ঞানপার্টির তৎপরতাসহ নানা ধরনের অপরাধ কমে যাবে। অভিযানের ফলে অন্তত জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ কমে গিয়ে দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ড শান্ত থাকতে ভূমিকা রাখবে।
×