ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাহে রমজান

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৭ জুন ২০১৬

মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ আজ পবিত্র মাহে রমজানের ১১তম দিবস। শুরু হলো মাগফিরাত বা ক্ষমার দশক। প্রথম দশকে যারা সিয়াম সাধনা, তিলাওয়াত ও রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে অঞ্জলি ভরে আল্লাহ্ পাকের রহমত লাভে ধন্য হয়েছেন, তাদের জন্য আজকের দশকটি বড় সৌভাগ্যের; কারণ তারা আজ খোদাতালার মাগফিরাত ক্ষমা ও মার্জনা পাওয়ার অধিক হকদার বিবেচিত হবেন। প্রসঙ্গক্রমে আজ ১১ রমজানে কুরআনুল কারীমের ১১তম সূরা ‘সূরায়ে হুদ’-এর ফযীলত, ঐতিহাসিক পটভূমি এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা। সূরা হুদ ওই সব সূরার অন্যতম, যাতে পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ওপর আপতিত খোদায়ী গজব ও বিভিন্ন প্রকার কঠিন আজাবের এবং পরে কিয়ামতের ঘটনাবলী আর পুরস্কার ও শাস্তির কথা বিশেষ বর্ণনা রীতির মাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণেই উম্মতের শ্রেষ্ঠ পুরুষ হযরত আবু বকর (রা) একদিন হযরত রাসূলে কারীম (স)-এর কিছু দাড়ি মোবারক পাকা দেখে বিচলিত হয়ে যখন জিজ্ঞেস করলেনÑ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (স) আপনি বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন, কারণ কী?’ প্রিয় নবী জবাবে বলেছিলেনÑ ‘হ্যাঁ! সাইয়াবাতনী হুদুন ওয়া আখওয়াতুহা; অর্থাৎ সূরা হুদ ও এর সমবিষয়ক সূরাগুলো আমাকে বৃদ্ধ করে দিয়েছে।’ তখন কোন কোন রেওয়ায়েতে সূরা হুদের সঙ্গে সূরা ওয়াক্বিয়া, মুরসালাত, আম্মা ইয়াতাসা’আলুন এবং সূরা তাকবীরের নামও উল্লেখ করা হয়েছে -(হাকেম, তিরমিজি)। উদ্দেশ্য এই যে, উক্ত সূরাগুলোতে অবতীর্ণ বিষয়বস্তু অত্যন্ত ভয়াবহ ভীতিপ্রদ হওয়ার কারণে এসব সূরা নাযিল হওয়ার পর রাসূলে পাক (স)-এর পবিত্র চেহারায় বার্ধক্যের লক্ষণ দেখা যায়। সূরা হুদ মক্কায় অবতীর্ণ। ১২৩ আয়াত বিশিষ্ট সূরাটির রুকু সংখ্যা ১০। এ সূরার আলোচিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে মনে হয় যে, ঠিক যে সময়ে সূরা ইউনুস নাযিল হয়েছিল- প্রায় সে সময়ে এ সূরাটি নাযিল হয়। দুইটি সূরা কাছাকাছি সময়ে নাযিল হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। কেননা মূলবাণীর বিষয়বস্তু একই ধরনের। মহানবী হুজুর পুর নূর (স)-এর কাছে সময়টি কঠোর ছিল এ কারণে যে, একদিকে কাফির কোরাইশগণ নিজেদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা ইসলামের প্রচারকার্য-দাওয়াত ও ইশাআতকে খতম করে দেয়ার চেষ্টা করছিল; আর অপরদিকে আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে নানাবিধ কঠোর ভাষায় সতর্কবাণী নাযিল হচ্ছিল। এরূপ অবস্থায় আঁ-হযরত (স) প্রতিমুহূর্ত ভয় পাচ্ছিলেন- যে কোন সময় না জানি আল্লাহ্ তায়ালার দেয়া অবকাশ চিরতরে শেষ হয়ে যায়। আর সে শেষমুহূর্তও এসে পড়ে কিনা, যখন আল্লাহ্ তায়ালা কোন জাতিকে কঠিন আজাবে নিপতিত করেন। প্রকৃতপক্ষে, এ সূরা পাঠ করার সময় অনুভূত হয় যেন এক মহাপ্লাবনের বাঁধ এখনই ছুটে আসছে। দাওয়াত, বুঝানো, হুঁশিয়ার ও সতর্ক করা ইত্যাদি সূরা ইউনুসের যেমন বিষয়বস্তু, তদ্রƒপ তা এখানেও। তবে পার্থক্য এতটুকু যে, দাওয়াত এখানে অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত। বুঝানোর মাঝে যুক্তি ও দলিলের চেয়ে ওয়াজ নসীহতই বেশি। এ সূরায় দাওয়াত দেয়া হয়েছেÑ নবীর কথা মানো, শিরক পরিত্যাগ কর, একমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর পানে মনোনিবেশ কর। নিজেদের বৈষয়িক জীবনের গোটা ব্যবস্থাকেই পরকালীন জবাবদিহির অনুভূতির ভিত্তিতে গড়ে তোল। এ বিষয়টি ব্যক্ত করার জন্য সরাসরি সম্বোধন করা অপেক্ষা পূর্ববর্তী জাতি ও কাওমসমূহের ঘটনাবলীই স্মরণ করে দেয়া হয়েছে বেশির ভাগে। যেমন কাওমে নূহ, আদ, সামূদ, লূত, মাদায়েনবাসী ও ফিরাউন জাতি। এসব কাহিনী ঘটনায় যে কথাটি বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা এই যে, আল্লাহ যখন কোন বিষয়ে চূড়ান্ত ফায়সালা করে ফেলতে চান, তখন তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নীতিতেই তা করেন। সেক্ষেত্রে বিন্দু পরিমাণও কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয় না। কে কার পুত্র, কে কার নিকটাত্মীয়, তা তখন কিছুমাত্র লক্ষ্য করা হয় না। তখন আল্লাহ্র অবারিত রহমত ও করুণার ভাগীদার তারাই হয়, যারা সত্যকে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটায়। যদিও অত্র সূরার মধ্যে সাতজন পয়গাম্বরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে; কিন্তু সূরার নামকরণ করা হয়েছে হযরত হুদ (আ)-এর নামে, যাতে বুঝা যায় যে, এখানে হযরত হুদ-এর ঘটনার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহ্পাক হযরত হুদকে (আ) আদ জাতির প্রতি নবীরূপে প্রেরণ করেছিলেন। দৈহিক আকার আকৃতিতে ও শারীরিক শক্তি সামর্থ্যরে দিক দিয়ে ‘আদ জাতিকে মানব ইতিহাসে অনন্য বলে চিহ্নিত করা হয়। হুদ (আ.)-ও উক্ত জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, এতবড় বীর ও শক্তিশালী জাতি তাদের বিবেক ও চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। পবিত্র কোরআন বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের জীবনকে সঠিক পথে সাজানোর আহ্বান জানায়। তাতেই খোদার দরবারে আমাদের ক্ষমা প্রাপ্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
×