ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্যানারি না সরালে দিনে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৭ জুন ২০১৬

ট্যানারি না সরালে দিনে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা

এম শাহজাহান ॥ আদালতের নির্দেশের পরও হাজারীবাগ থেকে সাভারে না সরায় ১৫৪ ট্যানারি কারখানাকে প্রতিদিন পঞ্চাশ হাজার টাকা করে জরিমানা দিতে হবে। পরিবেশ দূষণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই টাকা তাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম সাহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রিটকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। ক্ষতিপূরণের ওই অর্থ সঠিকভাবে আদায় হচ্ছে কি না-তা তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে শিল্প সচিবকে। তাকে এ বিষয়ে আগামী ১৭ জুলাই প্রতিবেদন দিতে বলেছে আদালত। পাশাপাশি হাজারীবাগের ট্যানারি বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় যাওয়ায় পরিবেশের কী পরিমাণ ক্ষতি প্রতিদিন হচ্ছে তা নিরূপণ করতে বলা হয়েছে পরিবেশ সচিবকে। তাকেও ১৭ জুলাই প্রতিবেদন দিতে বলেছে হাইকোর্ট। প্রসঙ্গত, এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০১ সালে ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এছাড়া চলতি বছরের গত ১৩ এপ্রিল রাজধানীর হাজারীবাগে এখনও যেসব ট্যানারি ব্যবসা পরিচালনা করছে তাদের তালিকা চেয়েছিল হাইকোর্ট। তিন সপ্তাহের মধ্যে শিল্প সচিবকে এই তালিকা হাইকোর্টের একই বেঞ্চে দিতে বলা হয়। আদালতের এ আদেশ অনুসারে শিল্প সচিবের পক্ষে আইনজীবী রইস উদ্দিন ১৫৫টি ট্যানারির তালিকা হস্তান্তর করেন। এর মধ্যে মাত্র একটি ট্যানারি স্থানান্তর করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সেই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই নির্দেশ দেন। রিট আবেদনের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জানান, এটি একটি যুগান্তকারী আদেশ। যতদিন পর্যন্ত কারখানা সরাবে না, ততদিন পর্যন্ত পরিবেশের ক্ষতি হিসেবে ট্যানারিগুলোকে সরকারী কোষাগারে ৫০ হাজার টাকা করে জমা দিতে হবে। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে কোর্টের আদেশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় অন্য এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প অন্যত্র সরিয়ে নিতে ২০০৯ সালের ২৩ জুন ফের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। সরকারপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরে ওই সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও স্থানান্তরিত না হওয়ায় আদালত অবমাননার মামলা করেন পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মনজিল মোরসেদ। এ মামলার প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল আদালত অবমাননার রুল জারি করে হাইকোর্ট। পরে গত বছরের ২১ এপ্রিল আদালতের তলবে হাইকোর্টে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন শিল্পসচিব। মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি সাভারে গেছে। বাকি ১৫৪টি প্রতিষ্ঠান এখনও হাজারীবাগে আছে। গত ২৩ মার্চ এ আবেদনের শুনানি শেষে ব্যাখ্যা দিতে ১০ মালিককে ১০ এপ্রিল তলব করে আদালত। ওই দিন হাজিরা দিতে আসার পর ব্যাখ্যা না দেয়ায় তিন মালিককে কোর্ট তত্ত্বাবধায়কের মাধ্যমে পুলিশে সোপর্দ করার আদেশ দেয় হাইকোর্ট। পরে কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক তাদের কোর্ট পুলিশের কাছে রাখে। বিকেলে তাদের আইনজীবী ফিদা এম কামাল সময়ের আবেদন ও তাদের পক্ষে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পরদিন দুপুর একটার মধ্যে ট্যানারি সরানোর বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে জমা দেবেন-এ শর্তে আদালতের নির্দেশে পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয় বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। পরদিন তাদের আইনজীবী ফিদা এম কামালের মাধ্যমে হলফনামা জমা দেন তিন ট্যানারি মালিক। হলফনামায় তারা তাদের হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ রাখাসহ আগামীতে হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি স্থানান্তরের আশ্বাস দেন। পরে তাদের আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়া হয়। আইনী পদক্ষেপে যাচ্ছেন ট্যানারি মালিকরা ॥ এদিকে হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চামড়াখাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলো। রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পরই তারা সুপ্রীমকোর্টে যাবেন বলে জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার এ্যান্ড লেদার গুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএল-এলএফইএ) নবনির্বাচিত সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিম জনকণ্ঠকে বলেন, এখনও রায়ের কপি পাইনি। আমরা রায়ের কপির জন্য অপেক্ষা করছি। যদি ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিষয়টি থেকে থাকে তাহলে আইনী পদক্ষেপ নিতে হবে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার প্রয়োজন হতে পারে। তিনি বলেন, হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারিগুলো সরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে মাত্র। এজন্য আরও সময় প্রয়োজন। ট্যানারি মালিকরা কোন কিছু গায়ে মাখে না ॥ সরকারের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বে গত ১০ এপ্রিলের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে কারখানা সরানোর আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছিল। সেটাও বাস্তবায়ন হয়নি। হাজারীবাগে পুলিশ বসিয়েও চামড়া ঢুকানো বন্ধ করা যায়নি। কোন কিছু গায়ে মাখে না ট্যানারি মালিকরা। বরাদ্দকৃত ১৫৫টি শিল্প ইউনিটের প্রথম তলার ছাদ ঢালাই করেছে আংশিকসহ মাত্র ৪৩টি ট্যানারি। মাত্র ১৩টি কারখানা দ্বিতীয় তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। বেস ঢালাই শেষ করে গ্রেটবিম ও কলাম ঢালাই করেছে ২৬টি কারখানা। এই বাস্তবতায় আগামী ছয় মাস কেন এক বছরের মধ্যে সব ট্যানারি সাভারে পুরোপুরি স্থানান্তরিত হতে পারবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। যদিও ট্যানারি চালু করতে গ্যাস, বিদ্যুত ও পানি সংযোগের জন্য আবেদন করা হলে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। চামড়া শিল্প নগরী প্রকল্পে সরকারের ব্যয় ॥ ১ হাজার ৭৯ কোটি ব্যয়ে সাভারের হরিণধরায় চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলা হচ্ছে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর হচ্ছে ১৫৫ ট্যানারি। এজন্য দেড়যুগেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। নগরীটির অবস্থান ঢাকার অদূরে সাভারের হরিণধরায়। নদী তীরে ২০০ একর জমির উপর গড়ে তোলা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব এই চামড়া শিল্পনগরী। গত ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। প্রায় ২০০ একর জমির উপর করা ২০৫টি প্লটের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ১৫৫টি। এর মধ্যে লে-আউট প্লান দাখিল করেছে ১৫৪টি, লে-আউট প্লান অনুমোদন করেছে ১৫৪টি এবং মামলাজনিত কারণে ১টি ইউনিটের বরাদ্দ জারি করা যায়নি। ট্যানারিগুলোকে সেখানে স্থায়ী করতে এখন পুরোদমে চলছে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি ও তাগিদ রয়েছে সরকারের। আগামী বছরের জুন মাসে চামড়া শিল্পনগরী নামের এই প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে সিইটিপি (কমন ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) ও ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে সরকারের মোট ব্যয় হবে ৬৩৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ট্যানারি শিল্প স্থাপনে মালিকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ দেয়া হবে ২৫০ কোটি টাকা।
×