ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সিয়াম ও তাকওয়া

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১৭ জুন ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সিয়াম ও তাকওয়া

সিয়াম পালন করার লক্ষ্য হচ্ছে তাকওয়ার প্রশিক্ষণ লাভ করা। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)। সিয়াম হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী যাবতীয় পানাহার, কামাচার, পাপাচার, মিথ্যাচার থেকে সুদৃঢ় সঙ্কল্পের সঙ্গে বিরত থাকা। আর এই বিরত থাকার মাধ্যমে সায়িম স্বভাব ও অন্তরে বিশুদ্ধ জীবনযাপনের অভ্যাস রপ্ত হয়। অন্যদিকে তাকওয়া হচ্ছে সকল প্রকারের ছোট-বড় গোনাহ থেকে আত্মরক্ষা করা, এমনকি গোনাহর সম্ভাবনাযুক্ত হালাল থেকেও নিজেকে বাঁচানো। সিয়াম বিধান দিয়ে আল্লাহ জাল্লা শানুহু যে, লা আল্লাকুম তাত্তাকুন শব্দের অর্থ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ইত্তিকা থেকে তাত্তাকুন শব্দ থেকে এসেছে– এর অর্থ এমন সব জিনিস থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা, যা ক্ষতিকর বা অন্যায়। এর বিস্তারিত অর্থ হচ্ছে আশঙ্কাযুক্ত বা ভীতিপ্রদ ও ক্ষতিদায়ক জিনিস থেকে আত্মরক্ষা করা। তাকওয়া শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ওয়াক্ত-কাফ-ইয়া বা ওয়াকিউ, যার অর্থ ক্ষতিকর বস্তু থেকে আত্মরক্ষা করা, ভীতিপ্রদ জিনিস থেকে নিজেকে বাঁচানো। আমরা তাকওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি এবং সিয়াম সেই তাকওয়া অর্জনের সহজ প্রক্রিয়ার প্রশিক্ষণ দেয় গোটা রমাদান মাস ধরে। হাদিসে কুদসীতে আছে যে, আল্লাহ তা’আলা বলেন : সে (সায়িম) আমার জন্য আহার করা থেকে বিরত থাকে, পানি পান করে না, কামাচার ত্যাগ করে। সিয়াম আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর পুরস্কার দান করব (বুখারী শরীফ)। তাকওয়ার মূল আবেদনও হচ্ছে আল্লাহকে খুশি রাজি রাখতে যে সমস্ত কাজ করা দরকার তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে করা আর যে সমস্ত কাজকর্ম করতে আল্লাহ তা’আলা এবং তার রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন তা না করা। যে কারণে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে হাজির-নাজির জানার ওপর যদি দৃঢ় বিশ্বাস থাকে তাহলে মানুষ কোন খারাপ কাজ কিংবা মিথ্যাচার করতে পারে না। মানুষ ভুলে যায় যে, আল্লাহ সবকিছু দেখছেন এবং সবকিছু জানেন। এ কারণেই সে শয়তানের দোসর হয়ে যায়। একজন সায়িম কিন্তু আল্লাহর জন্য আল্লাহরই ভয়ে এবং আল্লাহকেই ভালবেসে সিয়াম পালন করে, যে কারণে সায়িম অতি সহজে তাকওয়ার পথপরিক্রমে নিষ্ঠাবান পথিকে পরিণত হতে পারে। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার প্রতিনিধি বা খলিফা করে। এই প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা অর্জনের জন্যই প্রয়োজন তাকওয়া অবলম্বন করা। মানুষ তো আল্লাহর বান্দা বা দাস। এই দাসত্বের কর্মপরিধিকে প্রশস্ত করার জন্য পরিশুদ্ধ ও বিশুদ্ধ আখলাক গড়ে তুলতে হয় মানুষকেই। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : বলো, আমার সালাত ও আমার কোরবানি-বন্দেগী এবং আমার জীবন ও মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য। আল্লাহ জাল্লা শানুহু পশু কোরবানির যে বিধান দিয়েছেন সেখানে দেখা যায়, এই কোরবানির মধ্য দিয়ে তাকওয়ার প্রতিফলন ঘটেছে। কুরআন মজীদে এ ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছে : আল্লাহর নিকট পৌঁছে না ও গুলোর (কোরবানির পশুর) গোশত এবং রক্ত পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া (সুরা হ্জ্জ : আয়াত ৩৭)। তাকওয়ার অর্থে এটাও প্রস্ফুটিত হয় যে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর ওপর সম্পূর্ণ ও অটল ইমান এনে তার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থেকে তিনি যে সমস্ত কাজকর্ম করতে নিষেধ করেছেন তার কাছঘেঁষা না হয়ে আসসিরাতুল মুসতাকিমের পথে চলা অর্থাৎ ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হয়ে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী এবং তার রসুলের সুন্নাহ অনুযায়ী চলা এবং সর্বক্ষণ সর্বাবস্থায় অন্তরে আল্লাহর রহমত, ভালবাসা, দয়া ও ক্ষমার আশা পোষণ করে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা। তাওয়াক্কুল করার নির্দেশ দিয়ে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : অতঃপর ওরা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তুমি বলো, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আমি তারই ওপর নির্ভর করি এবং তিনি মহান আরশের অধিপতি (সুরা তওবা : আয়াত ১২৯)। তাকওয়ার একটা সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা জানতে চেয়ে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমীরুল মুমিনীন ফারুকে আজম হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইবনে কা’ব রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহুকে প্রশ্ন করলে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাদি) পাল্টা প্রশ্ন করলেন : আপনি কি কখনও কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়েছেন? হযরত উমর (রাদি) বললেন হ্যাঁ, দিয়েছি। হযরত উবাই ইবনে কা’বা (রাদি) বললেনÑ সেই পথ আপনি কিভাবে অতিক্রম করেছিলেন? হযরত উমর (রাদি) বললেন : আমি কাপড়-চোপড় গুটিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে অতি সন্তর্পণে সেই কণ্টকাকীর্ণ রাস্তা পাড়ি দিয়েছি যাতে আমার গায়ে পায়ে কিংবা কাপড়ে কাঁটা না বিঁধে। তখন হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন : এটাই তাকওয়া। অন্য একখানি হাদিসে আছে যে, পৃথিবীর পাপ-পঙ্কিলতার কাঁটা থেকে নিজেকে রক্ষা করাটাই হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। তাকওয়াকে শ্রেষ্ঠ পাথেয় বলে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা উত্তম কর্মের মধ্যে যেগুলো কর তা আল্লাহ জানেন এবং তোমরা পাথেয়র ব্যবস্থা করবে আর উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া (আত্মসংযম)। হে বুদ্ধিমানগণ! তোমরা আমাকে ভয় কর। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৭)। সিয়াম পালনকারীকে বলা হয় সায়িম এবং তাকওয়া অবলম্বনকারীকে বলা হয় মুত্তাকী। একজন সায়িম যথাযথভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে সিয়াম পালনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের প্রশিক্ষণ নিয়ে সহজে মুত্তাকী হতে পারেন। একজন মানুষ যখন মুত্তাকী হয়ে যান তখন তার রুহানী উন্নয়নের সর্বোচ্চ স্তরে উত্তরণ ঘটে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আর আল্লাহ হচ্ছেন মুত্তাকীদের বন্ধু। (সুরা জাছিয়া : আয়াত ১৯), আল্লাহ অবশ্যই মুত্তাকীদের ভালবাসেন। (সুরা আল ইমরান : আয়াত ৭৬), তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ অবশ্যই মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৪), শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য। (সুরা আ’রাফ : আয়াত ১২৮), মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে উত্তম আবাস (সুরা সাদ : আয়াত ৪৯)। এই মুত্তাকী হওয়ার প্রশিক্ষণের জন্যই রমাদানের এক মাস সিয়াম করাকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ফরজ করে দিয়েছেন। হাদিস শরীফে আছে যে, আল্লাহ তা’আলা বলেন; সিয়াম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য, তাই আমিই এর প্রতিদান দেব (বুখারী শরীফ)। সিয়াম পালনের মাধ্যমে সায়িম যে তাকওয়ার প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করে তা তার মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে, আধ্যাত্মিক সাফল্য দান করে এবং দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনকে পরিচ্ছন্নতার আলোয় উদ্ভাসিত করে। মুক্তাকী জীবনই মূলত আলোকিত জীবন। পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামিল হতে হলে মুত্তাকী হওয়া অত্যন্ত জরুরী। যুগশ্রেষ্ঠ সুফী কুতবুল আলম হযরত মাওলানা শাহ সুফী তোয়াজউদ্দিন আহমদ রহমাতুল্লি আলাইহি বলেন : তাকওয়া ছাড়া জীবন লাগামহীন অশ্বের মতো দিশেহারা হয়, যে কারণে সে দ্রুত পাপ-পঙ্কিলতায় এমনভাবে প্রবিষ্ট হয় যে, তার আলোতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ থাকে না। সিয়াম যে তাকওয়ার শিক্ষা দেয় তা ধরে রাখতেই জীবনের সফলতা। জীবনের পরতে পরতে সংযম নিষ্ঠার অনুশীলন পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তির প্রবাহ প্লাবিত করে। লেখক : পীর সাহেব, দারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×