ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

ক্রয়ক্ষমতা, শিল্প আর ভাতের জন্য দরকার কৃষি

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১৭ জুন ২০১৬

ক্রয়ক্ষমতা, শিল্প আর ভাতের জন্য দরকার কৃষি

এক সমস্যা যে আরেক সমস্যার সৃষ্টি করে তা অনেক সময় আমাদের ভাবতে অসুবিধা হয়। এই যেমন ব্যাংক আমানতের ওপর সুদ। আমরা জানি ব্যাংক এখন আমানতকারীদের কার্যত কোন সুদ দেয় না। বর্তমানে ব্যাংকগুলো যে হারে সুদ দেয় তা বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলে। অথচ বেশিদিন আগের কথা নয়, ব্যাংক ১২-১৩ শতাংশ হারে সুদ দিত। ব্যাংকাররা আমানতকারী, সম্ভাব্য আমানতকারীদের পেছনে পেছনে ঘুরত। সেদিন কবে গত হয়েছে। এখন ব্যাংক আমানতের জন্য ঘুরঘুর করে না। যারা পারে তারা আমানত ছেড়ে দেয়। এতে দৃশ্যতই ক্ষতিগ্রস্ত মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত লোকজন, রেমিটেন্স প্রাপক বয়োবৃদ্ধ গার্জিয়ানরা, বিধবা মহিলারা এবং নানা পেশা ও জীবিকার ছোট-মাঝারি চাকরিজীবীরা। লাভবান কে? সরকার? না, তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারীদের আয় হ্রাস পেলে সরকারের কী কোন লাভ আছে? না, তা নেই। বরং উল্টো ক্ষতি। কীভাবে? আমানতকারীরা সরকারের কাছে ‘সোনার হাঁস’। এরা যে টাকা ব্যাংকে রাখে তার ওপর সুদ পায়। সেই সুদের ওপর ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’ (এনবিআর) দশ এবং পনেরো শতাংশ হারে ট্যাক্স কেটে নেয়। এটা উৎসেই ব্যাংক কেটে ‘এনবিআর’কে দিয়ে দেয়। যাদের ‘টিআইএন’ আছে তাদের সুদে কাটা হয় দশ শতাংশ, আর যাদের ‘টিআইএন’ (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) নেই তাদের সুদ কাটা হয় পনেরো শতাংশ। এর দ্বারা বোঝা যায় যত বেশি সুদ হবে তত বেশি ‘উৎসে কর’ পাবে ‘এনবিআর’। সুদ কম হলে ‘এনবিআর’ ট্যাক্স পাবে কম। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ‘এনবিআর’-এর কপালে কম ট্যাক্স জুটছে বলে একটি খবরে দেখলাম। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই খাতে ‘এনবিআর’ পেয়েছিল ৬,০৭৫ কোটি টাকা। বর্তমান হারে ব্যাংক সুদ দিলে ‘এনবিআর’ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পেতে পারে ৫,২৮০ কোটি টাকা। আমার ধারণা বর্তমান সুদহার ঠিক থাকবে না। তার অর্থ মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারীদের দুর্দশা আরও বাড়বে, তাদের আয় আরও হ্রাস পাবে, সঙ্গে সঙ্গে ‘এনবিআর’-এর আয়ও হ্রাস পাবে, যদি না ‘এনবিআর’ করের হার আর না বাড়ায়। এ দ্বারা বোঝা যাচ্ছে অর্থনীতির এক সমস্যার মধ্যে লুক্কায়িত থাকে আরেক সমস্যা। ব্যাংকের আয় কম হলে ব্যাংক কম সুদ দেবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কারণ ব্যাংকও একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। অর্থনীতি ভাল চললে ব্যাংকও ভাল চলবে। সবাই লাভবান হবে। এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাংকের সমস্যার সঙ্গে সমস্যা হচ্ছে সঞ্চয়কারীদের, সমস্যা হচ্ছে সরকারের। বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের তুলনায় অনেক বেশি আন্তর্জাতিকভাবে সম্পর্কিত। অতএব সৌদি আরব যখন বলে ‘ওয়েজআর্নারদের’ আয়ের ওপর ট্যাক্স বসানো হবে তখন আমাদের প্রমাদ গুনতে হয়। কারণ যে প্রধান ১৪টি দেশ থেকে বাংলাদেশী ওয়েজআর্নাররা দেশে ‘রেমিটেন্স’ পাঠায় তার মধ্যে সৌদি আরব এক নম্বরে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যে ১৫ হাজার ৩১৬ মিলিয়ন (মিলিয়ন = দশ লাখ) ডলার রেমিটেন্স আসে তার মধ্যে ৩ হাজার ৩৪৫ মিলিয়ন ডলারই সৌদি আরবের। অতএব বোঝা যায় সৌদি আরব সরকারের কর বসানোর সিদ্ধান্তে আমরা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। ইতোমধ্যেই ‘রেমিটেন্সে’ টানও পড়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে মোট ‘রেমিটেন্স’ গেল অর্থবছরের তুলনায় যে কম হবে তা বলাই বাহুল্য। অথচ এই খাতে শনৈশনৈ অগ্রগতি হয়েছে। এর থেকে কী শিক্ষা নেব আমরা? আমাদের একটা অসুবিধা এই যে, যখন যেটাকে নিয়ে পড়ি তখন সেই বিষয় ছাড়া আমাদের সামনে আর কিছু থাকে না। ভিন্ন কিছু বলাও যায় না। একবার ‘তাল’ উঠল জাহাজ নির্মাণ শিল্প নিয়ে। সবাই বলল, জাহাজ নির্মাণ শিল্প পোশাক রফতানির পরেই স্থান পাবে। বললাম শিল্প; কিন্তু কার্যত বিষয়টা ছিল বাইরের কাঠ, লোহা, ইস্পাত, কারিগর-ইঞ্জিনিয়ার, আমাদের শুধু কাঠমিস্ত্রি। তা হোক, তবুও এ শিল্প হয়নি। ইউরোপের ল-ভ- অর্থনীতি আমাদের স্বপ্নকে তছনছ করে দেয়। জাহাজের অর্ডার আসা বন্ধ হয়, হ্রাস পায়। ফল? ব্যাংক যে ‘উত্তেজনায়’ ফিনান্স নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল, তারা বড় বাড়ি খায়। কোটি কোটি টাকা লোকসান, খেলাপী ঋণ এই খাতে। ‘মিডিয়ার’ উৎসাহী অংশ একে আবার ‘লুটপাট’ বলেও চালিয়ে দিতে পারে। গেল জাহাজ নির্মাণ শিল্প। এবারে মনে হয় চামড়াজাত পণ্য শিল্প। এই কিছুদিন আগেও কথা উঠলেই তরুণ উদ্যোক্তাদের একাংশ চামড়াজাত পণ্য অর্থাৎ পাদুকা শিল্পের কথা উঠলেই উচ্ছ্বাসে ভরে উঠত। তাদের ধারণা ছিল এই শিল্পের আকাশছোঁয়া সম্ভাবনা। আমি ব্যবসায়ের লোক নই। তবে ব্যবসা, শিল্প ও অর্থনীতির প্রতি নজর রাখি, খবর পড়ি, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলি। এখন দেখতে পাচ্ছি এই শিল্পের অবস্থাও সবিশেষ ভাল নয়। একটি খবরের কাগজে দেশের শীর্ষ পাদুকা তৈরির কোম্পানির খবর পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। খবরে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা দিন দিন কমছে। আগের রমরমা অবস্থা আর তাদের নেই। প্রতিষ্ঠানটির জন্ম স্বাধীনতার পরপর সময়ে। বর্তমানে তারা সর্বোচ্চ বিক্রির কোম্পানি। দেশের ভেতরে তাদের খুচরা ‘আউটলেট’ আছে। রফতানির বাজার তাদের বেশ বড়। ডলার ও ইউরোর দাম হ্রাস, পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে কোম্পানিটির এখন দুর্দিন চলছে। মুনাফার পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোটায়। কোম্পানির নাম না বলে ঘটনাটা উল্লেখ করলাম। অবস্থাটা বোঝার জন্য পাদুকা শিল্পের মোট রফতানির দিকে একটু দৃষ্টি দিই। দেখা যায় ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত পাদুকা শিল্পের রমরমা অবস্থা ছিল। তাদের রফতানির পরিমাণ শনৈশনৈ বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জুতা রফতানির পরিমাণ ছিল ২০৪ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই রফতানি বেড়ে হয় ৪১৯ মিলিয়ন ডলার। দ্বিগুণেরও বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ হ্রাস পেয়ে হয় ১৭১ মিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও এমনই একটা কিছু হবে। এসবই বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত খাতওয়ারি তথ্য। এর থেকেই বোঝা যায় দেশের সর্ববৃহৎ পাদুকা কোম্পানির অবস্থা কেন কাহিল। খবর নিয়ে জানলাম, পুনরুদ্ধার কবে হবে কেউ তা নিশ্চিত করে বলতে পারে না। বলাই বাহুল্য, আমরা টিকে আছি পোশাক রফতানির ওপর। ‘রেমিটেন্স’ হ্রাস পেলেও পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এই শিল্পের ব্যবসায়ীরা, কারখানা মালিকরা প্রতিদিন পোশাক শিল্পের অব্যাহত প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে আমাদের আশাবাদ শুনিয়ে যাচ্ছেন। এখনও পর্যন্ত তাদের আশাবাদের ভিত্তি আছে বলে মনে হয়। তবে সাবধানের মার নেই বলে একটা কথা আছে। আপতকালীন অবস্থার প্রস্তুতি সবসময়ই থাকা দরকার। এক পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক দেশের এখন বিপদ চলছে। সৌদি আরব একটি উদাহরণ। ভেনিজুয়েলা আরেকটি উদাহরণ। রাশিয়া ইত্যাদি দেশের কথা বাদই দিলাম। গ্রামের লোকেরা বলত, ‘এক পুতের কোন ভরসা নেই।’ এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা অনেক পুতের বাবা হতে চাইত। পণ্যের ক্ষেত্রেও তাই। ভেনিজুয়েলা এখন বলে তেলের দাম দ্বিগুণ না হলে তাদের বাঁচার উপায় নেই। তাদের প্রার্থনা মোতাবেক যদি তেলের দাম দ্বিগুণ হয় তাহলে আমাদের হবে মরণ। আমরা গত ৫-৭ বছর বেঁচে গেছি তেলের নিম্নমূল্যের জন্য। বেশ স্বস্তিতে আমরা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ। ডলারের দাম স্থিতিশীল। ভর্তুকির পরিমাণ সহনশীল। এসবই কিন্তু তেলের দাম কম বলে। তেলের দামের কারণে অন্যান্য পণ্যের মূল্য কম। এসব কথা কিন্তু আমাদের মনে থাকে না। সব দিন যে সমান যায় না এ কথা মনে রেখে আমাদের চলতে হবে। এক পণ্যের, দুই পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। এ কথা বলি আমরা, ফল কিন্তু বাস্তবে শূন্য। আমাদের আসলে ‘ম্যানুফেকচারিং’ শিল্প গড়ে তুলতে হবে। ‘পোশাক’ তৈরিকে আমরা শিল্প বলি, প্রকৃতপক্ষে এটা সেলাইয়ের কাজ, কোনভাবেই তা শিল্প নয়। কাজেই শিল্প গড়ে তোলা দরকার। আর শুধু রফতানিমুখী শিল্প হলে চলবে না, রফতানি বাজারের সঙ্গে সঙ্গে দরকার দেশীয় বাজার। দেশীয় শিল্প যে খুব বেশি হচ্ছে না তার নানা প্রমাণ আছে। একটা প্রমাণ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। তারা সমানে বলে যাচ্ছেন শিল্প করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। জমি নেই; এর দাম বেশি, রয়েছে হস্তান্তর জটিলতা। বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না, যদিও বিদ্যুতের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। গ্যাসের সরবরাহ অপ্রতুল। অবকাঠামোর অসুবিধা আছে। ব্যাংক ফিনান্স এখন সমস্যা নয়। সুদের হার অনেক কমেছে। বিদেশ থেকেও ঋণ নেয়া যায়। কিন্তু ব্যাংক ঋণের সমস্যা অন্যত্র। ব্যাংক ঋণ কেন্দ্রীভূত ঢাকা ও চট্টগ্রামে। দ্বিতীয়ত ঋণ কেন্দ্রীভূত বড় বড় ঋণে, যা বস্তুত আটকা পড়ে যাচ্ছে। ‘রিস্ট্রাকচার্ড’ করে বড়রা টিকে আছে। তারা এত বেশি ঋণ নিয়েছে যে, এখন তাদের ক্যাশ ফ্লো যথেষ্ট নেই। ফলে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। তাদের সুদ কমানো হয়েছে, পরিশোধের সময় বাড়ানো হয়েছে, গ্রেস পিরিয়ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু তবু মনে হয় তারা শঙ্কামুক্ত নয়। তাদের অনেকের টাকা জমিতে আটকা। জমির দাম কম, ক্রেতার সংখ্যা কম। ফলে বিপদ উভয় দিকে। এদিকে দেখা যাচ্ছে ঋণ যাচ্ছে তিনটি খাতে। একটি খাত হচ্ছে ‘কনজিউমার ফিনান্সিং’, আরেকটি খাত হচ্ছে ‘আরএমজি’ (পোশাক খাত) এবং সর্বশেষ হচ্ছে ‘বাণিজ্যিক’। এসব বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য। এখানে শিল্প কোথায়? কনজিউমার লোন হচ্ছে ২১৮ বিলিয়ন টাকা, আরএমজিতে আছে ৮০১ বিলিয়ন (বিলিয়ন সমান শত কোটি) টাকা এবং বাণিজ্যিক খাতে আছে ১০৯০ বিলিয়ন টাকা। যত যুক্তিই থাকুক না কেন, এটা কাম্য পরিস্থিতি নয়। ১৪-১৫ শতাংশ ঋণ বাড়ছে, শিল্পের কত? এ তথ্য দরকার। দেশীয় বাজার, লোকের ক্রয়ক্ষমতা এবং শিল্প তিনটি দিকেই নজর দরকার। আর খাওয়া-পরার জন্য দরকার কৃষি। লেখক : সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×