ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিজ্ঞানের দুনিয়ায় আমরা কোথায়? ঈশ্বর কণার পর মহাকর্ষ তরঙ্গের সন্ধান লাভ

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১৭ জুন ২০১৬

বিজ্ঞানের দুনিয়ায় আমরা কোথায়? ঈশ্বর কণার পর মহাকর্ষ তরঙ্গের সন্ধান লাভ

(১৫ জুনের পর) আসলে সত্যিটা হলো, আইনস্টাইন নিজেও প্রথম দিকে মহাকর্ষের অস্তিত্ব মানতে চাননি। পরে অবশ্য তিনি নিজের তত্ত্বের ওই ফলাফল মেনে নেন। এই মানামানির ব্যাপারে আইনস্টাইনের ভাবনা-চিন্তা কিন্তু বিচিত্র। আইনস্টাইন মানতে চাননি যে, ব্ল্যাকহোল বাস্তব বিশ্বে থাকতে পারে। ঢেউয়ের ফলে ‘স্পেস’ কাঁপে। মানে আয়তনে একবার বড় এবং একবার ছোট হয়ে যায়। যেহেতু ঢেউয়ের জন্ম পৃথিবী থেকে হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরে, তাই তার প্রভাব যখন পৃথিবীতে পৌঁছায়, তখন তা ক্ষীণ হয়ে যায়। ওই ক্ষীণতাই মহাকর্ষ-তরঙ্গ শনাক্ত করার প্রধান অন্তরায়। পৃথিবীতে আছে নানা রকম ঝাঁকুনি- ভূমিকম্প, ভারি ভারি ট্রাকের গতি, এমনকি সমুদ্রের ঢেউ পাড়ে আছড়ে পড়ার ঘটনা। তার মাঝখান থেকে পৃথিবীতে পৌঁছানো অতিক্ষীণ মহাকর্ষ-তরঙ্গ শনাক্ত করা খুব কঠিন কাজ। অতি সংবেদশীল যন্ত্রের সাহায্যে সেটাই আমেরিকায় করছেন বিজ্ঞানীরা। কীভাবে করছেন? যে প্রকল্পে কাজ হয়েছে তার নাম ‘লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজার্ভেটরি’ (এলআইজিও)। আমেরিকার লিভিংস্টোন এবং হ্যানফোর্ড শহরে চার কিলোমিটার লম্বা দুটো ফাঁপা পাইপের দৈর্ঘ্য লেজার রশ্মির সাহায্যে মেপেছেন বিজ্ঞানীরা। মাপতে গিয়ে দেখেছেন, গত ১৪ সেপ্টেম্বর যখন দুটো ব্ল্যাকহোল মিশে গিয়ে মহাকর্ষ-তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিল তখন ওই চার কিলোমিটার আর চার কিলোমিটার ছিল না। বেড়ে-কমে গিয়েছিল। অর্থাৎ স্পেসের আয়তন বাড়ছিল এবং কমছিল। বিজ্ঞানীরা উল্লসিত এ কারণেই। কারণ এবার থেকে নতুন এক ‘চোখে’ দেখা যাবে মহাবিশ্বকে। আগে দেখা যেত শুধু কোন ঘটনা থেকে আসা আলোর সাহায্যে। এবার দেখা যাবে একেবারে নতুন আর এক উপায়ে। এতদিন মহাবিশ্ব যেন ছিল শুধু এক নাটক, যাতে অভিনেতাদের শুধু মঞ্চে আসা-যাওয়া ঠাহর হতো। এবার থেকে যেন শোনা যাবে তাদের কথাবার্তাও। এতসব ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে যাচ্ছে; কিন্তু তা নিয়ে আমাদের দেশে কোন উচ্চবাচ্য নেই। কারণ আমাদের দেশে বিজ্ঞান নিয়ে কোন চর্চা বা গবেষণা নেই। অথচ এই পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার একটি উত্তম স্থান গড়ে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু গবেষণা আর অব্যাহত থাকেনি। এজন্য দুটো বিষয় প্রয়োজন। একটি হলো আর্থিক, অন্যটি মানসিক। অর্থাৎ গবেষণার জন্য যেমন প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন আগ্রহী বিজ্ঞানীর। আমাদের দেশে এ দুটো বিষয়েরই অভাব রয়েছে। ফলে আমরা বিজ্ঞান শিক্ষায় কেবল পিছিয়েই পড়ছি। অথচ আমাদের দেশে মেধাবীদের অভাব নেই। কিন্তু আমরা তাদের কাজে লাগাতে পারছি না। সেই মেধা এক পর্যায়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। দেশে সুযোগ না থাকায় মেধাবীরা পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার চিত্র বোঝা যায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ দেখলে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ছিল ২৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় অর্থাৎ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হচ্ছে ২৪৩ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন বাজেট ছিল মাত্র ছয় কোটি টাকার। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কারণে সংশোধিত বাজেটে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫১ কোটি টাকা। তবে উন্নয়ন বাজেট সেই ছয় কোটি টাকাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে আরও হাস্যকর চিত্র দেখা যায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দে। এ খাতে মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় তথা বেতন-ভাতা বাবদ খরচই হচ্ছে ৩৬৯ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন বরাদ্দ হচ্ছে মাত্র ৩ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যা ছিল ছয় কোটি টাকা তা আগামী অর্থবছরে তিন কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এই হলো দেশের জাতীয় পর্যায়ের বিজ্ঞান খাতে বরাদ্দের হাল। বোঝাই যাচ্ছে, এখানে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার জন্য আলাদা কোন বরাদ্দ বা প্রকল্প নেই। দেশে বিজ্ঞান গবেষণাগারের করুণ অবস্থা। স্কুল পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি জাতীয় পর্যায়েও আধুনিক গবেষণাগার নেই। আর জাতীয় পর্যায়ে যে গবেষণাগার রয়েছে সেখানে প্রথাগত বিষয় নিয়ে গবেষণা হয়। তাও অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দের কারণে সম্ভব হয় না। ছাত্রছাত্রীদের ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হলে স্কুল পর্যায়ে ভাল গবেষণাগার প্রয়োজন। অথচ দু-একটি স্কুল ছাড়া ঢাকা শহরের স্কুলগুলোতে কোন আদর্শ বিজ্ঞানাগার নেই। গ্রামের কথা তো বাদই দিলাম। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও একই অবস্থা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানাগার থাকলেও সারাদেশে গজিয়ে ওঠা শত শত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার কোন সুযোগ নেই। তাহলে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিজ্ঞান শিক্ষার আগ্রহ তৈরি হবে কিভাবে? বিজ্ঞান চর্চা একটি ব্যয়বহুল বিষয়। তাই বিজ্ঞান শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হলে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। স্বাধীনতার পর এ দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রপথিক ছিলেন বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া। প্রতিকূল পরিবেশের মাঝেও তিনি চেষ্টা করে গেছেন বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু বৈরী সরকার তাকে বাধাগ্রস্ত করতে গিয়ে দেশের বিজ্ঞান চর্চাকেই স্থবির করে দিয়েছে। কিন্তু এখন তো দেশে তার অনুকূল সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। সরকার বিজ্ঞান গবেষণাকে এগিয়ে নিতে ভারতের ‘ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর এ্যাস্ট্রোনমি এ্যান্ড এ্যাস্ট্রোফিজিক্সের (আইইউসিএএ)’ মতো তার নামে একটি উচ্চতর বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে, যেখানে দেশের বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক বিষয় নিয়ে গবেষণা ও চর্চা করবেন। বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেবেন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের মাঝে; যারা এক সময় বড় হয়ে বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে দেশকে আলোকিত করবে। (সমাপ্ত)
×