ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পের পরিব্রাজন সারা বিশ্বময়

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ১৬ জুন ২০১৬

শিল্পের পরিব্রাজন সারা বিশ্বময়

আতিকুল ইসলাম শিল্পের পরিব্রাজন সারা বিশ্বময়। শিল্পীর পরিব্রাজন ত্রিমাত্রিক বিশ্ব ছাড়িয়ে কল্পনার শাখা, প্রশাখায়, ফুলে, গন্ধে, রসে। শিল্পী কল্পনা ও বাস্তবে পরিব্রাজনের অভিজ্ঞতাই দর্শকের সামনে উপস্থাপন করেন তাঁ দেখা দুনিয়ার মতো করেই। সামান্য কিছু সময়ের মধ্যে। দর্শক দেখে আস্বাদন করে কখনও চিন্তাও করে এবং চলে যায়। চলে যায় ‘বাস্তব’ দুনিয়ায়, থিয়েটারের ‘বাস্তবতা’ ছেড়ে। দর্শকের থাকে না কোন শারীরিক স্মৃতি। মানসিক স্মৃতি যা দর্শন ইন্দ্রীয়জাত; তার গুরুত্ব কম বা বেশি তা আলোচ্য নয় বরং স্থানিক পরিব্রাজনের মধ্য দিয়ে যে রস দর্শক আহরণ করবে তার কতটা আছর পড়বে/প্রভাব ফেলবে সাধারণ দর্শকের দৈনন্দিন জীবনের উপর তাই আলোচ্য। ২৩ এপ্রিল উইলিয়াম শেক্সপিয়ার প্রয়াণের চারশ’ বছর পার করল পৃথিবী, একজন লেখক যার লেখা নাটক তার মৃত্যুর চার’শ বছর পরে সমানভাবে চর্চিত এবং পঠিত। তার এই মহাপ্রয়াণ দিবস উপলক্ষে ব্রিটিশ কাউন্সিল ১৪০টি দেশে ‘শেক্সপিয়ার লিভস গ্লোবাল প্রোগ্রাম ২০১৬’ এর আয়োজন করে, এই উদযাপনের সূত্র ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার এ্যান্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজ বিভাগের সাথে যৌথভাবে ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের আয়োজন কিছুটা ভিন্নতর আমেজ দিয়েছে দর্শক মনে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ৭টি নাট্যাংশ থিয়েটার এ্যান্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান, সহকারী অধ্যাপক সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় উপস্থাপিত হয় দর্শকের সামনে। ‘শেক্সপিয়ার সপ্তক’ যার সম্পূর্ণ উপস্থাপনাকে ‘পরিব্রাজন নাট্য’ বলা যায়। পরিবেশনাগুলো প্রচলিত উপস্থাপনা রীতির থেকে ভিন্ন এবং কার্যকর। ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রবেশ পথ সেদিন বেশ সাদামাটাই ছিল। অভ্যন্তরে যাবার পর পাঠাগারের ফটক ঠেলে ভেতওে প্রবেশের খানিক বাদেই খুবই অনাড়ম্বর উপস্থাপনায় বুঝিয়ে দেয়া হলো সাতটি ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু নিকটবর্তী স্থানেই নাট্য উপস্থাপনা হবে। নাটক শুরু হবার আগেই দেখে নিলাম চারপাশ। তেমন কোন বিশেষ সাজসজ্জা দৃশ্যমান হলো না, ছিল ব্রিটিশ কাউন্সিলের স্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতা এবং পরিচ্ছন্ন দর্শক। তবে এটা বোঝা যাচ্ছিল যে এখানে কিছু উপস্থাপিত হবে যার জন্য অধীর হয়ে স্থিরভাবে অপেক্ষা করছে দর্শক। দর্শকের এই মৌন অপেক্ষাই কোন আয়োজন সার্থক হবার পূর্বলক্ষণ। নাট্যাংশগুলো সাজানো হয়েছে এমনভাবে যাতে নাটকের মূল ভাব দশ মিনিটের একটি দৃশ্যের মাধ্যমেই ফুটে ওঠে। অভিনীত অংশগুলো ছিল নাটকের বিখ্যাত স্বগতোক্তি, একালাপ ও দ্বৈতালাপের দৃশ্য। সাধারণত শেক্সপিয়ারের নাটক মানেই অলঙ্কার বহুল সেট, নির্দিষ্ট পোশাক, প্রচুর পরিকল্পিত আলো, স্টাইলাইজড অভিনয়ই আমাদের চোখের সামনে ভাসে এবং অভিনেতাদের ফোর্থ ওয়ালও কার্যকর থাকে। কিন্তু এই উপস্থাপনায় কোন বিশেষ সেটের ব্যবহার করা হয়নি। সামান্য কিছু আলো দিয়ে অভিনেতার দৃশ্যমানতা ধরে রাখা হয়েছে চরিত্রায়নের জন্য যতটুকু প্রয়োজন পোশাক সেরকমই। সুন্দর এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে আবহ সঙ্গীত। অভিনয়ের ক্ষেত্রে কিছু নাট্যাংশে ঘটনা ঠিক রেখে সমসাময়িক আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে যার ফলে দর্শক অল্প সময়ের মধ্যেই নাটকের সাথে একাত্ব হতে পেরেছে (‘মিড সামার নাইটস ড্রিম’, ‘এ্যাজ ইউ লাইক ইট’)। এছাড়াও উত্তর আধুনিক নৃত্যশৈলী/ দেহভঙ্গীর ব্যবহার অভিনয়কে আরও সমৃদ্ধ করেছে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ লেগেছে দর্শক ও অভিনেতার মুখোমুখি অবস্থান যা ফোর্থ ওয়াল কনভেনশন কিছুটা অবজ্ঞা করে। দর্শক ছিল সম্পূর্ণ আলোতে যার ফলে অভিনেতার সাথে প্রায় প্রতিমুহূর্তেই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মোটেও সহজ নয় দর্শকের মুখোমুখি অভিনয় করা এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রচণ্ড তাৎক্ষণিক ক্রিয়া করার ক্ষমতা থাকতে হয় অভিনেতার। আর এ ক্ষমতা অর্জনের জন্য সুপরিকল্পিত দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্যদিয়ে প্রস্তুতি নেয়া দরকার। যে একাগ্র অনুশীলনের ছাপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ও পারফর্মেন্স স্টাডিজের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় বিদ্যমান ছিল । হ্যামলেট, ওথেলো, ম্যাকবেথ, এজ ইউ লাইক ইট, এ মিড সামার নাইটস ড্রিম, রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট, টেমিং অব দ্যা শ্রু, এর অনবদ্য অভিনয় দর্শকের দৃষ্টি আটকে রেখেছে সারাক্ষণ। আগেই বলেছি সাতটি নাট্যাংশ চারটি ভিন্ন স্থানে অভিনীত হয়েছে। ‘ম্যাকবেথ’ ও ‘এ মিড সামার নাইটস ড্রিম” লাইব্রেরিতে, ‘ওথেলো’ ও ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট’ ওডিটোরিয়ামে, ‘হ্যামলেট’ ও ‘টেমিং অব দ্যা শ্রু’ যথাক্রমে রুম নং ২ ও ৪ এ। ‘এ্যাজ ইউ লাইক ইট’ বাগানে অত্যান্ত সুন্দর সাবলীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। একই নাট্যাংশ পরপর তিনবার প্রদর্শিত হয়েছে যার কারণে দর্শক চাইলে সব নাটক দেখতে পেরেছেন। কিছুটা চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর মতোই ছিল এই ‘পরিব্রাজন নাট্য’। শেক্সপিয়ার চর্চাকে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে জীবন্ত ও যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন সুদীপ চক্রবর্তী নাট্য প্রদর্শনীর মাধ্যমে। কথা হচ্ছিল সুদীপ স্যারের সাথে সমগ্র প্রযোজনার প্রস্তুতি, চিন্তা ও শেক্সপিয়ার চর্চা বর্তমানে কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে। তিনি বেশ সরাসরিই বললেন ‘দীর্ঘ প্রস্তুতির মধ্যেই থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার এ্যান্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজ বিভাগে সকল শিক্ষার্থীরা। এই নাটকগুলোর জন্য দীর্ঘ সময় অভিনেতারা অনুশীলন করেছেন, চরিত্রগুলোকে যৌক্তিক গবেষণা করে নিজেদের অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন, আমি এই দীর্ঘ পথে তাদের সারথি ছিলাম। আমি নির্দেশক অভিনেতা সম্পর্ককে কিছুটা ভিন্নভাবে দেখি, অভিনেতা ও নির্দেশক তাদের এক ও অভিন্ন চর্চার মাধ্যমে একে অপরের শিল্পসত্তাকে উদ্দীপ্ত করবে। শানিত করবে প্রতি মহড়ায়, তার ভেতর থেকেই তৈরি হবে নাটক শিল্প। এই উপস্থাপনের রীতির তেমন কোন প্রচলন আসলে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল, আমার চিন্তা কাজ করেছে সমগ্র শেক্সপিয়ারকে একই ফ্রেমে বাঁধা কিন্তু প্রত্যেকটা নাটকের স্বকীয়তা বজায় রেখে। তাই চিত্র প্রদর্শনীর মতো করে আমি দেখতে চেয়েছি শেক্সপিয়ারকে ভিন্ন ফ্রেমে ভিন্নভিন্ন রঙে। চিত্রকরের সাথে পার্থক্য হলো তাদের ফ্রেম রং তুলি আর আমাদের অভিনেতা, সেট, লাইট, কসটিউম, মিউজিক। বাংলাদেশ নয় সমগ্র বিশ্বে ক্ষমতালোভীদের যে দানবীয় খেলা চলছে তার সাথে শেক্সপিয়ারের অনেক রচনাই যৌক্তিকভাবে উপস্থাপনযোগ্য যেমন ম্যাকবেথ, হ্যামলেট ও ওথেলো। হ্যামলেট নাটকে অভিনয় করেছেন আহসানুল আবেদিন, এ্যাজ ইউ লাইক ইট নাটকে শামিম মিয়া এবং তারিকুল হক, টেমিং অব দ্যা শ্রু’তে অভিনয় করেছেন রাফেকুল ইসলাম সবুজ এবং মারিয়া খানম, এ মিড সামার নাইটস ড্রিম-এ অভিনয় করেছেন আযাহার উদ্দিন ও প্রণব শর্মা। ম্যাকবেথ নাটকে অভিনয় করেছেন লাতিফুল কাবির, কৃতী বিজয়া, আব্দুল্লাহ আল জাবির এবং নাসুমা হক। ওথেলো নাটকের অভিনেতারা হলেন আশরাফুল আলম, রঞ্জিব নায়েম, নুসরাত জাহান। রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট নাটকে অভিনয় করেছেন মনিরুজ্জামান তামান্না ইসলাম, সাজিব রানা ও সাদিয়া মাহাবুব। শেক্সপিয়ার সপ্তকের সেট, আলো, পোশাক, দ্রব্য, সঙ্গীত পরিকল্পনা করেছেন নাটকের অভিনেতারাই। কোরিওগ্রাফি করেছেন অমিত চৌধুরী। এই নাট্য প্রদর্শনীকে সফল করতে সবসময় পাশে থেকে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার এ্যান্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষকগণ। এছাড়াও এই নাট্য প্রদর্শনী সৃজনে সবসময় উদ্দীপনা যুগিয়েছেন কুইন ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংল্যান্ডের প্রফেসর এলেস্টার কেম্পাবেল। কোন নাটককে পুনঃপুনঃভাবে একই রকম উপস্থাপনা একধরনের একঘেয়ে মনোভাব তৈরি করে, কিন্তু এই ‘নাট্য প্রদর্শনী’ কিংবা ‘পরিব্রাজন নাট্য’ শেক্সপিয়ারকে নতুনভাবে আবিষ্কারের চেষ্টাকে উস্কে দিয়েছে শিল্পপ্রেমীদের মনে। এই ধরনের শিল্প মানসমৃদ্ধ কাজ আরও বৃহৎ পরিসরে আন্তর্জাতিকভাবে হওয়া উচিত। শিল্পের কোন সীমারেখা নেই। প্রাচ্য পাশ্চাত্য যে কোন জায়গার উপস্থাপনা রীতিই আমাদের জন্য চিন্তার একেকটা নতুন দুয়ার। সমগ্র বিশ্বই শিল্পীর, শিল্পী নিজে সার্বজনীন। আর বিশ্বকে না জানলে নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা তৈরি হয় না। এই ধরনের আয়োজন আমাদের চিন্তাকে প্রসারিত করার সুযোগ করে দেয়। এই ধরনের চর্চাকে অব্যাহত রাখার মাধ্যমেই শিল্পের এক ভিন্নদিগন্ত উন্মচিত হতে পারে বলে - বিশ্বাস করি।
×