ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বুলবুলকে রিমান্ডে আনা হতে পারে আজ

মিতু হত্যা ॥ দীর্ঘ ১১ দিনেও ক্লু হাতড়ে বেড়াচ্ছে পুলিশ

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৬ জুন ২০১৬

মিতু হত্যা ॥ দীর্ঘ ১১ দিনেও ক্লু হাতড়ে বেড়াচ্ছে পুলিশ

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ এগারো দিনেও মিতু হত্যার রহস্য উদঘাটনে আদৌ কোন কূলকিনারা মেলেনি। পুলিশ, পিবিআই, সিআইডি, র‌্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগ কেবলই ক্লু হাতড়ে বেড়াচ্ছে। হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে যে সকল তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন এর বেশিরভাগের মধ্যেই রয়েছে অস্পষ্টতা, সমন্বয়হীনতা ও মোবাইলে কথোপকথনের স্টাইলে। এতে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে খুনীরা। উগ্রপন্থী, জঙ্গী, জামায়াত-শিবির ও ভাড়াটে কিলার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সিএমপিতে এখন ওই পাঁচ কমিটি হিমশিম খাচ্ছে। কিভাবে এগোচ্ছে তদন্ত কার্যক্রম সিএমপির ওই ৫ কমিটির কর্মকর্তারাÑএ নিয়ে প্রশ্ন নিহতের পরিবার, পুলিশ বিভাগসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মিডিয়াকর্মী এমনকি দেশবাসীর। ঘটনা তদন্তের প্রথমদিকে সিএমপি কমিশনার প্রেস ব্রিফিংয়ে সিসি ক্যামেরা চালু না থাকার দোহাই দিয়ে সিটি কর্পোরেশনের বিল বোর্ড উচ্ছেদ অভিযানে জিইসি মোড়ের ক্যামেরা নষ্ট থাকাকে দায়ী করেন। অথচ, যে বিলবোর্ডের পিলার থেকে সিসি ক্যামেরাগুলো খুলে নেয়া হয়েছে সেখানেই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে লালখান বাজার-মুরাদপুর ফ্লাইওভারের কাজের সুবিধার্থে তিনটি হ্যালোজেন লাইট। এসব লাইটের পিলারে সিসি ক্যামেরা লাগানোর মতো যথেষ্ট সুযোগ থাকার পরও চরম দায়িত্বহীনতার কারণে পুলিশ এসব ক্যামেরা লাগায়নি। অথচ, এসব ক্যামেরা থাকলে মিতু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা যেমন সহজ হতো তেমনি ঘটনার আগে বা পরে সন্দেহভাজনদের এ ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করাটাও সহজ হতো। তবে নগরবাসীর প্রশ্ন, পুলিশ হয়ত নিজেই চায় না সিসি ক্যামেরায় অপরাধের ফুটেজ সংগৃহীত হোক। গত ১২ জুন আইজিপির পক্ষ থেকে নির্দেশিত পন্থায় সিএমপিতে মিতু হত্যার ক্লু উদঘাটনে যে পাঁচটি কমিটি গঠন করা হয়েছে তারাও এখন হাতড়ে বেড়াচ্ছে অন্ধকারে। এর মূল কারণ হচ্ছে চরম অনভিজ্ঞতা ও দায়সারা গোছের ক্লু উদঘাটনের চেষ্টা। জেএমবিসহ উগ্র জঙ্গীগোষ্ঠী এমনকি জামায়াত-শিবিরের দিকে প্রথম পর্যায়ে এসব কমিটির তীর ছুড়লেও অভিযোগ উঠেছে শাহ জামান ওরফে রবিনকে ভাড়াটে খুনী হিসেবে চিহ্নিত করতে চায় পুলিশ। সিএমপি কমিশনার রবিনকে গ্রেফতারের পর মিডিয়াকে নিশ্চিত করেছেন ভিডিও ফুটেজে থাকা ও মোটরসাইকেলের তিন আরোহীর একজন রবিন হওয়ার নিশ্চয়তা শতভাগ। ফলে রবিনকে সাত দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এরমধ্যে পার হয়েছে তিনদিন। কিন্তু পুলিশ বলেছে এখন পর্যন্ত কোন তথ্যই উদঘাটন হয়নি মিতু হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে। অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো এখন সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ ও পিবিআইয়ের মতো তৎপর কর্মকর্তার তদন্ত কার্যক্রম। কারণ তারা ঘটনাস্থল থেকে কোন ধরনের তথ্য পায়নি কিলারদের। কিলাররা রেকি করে আগেভাগেই ঘটনাস্থল চিহ্নিত করেছিল হত্যাকা-ের। ফলে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্পষ্ট ভিডিও ফুটেজ আর অয়েল ফুডের উল্টো দিকের ক্যামেরার পাশাপাশি কালীবাড়ির সিসি ক্যামেরা ঘটনার সময় বন্ধ থাকায় স্পষ্টতা নেই কিলারদের পরিচয়ে। অথচ, আইজিপি একেএম শহীদুল হকের নির্দেশনার পর সিএমপিতে গঠিত ৫টি কমিটি অন্ধকারে তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের তথ্য উদঘাটনে। এরমধ্যে রয়েছে, অস্পষ্ট ভিডিও ফুটেজ থেকে কিভাবে কিলারদের ছবি স্পষ্ট করা যায় সে চেষ্টা চলছে কয়েক অধঃস্তনের মাধ্যমে। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টিও অনভিজ্ঞ এসআইরা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গ্রেফতার অভিযানে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে কর্মকর্তারা চিন্তায় থাকছেন অস্পষ্ট ফুটেজ আর বেওয়ারিশ তথ্যের ভিত্তিতে। হত্যাকা-ের পর মিতুর হাত থেকে মোবাইলটি ছিনিয়ে নিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। ঘটনার কিছুক্ষণ পর শুলকবহর এলাকার বাদুরতলায় বড় গ্যারেজ নামক স্থানের পাশ থেকে সেই মোবাইল ব্যবহার করেছে দুর্বৃত্তদের একজন। সে কলটি গিয়েছিল হাটহাজারীর কোন এক ব্যক্তির কাছে। তবে ওই ব্যক্তি বাবুল আক্তারের বা তার স্ত্রীর পরিচিত বলে জেনেছে পুলিশ। কিন্তু আদৌ সে ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে মিডিয়াকে কিছু জানায়নি তদন্ত কর্মকর্তারা। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসি ক্যামেরার ফুটেজের মাধ্যমে উদ্ধার হওয়ার মোটরসাইকেল রয়েছে গোয়েন্দা বিভাগের দ্বিতীয় তলায় সদ্য এ হত্যাকা-ের মনিটরিং থেকে বাদ পড়া কর্মকর্তা ডিসি মোস্তাক হোসেনের চেম্বারের সামনে। সিআইডি এ মোটরসাইকেলের হাতল ও সিটে বসা এমনকি ব্যবহৃত হেলমেটটি থেকে ডিএনএ টেস্টের জন্য কী উপাদান নিয়ে গেছেন তাও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে ওইসব ব্যবহৃত উপকরণ। তাহলে কি ভিডিও ফুটেজ কিংবা স্টীল ছবি থেকে ডিএনএ টেস্টের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে কিনা তা নিয়েও টেনশনে গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা। এদিকে, মিতু হত্যাকা-ের ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত সন্দেহভাজনকে ধরে সিএমপি কার্যালয়ের গোয়েন্দা বিভাগে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বাদ পড়েনি ফুটেজে থাকা ৬ বছর আগের মোটরসাইকেল বিক্রেতা, হত্যাকা-ে ব্যবহৃত বাবুর্চির মোটরসাইকেলটি চুরি হওয়ার ঘটনা গত ৮ মে তারিখের। এরপর থেকে কে বা কারা এ মোটরসাইকেলটি ব্যবহার করেছিল তাও খুঁজছে পুলিশ। আবার ঘটনাস্থলে আকস্মিকভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়া আবুল খায়ের গ্রুপের স্টাফ পরিবহনকারী মাইক্রোবাস চালক জানে আলমকেও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ছেড়ে দেয়া হয়েছে চালক ও আটককৃত মাইক্রোবাসটিও। এমনকি জানে আলমের মালিকানাধীন মাইক্রোবাসটি ব্যবহারকারী কর্তৃপক্ষকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে জানে আলমের বিষয়ে। হাটহাজারীর পশ্চিম ফরহাদাবাদ মুসাবিয়া দরবার শরীফের বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে গ্রেফতারকৃত আবু নসর গুন্নু সম্পর্কে। তবে গুন্নু ও রবিনের পৃথক সাত দিনের রিমান্ড শুনানির মধ্যে এখন জিজ্ঞাসাবাদ চলছে শাহ জামান রবিনকে। সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, রবিনকে জিজ্ঞাসাবাদের মাঝামাঝি পর্যায়ে গুন্নুকেও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করার কথা রয়েছে। কিন্তু আদৌ এ দুজনের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত উদঘাটন হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহে রয়েছেন সিএমপির ৫ কমিটির প্রধানরা। এদিকে, গত মঙ্গলবার বাকলিয়া থানার একটি অজ্ঞাত খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ তুলে পিবিআই ৫ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি নিয়েছে ফুয়াদ ওরফে মোহাম্মদ বুলবুলকে। বুধবার বুলবুল আরেকটি মামলায় চট্টগ্রাম আদালতে হাজিরা থাকার কারণে আজ বৃহস্পতিবার বুলবুলকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে নেয়ার কথা রয়েছে পিবিআইয়ের। এদিকে, বুলবুলের পাঠানো চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দুই পৃষ্ঠার চিঠিতে কর্ণফুলী থানাধীন খোয়াজনগর এলাকায় জেএমবির দুই কমান্ডারসহ ৫ জনকে গ্রেফতারের ঘটনা ও বিস্ফোরক বিভাগের প্রধান জাবেদ গ্রেনেড বিস্ফোরণে মৃত্যুর সঙ্গে এসপি বাবুল আক্তারসহ অন্যদের ভূমিকা ও নির্যাতন নিয়ে বেশকিছু তথ্য ছিল। প্রশ্ন্ উঠেছে, জেলখানা থেকে কিভাবে বুলবুল এই চিঠি বাইরে পাঠিয়েছে। এতে কারারক্ষীসহ সংশ্লিষ্ট রয়েছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে ও বাইরের সিভিলিয়ান। গত ৫ জুন ও আর নিজাম রোড আবাসিক এলাকার কাছেই প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করা হয় এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, সিআইডি ক্রাইম সিন স্পটটি ফিতা দিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে চাদরে ঢেকে দিয়েছে মৃতদেহটি। ক্রমান্বয়ে মিতুর মাথায় বিদ্ধ ৭ পয়েন্ট ৬৫ বোরের গুলির খোসাটির ছবি যেমন তুলছে তেমনি ছুরিকাঘাতের চিহ্নগুলোও ওপর নিশ্চিত করার চেষ্টা চালিয়েছে। একপর্যায়ে মৃতদেহের মুখম-লের কাপড় সরিয়ে গুলিবিদ্ধ অংশটিতে একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠি ঢুকিয়ে নির্মম সেই ছবিটিও কালেকশন করেছে। পরবর্তীতে সকাল সাড়ে আটটার দিকে মৃত দেহটি ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের সাদা রঙের পাজেরো টাইপ এ্যাম্বুলেন্সে করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ঘটনাস্থলে র‌্যাব, পুলিশ, সিআইডি, গোয়েন্দা বিভাগ, পিবিআইসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা খুনের ক্লু উদঘাটনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু দীর্ঘ এগারো দিনেও কোন ধরনের নিশ্চিত খুনী গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতকিছুর পরও হত্যাকারীদের পরিচয় না মেলাতে সংশয়ে রয়েছে পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। অপরদিকে, পুলিশ প্রধান চট্টগ্রামে মিডিয়ার সঙ্গে প্রেস ব্রিফিংয়ের পর সিএমপি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আধঘণ্টার রুদ্ধধার বৈঠক করেছেন চাঞ্চল্যকর হত্যার ক্লু উদঘাটনে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত ছিল পূর্ববর্তী তদন্তের হিসাব-নিকাশ বাদ দিয়ে পাঁচটি কমিটির মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে সূক্ষ্ম তদন্ত। তবে এসব কমিটি এখন হাতড়ে বেড়াচ্ছে অনভিজ্ঞতার পরিচয় নিয়ে। ফলে সিএমপির পক্ষ থেকে প্রতিদিনই মিডিয়াকে জানানো হচ্ছে, ‘বিশেষ কিছু থাকলে আমরা জানাব, তদন্ত চলছে, কোন অগ্রগতি নেই, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ঘাতকদের গ্রেফতারে আমরা কাজ করছি। আশা করি হত্যাকারীদের পেয়ে যাব’ এমন বক্তব্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের।
×