ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ণাঢ্য বর্ষাবরণ উদীচীর

মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে...

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৬ জুন ২০১৬

মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে...

মোরসালিন মিজান ॥ সেই কবে থেকে ফুটো হয়ে ছিল আকাশ! যখন তখন বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছিল। তাতে কী? বর্ষার শুরুটা কিন্তু বুধবার হলো! আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে যে দু-দশ ফোঁটা বৃষ্টির দেখা মিলল, এর আলাদা মূল্য। বাংলা একাডেমির বটতলায় সমবেত সুধী নবধারাজলে সিক্ত হলেন। প্রকৃতি যেন আরও সবুজ হয়ে ধরা দিল। উন্মুক্ত মঞ্চের অনুষ্ঠানেও কোন বিঘœ ঘটল না। বরং গান কবিতা নৃত্য সহযোগে চমৎকার বর্ষা বন্দনা হলো। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর আনন্দঘন আয়োজন উপভোগ করলেন নগরবাসী। স্বাগত জানালেন প্রিয় ঋতুকে। উৎসব শুরু হয় সকাল ৭টার কিছু পরে। তারও আগে সেখানে গিয়ে এতটুকুন ক্ষতি হয়নি। উপরন্তু চারপাশটা দেখে দিব্যি কাটে! বহুকাল দেখা প্রবীণ বটবৃক্ষটিকে আরও সতেজ, আরও সবুজ মনে হয়। চোখ জুড়ানো সবুজ যে বর্ষারই অবদান। এ অবদানের কথা মাথায় রেখেই হয়ত বটতলায় সাজানো হয় মঞ্চ। ‘নীপবনে ছায়াবীথিতলে’ উৎসবের সূচনা হয় যন্ত্রসঙ্গীতে। ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে’ গানের চিরচেনা সুর গ্রামীণ জীবনের স্মৃতিকে সামনে নিয়ে আসে। বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা নয় শুধু, ঐতিহ্য ধরে রাখার দাবিও যেন ওঠে আসে লোক বাদ্যযন্ত্র থেকে। প্রিয়াঙ্কা গোপ ততক্ষণে বসে গিয়েছিলেন তানপুরা নিয়ে। এই কণ্ঠ সুর নিয়ে দারুণ খেলে। বর্ষা বন্দনার সময়ও দারুণ খেলাটির দেখা মিলল। শিল্পীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনবদ্য পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখল পুরোটা সময়। কণ্ঠ সঙ্গীতের পরিবেশনা নিয়ে প্রথমে আসে উদীচীর ধানম-ি শাখা। বর্ষার রূপ খুঁজতে তারা চলে যান পল্লীকবি জসীম উদ্্দীনের আসমানীর কাছে। কবির অমর কাব্য থেকে শোনানÑ বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাথার ছানি/ একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়, আসমানীরা বর্ষাকে বরণ করে না। বর্ষা বরণ করে নেয় আসমানীদের। দলের শিল্পীরা বরিশালের একটি আঞ্চলিক গান গেয়ে স্বাগত জানায় বর্ষাকে। পরের গানে রবীন্দ্রনাথ। ‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে’ গেয়ে শোনান শিল্পীরা। শেষ গানটিÑ ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী,/উড়ে চলে দিগ্দগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণ সঙ্গীতে/ রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম...। মঞ্চে প্রথম একক নিয়ে আসেন মহাদেব ঘোষ। বর্ষা শুরুর বার্তা দিয়ে তিনি গানÑ আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়েÑ/আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।/এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি/পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি...। প্রাণ চাঞ্চল্যের বাকিটুকু আবৃত্তি করে শোনান বেলায়েত হোসেন। তার নির্বাচনÑ হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে...। গানটি বার বার শোনা। আবৃত্তি তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে। বাংলার লোকসঙ্গীতও বর্ষা দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত। নাগরিক উদ্যাপনে এই ধারার সঙ্গীত কম গুরুত্ব পায়। ব্যতিক্রম বলতে হবে বিমান চন্দ্র বিশ্বাসকে। তার কণ্ঠে উকিল মুন্সি শহরেও সমান প্রিয় হয়ে ওঠে। এদিন তিনি গানÑ আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে/পূবালী বাতাসে/বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি/আমারনি কেউ আসে রে...। বর্ষা প্রেমিক রবীন্দ্রনাথকে এর পরই ফিরতে হয়। এবার কবিগুরু প্রকাশিত হন বুলবুল ইসলামের কণ্ঠে। আশ্চর্য সুন্দর কণ্ঠে ততোধিক সুন্দর গানটিÑ যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে/ সে কথা আজি যেন বলা যায়Ñ/এমন ঘনঘোর বরিষায়...। অনিমা মুক্তি গোমেজের পরিবেশনাটিও ছিল উপভোগ্য। গানে গানে বর্ষা বন্দনা করেন বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী, জিনাত ফেরদৌস, নৃপেন মিস্ত্রী, সাজেদা বেগম সাজু, শেলী রউফ প্রমুখ। উৎসব যেহেতু, নৃত্যের পরিবেশনা না হলেই নয়। অনেক্ষন অপেক্ষার মনের ভেতরে ধরে রাখা আনন্দের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটায় ‘নৃত্যম’ ও ‘স্পন্ধন’র শিল্পীরা। ফোক বাংলা ও অগ্নিবীণা নামের দুটি সংগঠনও বিভিন্ন পরিবেশনা নিয়ে উপস্থিত হয়। বর্ষা উৎসবে বিশেষ গীতি-আলেখ্য ‘বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর’ পরিবেশন করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা। এছাড়াও ছিল উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর মিরপুর, বাড্ডা, তুরাগ, কাফরুল ও নবাবগঞ্জ শাখার শিল্পীদের পরিবেশনা। উৎসবের দারুণ সংযোজন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের আবৃত্তি। শুরুর দিনেই আষাঢ় শেষের কথা শোনান তিনি। বেছে নেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রিয় কবিতা। ‘আনন্দ ভৈরবী’ থেকে শুনিয়ে যানÑ আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি/এমন ছিলো না আষাঢ় শেষের বেলা/উদ্যানে ছিল বরষা-পীড়িত ফুল/আনন্দ-ভৈরবী...। পরের কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘শাশ্বতী’। ভরাট কণ্ঠে দারুণ বেজে ওছেÑ শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে,/প্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া;/স্বর্ণ সুযোগে লুকোচুরি-খেলা করে/গগণে গগণে পলাতক আলো-ছায়া...। এদিন বর্ষা কথনে অংশ নেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সভাপতি কামাল লোহানী, সহ-সভাপতি শংকর সাওজাল এবং উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সভাপতি কাজী মোহাম্মদ শীশ। কামাল লোহানী বলেন, বর্ষা যখন নামে আমরা আনন্দিত হই। বর্ষণ সিক্ত শরীরে আমরা শান্ত হই। স্বস্তি বোধ করি। কিন্তু ঝড় যখন আসে, সব লোপাট করে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের বর্তমান সময়টি ঝড় কবলিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, অন্যায় অসুন্দর আমাদের গ্রাস করতে চাইছে। তিনি বলেন, আমাদের নদী শুকিয়ে গেছে। ভূমিদস্যুরা সব দখল করে নিয়েছে। জল সেচে সেখানে মাটি ফেলে দালানকোঠা করেছে। কোথায় উৎসব করবো তাহলে? শঙ্কর সাঁওজালের ছোট্ট বলায় অনেক কথা। তিনি বলেন, উদীচীর বর্ষা উৎসব কেবল নাগরিক সাংস্কৃতিক আয়োজন নয়। এখান থেকে তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই আমরা। যারা এই সময়ে চৌচির মাঠে আকাশের দিকে দু হাত তুলে প্রার্থনা করছে জলের জন্য, সেই মানুষগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। সেই বর্ষার সঙ্গে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে চাই। আজ অশুভ অসুর অমঙ্গল সমস্ত দেশকে মরুভূমি করে দিয়েছে। এই বর্ষায় সমস্ত অমঙ্গল অপশক্তি অসূচী ধুয়ে মুছে যাক। এই বর্ষায় স্নাত হয়ে এই দেশের মানুষ সপ্রাণ হোক। আবার সাহসী হোক। সবুজ হোক।
×