ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য অবিশ্বাস বাড়াবে ১৪ দলে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৬ জুন ২০১৬

সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য অবিশ্বাস বাড়াবে ১৪ দলে

ওবায়দুল কবির ॥ জাসদ নিয়ে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যে ক্ষমতাসীন চৌদ্দ দলে ভাঙ্গন না ধরলেও দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব ও অবিশ্বাস বাড়বে। সুযোগ নেবে এই জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দল এবং জঙ্গী-সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। ইতোমধ্যে এর আলামত শুরু হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে হাসানুল হক ইনুর বিচার দাবি করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিজেও এই ঘটনায় উসকানি দিয়েছেন। সুযোগ সন্ধানী রাজনৈতিক দলগুলোও এই ইস্যুতে মুখ খুলতে শুরু করেছে। যখন সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় একটি আদর্শিক রাজনৈতিক জোট সংগ্রাম করে যাচ্ছে ঠিক তখন দায়িত্বশীল পদে থেকে সৈয়দ আশরাফের এমন বক্তব্যকে কা-জ্ঞানহীন হিসেবে মনে করছেন আওয়ামী লীগ নেতকর্মীরা। তারা বলছেন, একটি আদর্শিক জোটের ঐক্যে ফাটল ধরলে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হবে সবাইকে। বিশেষ করে প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষগুলো পরবে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে। চলমান পরিস্থিতি সামাল দিতে আওয়ামী লীগ অবশ্য তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, ইনু সম্পর্কে আশরাফের বক্তব্য ব্যক্তিগত। চৌদ্দ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম সরাসরি আশরাফের বক্তব্য নিয়ে কিছু না বললেও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, চৌদ্দ দলের ঐক্য অটুট থাকবে। হাসানুল হক ইনু নিজেই চৌদ্দ দলের ঐক্য অটুট রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটি ইতিহাস চর্চার সময় নয়। সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ মোকাবেলা করে দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সময়। মুক্তিযুুদ্ধে পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের বতর্মান পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। এদিকে নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টির একদিন পরেই লন্ডনে চলে গেছেন সৈয়দ আশরাফ। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় স্বাধীনতার পর জাসদের কর্মকা- তুলে ধরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ অভিযোগ করেন, জাসদ নেতা-কর্মীরা সে সময় মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছিল। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার আগেই দেশকে ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টা করেছিল। তারা যদি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সমস্ত পরিবেশ সৃষ্টি না করত, তবে বাংলাদেশ একটি ভিন্ন বাংলাদেশ হতো। জাসদকে হঠকারী দল আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এদের একজনকে আবার মন্ত্রিত্বও দেয়া হয়েছে, যার প্রায়শ্চিত্ত আওয়ামী লীগকে আজীবন করতে হবে। প্রশ্ন উঠেছে, জোট গঠনের প্রায় আট বছর পর সৈয়দ আশরাফ কি কারণে এমন বক্তব্য দিলেন। এটি কি শুধুই ইতিহাস চর্চা নাকি এর পিছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য রয়েছে। জাসদ নিয়ে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য নিয়ে গত দুদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গন ও গণমাধ্যমে চলছে নানামুখী আলোচনা। জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার মঙ্গলবার বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে যখন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, হাসানুল হক ইনু যখন জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্য জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করবে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেন, সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য তার ব্যক্তিগ মত। এটি আওয়ামী লীগের অভিমত নয়। যা বলেছেন তিনি তার নিজ দায়িত্বেই বলেছেন। এসম্পর্কে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে কোন বক্তব্য না দিলেও বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শেখ হাসিনা স্পষ্টতই বিরক্ত প্রকাশ করেছেন। তিনি এও বলেছেন, এটি সৈয়দ আশরাফের ব্যক্তিগত মন্তব্য। তারা বলছেন- মঙ্গলবার সংসদ অধিবেশন চলাকালীন দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এখন কাদা ছোড়াছুড়ির সময় নয়। অনেক ষড়যন্ত্রেও ভেতর দিয়ে সরকার পরিচালনা করছি। অনেক কষ্টে সবাইকে এক রাখার চেষ্টা করছি। এসময়ে এগুলো বলার কী প্রয়োজন ছিল আমি বুঝতে পারছি না’। দলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন বলেও ট্রিবিউন দাবি করেছে। মঙ্গলবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সরকারী বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভা। সেখানে এ নিয়ে আলোচনা হয়। তখন উপস্থিত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজেও। সহকর্মীদের বিভিন্ন বক্তব্য শুনে সৈয়দ আশরাফ বলেন, আমি তো পার্ট অব হিস্ট্রি তুলে ধরেছি কেবল। বুধবার এক অনুষ্ঠানে ১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ১৪ দলের ঐক্য আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। তা না হলে অশুভ শক্তি অনৈক্যেও ফাটল দিয়ে ঢুকে ছুরিকাঘাত করবে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, তিনি দলের কোন ক্রান্তি কালেও কথা বলেন না। নেতাকর্মীরা তার সাক্ষাত পাননা। সাংগঠনিক কর্মকা- চালানো দুরের কথা নিজ মন্ত্রণালয়েও তিনি অনিয়মিত। হঠাৎ করে তিনি কেন জোটের একটি শরিক সম্পর্কে এমন মন্তব্য করলেন তা বিবেচনায় নিতে হবে। এর পিছনে কোন ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা তাও বিবেচনায় নিতে হবে। দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে তিনি যদি এমন মন্তব্য করে থাকেন তবে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে দলের চেন অব কমান্ড বলে কিছুই থাকবে না। এটা ইতিহাস চর্চার সময় নয়- ইনু ॥ পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ক্ষেত্র তৈরির জন্য জাসদকে দায়ী করে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও অপ্রাসঙ্গিক বলে মন্তব্য করেছেন দলটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেছেন, এটা ইতিহাস চর্চার সময় নয়। ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের ওই বক্তব্যের দুদিন পর বুধবার তথ্যমন্ত্রী ইনুর এই প্রতিক্রিয়া এল। সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে ইনু বলেন, আমরা মনে করি এই সময়ে ১৪ দলের অভ্যন্তরে কোন কাঁদা ছোড়াছুড়ি করা উচিত নয় এবং এটা ইতিহাস চর্চার সময় নয়। এটা জঙ্গীবাদ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার সময়, জনগণকে নিরাপত্তা বিধান করার সময়। সেইজন্য মনে করি, জাসদ নিয়ে বা যে কোন দল নিয়ে যে মন্তব্য, বক্তব্য ও বিবৃতি আসছে সেটা অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও অপ্রাসঙ্গিক। ইনু বলেছেন, সৈয়দ আশরাফের মন্তব্যে ১৪ দলের ঐক্যে কোন প্রভাব পড়বে না বলেই তিনি মনে করেন। জাসদ ও আওয়ামী লীগের ঐক্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বারবারই বলেছি যে, গভীর বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সুতরাং এ ধরনের মন্তব্যে এ ঐক্য ও চলার পথ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এই ঐক্য ইতোমধ্যে দেশের জন্য মঙ্গলজনক প্রমাণিত হয়েছে মন্তব্য করে ১৪ দলের শরিক নেতাকর্মীদের উদ্দেশে জাসদ সভাপতি ইনু বলেন, এই মুহূর্তে কোন উসকানিতে পা দেবেন না, উত্তেজিত হবেন না, ধৈর্য রাখুন, ঐক্য রাখুন। সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ অভিযোগ করেন, জাসদ নেতা-কর্মীরা সে সময় মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছিল। জাসদ ভ- রাজনৈতিক দল বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আশরাফের বক্তব্যের জবাবে ইনু বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, মনে রাখতে হবে, বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের প্রতিটি ঘটনা এখনও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করা আছে, ইতিহাস ইতিহাসের মতোই বিশ্লেষণ করবে। বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে যে তল্পিবাহক-তোষামোদকারী গোষ্ঠী ছিল তারা বা প্রকাশ্য বিরোধিতাকারী জাসদ- কার কতটুকু ভুল, বা কে কতটুকু ক্ষতি করেছে, বা ক্ষতি করেনি- তার মূল্যায়নটা ইতিহাসই করবে। ইনু বলছেন, জঙ্গীরা যেভাবে সাধারণ জনগণকে হত্যা করছে- সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। সাধারণ জনগণ এবং দেশের নিরাপত্তা বিধানের জন্য দরকার সর্বাত্মক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। আর সেজন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দল-মহাজোট একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কতটুকু ভুল করেছে, জাসদ কতটুকু ভুল করেছে- তা বিচার-বিশ্লেষণ করার সময় এটা নয়। তবে এটা ইতিহাস বিচার করবে। ইতিহাসের নিরিখে সবকিছু মূল্যায়িত হবে। মনে রাখতে হবে, খোদ শেখ হাসিনা বার বার বলেছেন, প্রতিক্রিয়াশীল, দেশবিরোধী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক নিহত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর হত্যার জন্য কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে দায়ী করাটা ইতিহাসসম্মত কোন বক্তব্য নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের ঐক্য হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তথ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনার পূর্বাপর সকল ঘটনার গভীর বিশ্লেষণ করে আওয়ামী লীগ, জাসদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঐক্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা জাসদও সেই ঐক্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতা ও সামরিক শাসনের জঞ্জাল থেকে উদ্ধার করে অসাম্প্রদায়িকতার পথে, গণতান্ত্রিকতার পথে, সংবিধানের পথে পরিচালিত করা সম্ভব হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। লন্ডন গেলেন আশরাফ ॥ রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়ে এগারো দিনের সফরে লন্ডন গেলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদের ভূমিকা নিয়ে এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে নানামুখী আলোচনার মধ্যে বুধবার সকালে লন্ডন রওনা হন তিনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা মোঃ মমিনুল হক জানান, বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে সকাল ১০টায় ঢাকা ছেড়েছেন মন্ত্রী। মন্ত্রীর সফরসূচীতে দেখা যায়, আগামী ১৬ জুন লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে দক্ষিণ এশিয়া ডায়াসপোরা সম্মেলনে যোগ দেবেন তিনি। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি সভায় তার যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। আগামী ২৭ জুন সকালে ঢাকা ফিরবেন জনপ্রশাসন মন্ত্রী।
×