ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৬ জনের ফাঁসি বহাল ॥ আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৬ জুন ২০১৬

৬ জনের ফাঁসি বহাল ॥ আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ১২ বছর আগে গাজীপুরে শ্রমিক নেতা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার ঘটনায় বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ছয়জনের মৃত্যুদ-ের রায় বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। এ মামলায় ২০০৫ সালে নিম্ন আদালতে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া আসামিদের মধ্যে সাতজনের সাজা কমিয়ে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদ-। আর নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া আসামিদের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে সেই দ-ই বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। যার ফলে যাবজ্জীবন আসামির সংখ্য দাঁড়িয়েছে ৮ জনে। দ্রুত বিচার আদালতে মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছিল এমন ১১ জন হাইকোর্টে আপীল করে খালাস পেয়েছেন। আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, জেল আপীল ও আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাইকোর্ট বেঞ্চ জনাকীর্ণ আদালতে পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলার রায় প্রদান করেন। রায়কে কেন্দ্র করে আদালত অঙ্গনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। আদালত তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি আদর্শকে হত্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল রোনা নাহরীন ও সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল মনজু নাজনিন। আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ কয়েক আইনজীবী। আপীল করা হবে ॥ আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে সাংসদ জাহিদ আহসান রাসেল বলেছেন, রায়ে পুরোপুরি ‘সন্তুষ্ট নন’ যাদের দ- কমানো বা খালাস দেয়া হয়েছে, তাদের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হবে। মামলায় এমন অনেক আসামি রয়েছে যারা সরাসরি হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে তারা অনেকে পার পেয়েছেন। তাই আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। বাবার আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য রাসেল বলেন, হাইকোর্টের এ রায়ে আমরা আংশিক সন্তুষ্ট, পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। ছয়জনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে, অন্যদের সাজা কমানো হয়েছে এবং কয়েকজনকে খালাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু যাবজ্জীবন ও খালাসপ্রাপ্তরা এ হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিল। তিনি বলেন, আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। এ জন্য আমরা উচ্চ আদালতে আপীল করব। আশা করি আপীলে খালাসপ্রাপ্তদের যথাযথ শাস্তি দেয়া যাবে। অন্যদিকে বিএনপির সাবেক সাংসদ হাসান উদ্দিন সরকার বলেছেন,তার ভাই নুরুল ইসলাম সরকার ‘নির্দোষ’ । হাসান উদ্দিন সরকার বলেছেন, পরে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি আপীলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন। আদালতের পর্যবেক্ষণ ॥ আদালত তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি আদর্শকে হত্যা করা হয়েছে । দেশে সুষ্ঠু রাজনীতির বিকাশ না ঘটলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তার মতো রাজনীতিবিদ পাওয়া দুষ্কর। অথচ তাকে হত্যা করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, এ হত্যাকা- একই সঙ্গে ম্যাস কিলিং (ব্যাপক হত্যাকা-)। একটি জনসভায় তাকে তিন দিক থেকে আক্রমণ করা হয়েছিল। মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় বাধা দেয়ায় তিনি (আহসান উল্লাহ মাস্টার) টার্গেটে পরিণত হন। তবে মূলত মাদক ব্যবসায়ী মাহফুজুল ইসলাম মহলকে হত্যা করার জন্য পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু এখানে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়েছে। এখানে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দী ও মাদক ব্যবসায়ী দুজনকেই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এই হত্যার মধ্য দিয়ে তার ভালবাসা থেকে স্ত্রীকে বঞ্চিত করা হয়েছে, সন্তানকে তার পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলেও আদালত মন্তব্য করে। উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় আহসান উল্লাহ মাস্টারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওমর ফারুক রতন নামে আরেকজন তার সঙ্গে খুন হন। ঘটনার পরদিন নিহতের ভাই মতিউর রহমান টঙ্গী থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। আহসান উল্লাহ মাস্টার ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে টঙ্গী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি গাজীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। রায় দেয়া হয় বাংলায় ॥ গাজীপুরের শ্রমিক নেতা ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার ঘটনায় ডেথ রেফারেন্স ও আপীল মামলার রায় বাংলায় দেয়া হয়। উচ্চ আদালতে ব্যতিক্রম হিসেবে এ মামলার রায় দেয়া হয় বাংলায়। বুধবার বেলা একটার দিকে এ রায় ঘোষণা শুরু করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ের প্রথম অংশ বাংলায় পড়ছেন বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। রায় শুনতে হাইকোর্টে এসে এজলাস কক্ষে ঢুকেছেন নিহত আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল এমপি। আর আদালত চত্বরে অবস্থান নিয়েছেন আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী। আহসান উল্লাহ মাস্টার ও জাহিদ আহসান রাসেলের এলাকা থেকে এসেছেন তারা। হাইকোর্টের রায় ॥ নিম্ন আদালতের রায়ের পর ২২ আসামির ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদ- অনুমোদন) শুনানির জন্য ২০০৫ সালে হাইওকার্টে আসে। তাদের মধ্যে ১৪ জন দ-াদেশের বিরুদ্ধে আপীল করেন। মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে আসামি শহীদুল ইসলাম শিপু ও লোকমান হোসেন হাইকোর্টে পৃথক ফৌজদারি বিবিধ আবেদন করেন, শুধু জেল আপীল করেন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি কানা হাফিজ। যাবজ্জীবন কারাদ- পাওয়া পলাতক এক আসামি আত্মসমর্পণ না করায় আপীলের সুযোগ পাননি। আদালত যাদের মৃত্যুদ- বহাল রেখেছে তারা হলোÑ নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দীপু (পলাতক), মাহবুবুর রহমান মাহবুব, শহীদুল ইসলাম শিপু (পলাতক), হাফিজ ওরফে কানা হাফিজ (পলাতক) ও সোহাগ ওরফে সরু। মৃত্যুদ- থেকে যাবজ্জীবন কারাদ- পেয়েছেনÑ মোহাম্মদ আলী, আনোয়ার হোসেন আনু, জাহাঙ্গীর ওরফে ছোট জাহাঙ্গীর (পিতা আবুল কাশেম), রতন মিয়া ওরফে বড় রতন, আবু সালাম ওরফে সালাম ও সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনু এবং মশিউর রহমান মশু। মৃত্যুদ- থেকে খালাস পেয়েছেÑ আমির হোসেন, বড় জাহাঙ্গীর পিতা নূর হোসেন, ফয়সাল, লোকমান হোসেন ওরফে বুলু, রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির, খোকন ও দুলাল মিয়া। যাবজ্জীবন বহাল রয়েছে নুরুল আমিনের। যাবজ্জীবন থেকে খালাস পেয়েছেÑ রাকিব উদ্দিন সরকার ওরফে পাপ্পু, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর (পিতা মেহের আলী) ও মনির। যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ওহিদুল ইসলাম টিপু (পলাতক) আপীল করেননি। ঐতিহাসিক এ মামলায় বিচারিক আদালতের রায় ঘোষণা হয়েছে ২০০৫ সালে। এর পর মামলাটি জেল আপীল ও নিয়মিত আপীলের জন্য হাইকোর্টে চলে আসে। আওয়ামী লীগের তুখোড় এ নেতার হত্যার ঘটনায় করা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, আপীলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি হয়। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদ- নিশ্চিতকরণ), আপীল ও ফৌজদারি বিবিধ আবেদনের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়ে তা শেষ হয় ৮ জুন । মামলাটির বিচার সম্পন্ন করা হয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। আপীলের এ রায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে ২২ জনের ফাঁসি ও ৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় দেয়া হয়েছিল। নিম্ন আদালতের রায় ॥ আহসান উল্লাহ মাস্টার যখন খুন হন তখন তিনি জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ছিলেন। পরে তার আসনের সাংসদ হন তার ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল। ওই ঘটনার পরদিন নিহতের ভাই মতিউর রহমান টঙ্গী থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। তদন্ত শেষে এই মামলায় ওই বছরের ১০ জুলাই ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। একই বছরের ২৮ অক্টোবর ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ৩৪ এবং আসামিপক্ষে দুজন সাক্ষ্য দেন। এ মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন। ওই রায়ে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ আসামিকে মৃত্যুদ- এবং ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। খালাস পান দুজন। যেভাবে হত্যা করা হয় ॥ মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় আহসান উল্লাহ মাস্টারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওমর ফারুক রতন নামে আরেকজন তার সঙ্গে খুন হন। ঘটনার পরদিন নিহতের ভাই মতিউর রহমান টঙ্গী থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। আহসান উল্লাহ মাস্টার ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে টঙ্গী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি গাজীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, তদন্ত শেষে এই মামলায় ওই বছরের ১০ জুলাই ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। একই বছরের ২৮ অক্টোবর ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
×