ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিতু হত্যাকাণ্ডের তদন্তও আটকে যাচ্ছে সন্দেহের জালে!

প্রকাশিত: ০৬:১০, ১৫ জুন ২০১৬

মিতু হত্যাকাণ্ডের তদন্তও আটকে যাচ্ছে সন্দেহের জালে!

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ যে চট্টগ্রামে পুলিশী তৎপরতা চালিয়ে সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছিলেন এসপি বাবুল আক্তার সেই চট্টগ্রামে শেষ পর্যন্ত হারাতে হলো তার সহধর্মিণী মাহমুদা খানম মিতুকে। কারা মেরেছে, কেন মেরেছে, কোন অপরাধে মেরেছে সবকিছু এখনও অন্ধকারে। একটি তদন্ত সংস্থা ও ৫টি কমিটি গঠন করার পরও মিতু হত্যার কোন কুলকিনারা মঙ্গলবার পর্যন্ত হয়নি। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে একজন উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন রহস্যের বেড়াজালেই বন্দী হয়ে আছে সেখানে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কি অবস্থা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মিতু হত্যারকা-ের পর সিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, এটা জঙ্গীরা করে থাকতে পারে। পরে বলেন, জামায়াত-বিএনপির সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। আরও পরে বলেন, চোরাচালানি মাদক পাচারকারী সিন্ডিকেট সদস্যদেরও সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। অনেক ঘটা করে এ সংক্রান্ত মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় গোয়েন্দা বিভাগের এক ইন্সপেক্টরকে। কদিন যেতে না যেতেই তাকে বদল করে একজন সহকারী কমিশনারকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গত সোমবার রাতে এ মামলার তদারকির আংশিক দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে ডিসি ডিবির কাছ থেকে। ডিবি, সিটিইউ, পিবিআই, র‌্যাব, সিআইডি কোন সংস্থাকে বাদ রাখা হয়নি। কিন্তু সবই যেন চলছে ঢিমেতালে। সিএমপির ইতিহাসে একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের ঘটনায় এ ধরনের ব্যর্থতা নজিরবিহীন। চট্টগ্রাম মেট্রো ও জেলায় বাবুল আক্তারের কর্মকা- নিয়ে সফলতায় সহকর্মীদের একটি অংশ যেমন সন্তুষ্ট, তেমনি আরেক পক্ষ বেজার হয়েও আছেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যাকা- নিয়ে চট্টগ্রামে প্রতিদিন যেহারে বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে তা সারাদেশেই বিরল একটি ঘটনা। এটা একজন কর্মদক্ষ, সৎ পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি ভালবাসার বহির্প্রকাশ ছাড়া আর কি হতে পারে। এসব বিষয় অবহিত হয়ে গত কয়েকদিন আগে বাবুল আক্তারকে চট্টগ্রামে ডিসি ডিবি হিসেবে পদায়নের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু দুঃখভরা মনে ব্যথিত বাবুল আক্তার তাতে সম্মত হননি বলে জানা গেছে। কারণ, তার স্ত্রীর হত্যাকা-ের তদন্ত চলাকালে তিনি যদি চট্টগ্রামে পদায়ন হন তাহলে তার সহকর্মী মহলে আরও নানামুখী সমালোচনার বিস্তৃতি ঘটতে পারে বলে তার শুভাকাক্সক্ষীরা মনে করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জঙ্গী দমন, একের পর এক জঙ্গী আস্তানা উদ্ঘাটন এবং মাদক ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সাফল্যের কারণে কিলিং স্কোয়াডের টার্গেটে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি পুলিশের একাংশেরও বিরাগভাজন হয়েছিলেন এসপি বাবুল আক্তার। পেশাগত সাফল্য তাকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। পুলিশে চাকরি করেও যে মানুষের হৃদয় ছোঁয়া যায় তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন কর্মদক্ষতা ও সততার মাধ্যমে। তার এ ভূমিকা পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি বাড়াতে সহায়ক হলেও খোদ পুলিশেরই একটি অংশ ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিল বলে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ পেয়েছে। পুলিশ বিভাগে বাবুল আক্তারের পেশার বয়স প্রায় দশ বছর। এরমধ্যে তিনি বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামে। সকল কর্মক্ষেত্রেই তিনি দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাকে ভাবা হতো জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের আতঙ্ক। শুধু তাই নয়, তার সততার জন্য উপকৃত হয়েছেন নিরীহ মানুষ। এ সততা আবার পুলিশ বিভাগে কর্মরত অনেকের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সিএমপিতে বদলি হওয়ার আগে তিনি কিছু সময় এএসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী সার্কেলে। বদলির আদেশ হওয়ার পর ওই এলাকার মানুষ দিনের পর দিন মানববন্ধন করেছিল সেই আদেশ প্রত্যাহার করার জন্য। ওই মানুষগুলোকে বোঝাতে কষ্ট হয়েছিল যে, এই বদলি পদোন্নতির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। হাটহাজারী থেকে বদলি হয়ে সিএমপির গোয়েন্দা শাখায় আসার পর তিনি মনোযোগী হন জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক উদ্ঘাটন ও ভেঙ্গে দেয়ার কাজে। এরপর একের পর এক উদ্ঘাটিত হতে থাকে জঙ্গী আস্তানার। ধরা পড়তে থাকে জঙ্গী ও সন্ত্রাসীরা। এতে করে তিনি টার্গেট হয়ে যান। কর্ণফুলী থানার খোয়াজ নগর এলাকায় জঙ্গী আস্তানায় অভিযানে গিয়ে আক্রান্তও হন। জঙ্গীরা তাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তার সাফল্য জঙ্গী ও সন্ত্রাসী শিবিরে আতঙ্কের সৃষ্টি করলেও নিজ বিভাগে সৃষ্টি হয় শত্রুও। মাত্র দশ বছরের চাকরিকালে বাবুল আক্তার অর্জন করে ফেলেন রাষ্ট্রপতি পদক, পুলিশের সর্বোচ্চ পদকসহ প্রায় সব স্বীকৃতি। এত অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো সাফল্য ও অর্জন অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। উপরে উপরে ভালভাব দেখালেও তাদের অন্তরাল ছিল ঈর্ষান্বিত। পেশাগত ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিলেও সে তুলনায় তিনি সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাননি বলে চাউর রয়েছে। অতি সম্প্রতি পুলিশ বিভাগের যে ১৭০ জনের এএসপি হিসেবে পদোন্নতি হয়েছে তাদের মধ্যে পুরনো কর্মস্থল থেকে একমাত্র ছাড়পত্র মিলেছিল বাবুল আক্তারের। অন্য সকল অফিসার এখনও রয়ে গেছেন স্ব-স্ব কর্মস্থলে। শুধুমাত্র বাবুল আক্তারের ক্লিয়ারেন্স কেন অতি দ্রুততার সঙ্গে হয়ে গেল সে প্রশ্নটিও উঠে আসছে। আর তার স্ত্রীর উপর হামলার ঘটনাও ঘটল তিনি ঢাকায় যাওয়ার দুদিনের মধ্যেই। এক্ষেত্রেও যেন খুবই তাড়াহুড়ো। বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর মৃত্যুর ঘটনাটিও নানা প্রশ্ন ও রহস্যাবৃত। প্রতিদিন দুজন রানার থাকলেও সেদিন ছিল না একজনও। সন্তানকে স্কুলবাসে তুলে দিতে তিনি বাসা থেকে বের হন অন্যান্য দিনের চেয়ে প্রায় ৪০ মিনিট আগে। পুরো ঘটনাটি একটি ছকে বাঁধা। ঘাতকদের কাছে একেবারে ভেতর থেকে তথ্য সরবরাহ হয়ে থাকতে পারে এমন অনুমান করছেন খোদ পুলিশের একাংশ। বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যার ১০ দিন অতিবাহিত হলেও এখনও তদন্ত কাজে সামান্যতম অগ্রগতিও নেই। পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে একেকজনকে ধরে আর ছাড়ে। দু’জনকে ইতোমধ্যে রিমান্ডে নেয়া হলেও তাদের কাছ থেকে উল্লেখ করার মতো কোন তথ্য বেরিয়ে আসেনি। শুধু তাই নয়, খোদ পুলিশেরই বিভিন্ন সূত্র বলছে, যে দুজনকে ধরা হয়েছে তারা আদৌ এ হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। শেষ পর্যন্ত পুলিশ সক্রিয় হয়েছে কারাগারে বন্দী জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তথ্য বের করার দিকে। প্রয়োজনে চট্টগ্রাম কারাগারের সকল জঙ্গীকেই একে একে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরিকল্পনা রয়েছে পুলিশের। স্ত্রী মিতু হত্যার পর বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, কেন তাকে রিলিজ করে ঢাকায় পাঠানো হলো। কেন তার পরিবার এমন নিরাপত্তাহীন অবস্থায় ছিল। পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এএসপি হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত বাবুল আক্তারকে পুনরায় চট্টগ্রামে পোস্টিং দেয়ার চিন্তা ভাবনা হচ্ছে। কিন্তু তিনি নিজেই আর চট্টগ্রামে আসতে রাজি নন। যে বাবুল আক্তার অনেক জটিল মামলার তদন্ত সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন শেষ পর্যন্ত তার স্ত্রী হত্যার তদন্তটি সঠিকভাবে হয় কিনা তা নিয়েও এখন দেখা দিয়েছে ঘোর অনিশ্চয়তা।
×