ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তিনটি মেডিক্যাল কলেজ সাময়িক বন্ধ ঘোষণা

মেডিক্যাল শিক্ষার মান নিয়ে কোন আপোস নয় ॥ নাসিম

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১৫ জুন ২০১৬

মেডিক্যাল শিক্ষার মান নিয়ে কোন আপোস নয় ॥ নাসিম

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ বিধি বহির্ভূতভাবে পরিচালিত বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সরকারী বিধিমালা অমান্য করে কোন মেডিক্যাল কলেজ পরিচালিত হলে শুধু কার্যক্রম বন্ধই নয়, এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও নেয়া হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষায়ই এই কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নিম্নমানের শিক্ষায় অর্ধ শিক্ষিত ডাক্তারের হাতে জনস্বাস্থ্য ছেড়ে দেয়া যায় না। সরকার কিছুতেই এই ঝুঁকি নিতে পারে না। মেডিক্যাল শিক্ষার মান নিয়ে কোন আপোস করা হবে না। জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই সম্প্রতি তিনটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের কার্যক্রম সমায়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনটি কলেজই ছিল নানা সমস্যায় জর্জরিত। অনুমোদনের চেয়েও অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষক সংকট, ল্যাবরেটরির উপকরণ স্বল্পতা, হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ঠিকমতো না দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে এই তিন বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধে। পরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেয়া সুপারিশের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ নীতিমালা সংক্রান্ত সভায় ওই তিন মেডিক্যাল কলেজের কার্যক্রম সাময়িক বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। কলেজগুলো হচ্ছে-রংপুরের নর্দার্ন মেডিক্যাল কলেজ, গাজীপুরের সিটি মেডিক্যাল কলেজ ও আশুলিয়ার নাইটিংগেল মেডিক্যাল কলেজ। এছাড়া নীতিমালা না মানায় চট্টগ্রামের সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজের আসন্ন ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত এবং একই জেলার বিজিসি ট্রাস্ট মেডিক্যাল কলেজের আসন সংখ্যা ১২৫ থেকে কমিয়ে ৭৫ এ বরাদ্দ করা হয়েছে। জানা গেছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে দেশের ৬৮টি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শন কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রতিবেদন জমা দিতে পরিদর্শন কমিটিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিদর্শন কমিটি ইতোমধ্যে ২৫টি বেসরকারি কলেজের পরিদর্শন সম্পন্ন করেছে। বাকিগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শেষ হবে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া কলেজগুলো পুরনায় চালু করতে ইতোমধ্যে একটি মহল চেষ্টা-তদ্বির শুরু করেছে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে, এইসব তদ্বির কিছুতেই আমলে নেয়া হবে না। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিশেষ বৈঠকে তদন্ত কমিটির দেয়া রিপোর্ট পর্যালোচনা শেষে তিনটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের কার্যক্রম সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অতিরিক্ত সচিব বিমান কুমার সাহা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নূরুল হক, বিএমডিসি’র প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মোঃ শহীদুল্লাসহ ঢাকা ও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা অনুষদের ডিনগণ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের মান নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বৈঠকে কমিটির রিপোর্ট পার্যালোচনা শেষে তিন কলেজের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। কলেজ তিনটি সম্পর্কে পরিদর্শন প্রতিবেদনে বিস্তারিত অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়। নাইটিংগেল মেডিকেল কলেজ ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের পরিচালকের দেয়া পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মেডিক্যাল কলেজে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন অনুযায়ী ৫০ শীট থাকা সত্ত্বেও ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ৮৫ শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসপাতালের ২৫০ শয্যার লাইসেন্স আছে এবং ৫০০ শয্যার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা হয়েছে। সুতরাং, নীতিমালা অনুযায়ী আসন সংখ্যা ৫০-এর বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক/শিক্ষিকার সংখ্যা অপ্রতুল। বিষয়ভিত্তিক ল্যাবরেটরি ও মিউজিয়াম শিক্ষা উপকরণও কম। হাসপাতালে অন্তঃবিভাগীয় রোগীর সংখ্যা খুবই কম এবং বহির্বিভাগীয় রোগীর সংখ্যাও আনুপাতিক হারে কম বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পরিদর্শন প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, সার্বিক মূল্যায়নে অবকাঠামো, নীতিমালার অনেক শর্ত অপূরণীয়, শিক্ষার মান ও পরিবেশ মোটেই সন্তোষজনক নয়। এই বিবেচনায় আসন্ন ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত রেখে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে বিবেচনার জন্য প্রেরণ করা হলো। সিটি মেডিক্যাল কলেজ ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের পরিচালকের দেয়া পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন নীতিমালা অনুযায়ী হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাস একই চত্ব¡রে হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এই মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাস হাসপাতাল হতে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এছাড়া মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষে দেয়া তথ্য অনুযায়ী হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৪০০। কিন্তু তা লাইসেন্স প্রাপ্ত নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষক সংখ্যা আনুপাতিক হারে অনেক কম। বিষয়ভিত্তিক ল্যাবরেটরি ও মিউজিয়ামে শিক্ষা উপকরণের স্বল্পতা আছে। এছাড়া লাইব্রেরির পরিবেশও মানসম্পন্ন নয়। হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও বেড অকুপেন্সি রেট খবই কম বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, সার্বিক মূল্যায়নে অবকাঠামো, শিক্ষার মান ও পরিবেশ সন্তোষজনক নয়, নীতিমালার অনেক শর্ত অপূরণীয়। এই বিবেচনায় আসন্ন ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত রেখে শর্ত পূরণ সাপেক্ষ বিবেচনার জন্য প্রেরণ করা হলো। নর্দান মেডিক্যাল কলেজ ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের পরিচালকের দেয়া পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৮০ আসনের অনুমোদন দেয়া হলেও নর্দান মেডিক্যাল কলেজ ৯০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করে আসছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নর্দান মেডিক্যাল কলেজের নামে স্থায়ী আমানত হিসেবে ব্যাংকে রাখা ১ কোটি টাকা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কলেজে কর্তৃপক্ষ উত্তোলন করে নিয়েছে, যা কলেজের অধ্যক্ষ ও কলেজ কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৫০০ শয্যার লাইসেন্স আছে। কিন্তু পরিদর্শনকালে বাস্তবে ১৪০ শয্যা ও ৪৫ জন ভর্তি রোগী পাওয়া যায়। নীতিমালা অনুযায়ী ছাত্র শয্যা অনুপাত ১:৫। সেই মোতাবেক হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৪০০ থাকা উচিত। বিএমডিসির নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষক সংখ্যা অপ্রতুল এবং শিক্ষক পদায়নের ক্ষেত্রে অনিয়ম আছে। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ও শিক্ষা সংক্রান্ত সুবিধাদি সন্তোষজনক নয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ শিক্ষা বর্ষ পর্যন্ত একাডেমিক অনুমোদন নবায়ন আছে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত নবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, নর্দান মেডিক্যাল কলেজ ২০১১ (সংশোধিত) নীতিমালার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারা লঙ্ঘন করেছে এবং শিক্ষা কার্যক্রম হাসপাতাল পরিচালনা ব্যবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। বিদ্যমান অবস্থার প্রেক্ষিতে নর্দান মেডিক্যাল কলেজটি আগামী ২০১৬-১৭ শিক্ষা বর্ষ হতে শিক্ষার্থী ভর্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে। এ সম্পর্কে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, মেডিক্যাল কলেজের মান বজায় না থাকলে দেশে সুচিকিৎসক পাওয়া যাবে না। শুধুমাত্র সার্টিফিকেট বিতরণের জন্য কলেজের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে দেয়া যায় না। এই অবস্থা চলতে থাকরে ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। এজন্য সকল বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের কার্যক্রমের মান সুরক্ষায় সরকার কঠোরভাবে তদারকি করবে। পরিদর্শন কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানান মন্ত্রী। আগামীতে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ অনুমোদন, নবায়ন ও আসন সংখ্যা বৃদ্ধির সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের পৃথক পৃথক পরিদর্শন প্রতিবেদন সমন্বিতভাবে আলোচনার মাধ্যমে পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
×