ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীর সিল্কপল্লী

রেশমনগরে হরদম তাঁতের খট খট আওয়াজ, পোশাকে বাহারি সাজ

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৫ জুন ২০১৬

রেশমনগরে হরদম তাঁতের খট খট আওয়াজ, পোশাকে বাহারি সাজ

মামুন-অর-রশিদ ॥ সুই-সুতার ফোঁড়নে কেউ পোশাকে আনছে বাহারি সাজ। কেউ করছে রঙের কাজ। আবার চুমকি-পুঁতি লাগানোর কাজেও ব্যস্ত অনেকে। আবার কেউ বেদম চালাচ্ছে তাঁত। নারীরা বসে বসে এসব কাজই করছে। সামনে ঈদ, তাই তাদের হাতে সময় নেই। পুরোদমে চলছে সবার হাত। শুধু কাজ আর কাজ। রাজশাহীর সিল্কপল্লীতে এমন দৃশ্য এখন খুবই স্বাভাবিক। শুধু সিল্কপল্লীই নয়, ঈদ সামনে রেখে রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে নারীরা এখন সুই-সুতার নিখুঁত ফোঁড়নে ব্যস্ত, উজ্জীবিত। ঘরে বসে অর্ডার এনে ফিনিশ্ড কাজগুলো সিল্ক কোম্পানিতে সরবরাহ করছে তারা। বৃহত্তর রাজশাহীতে এখন অন্তত ১০ হাজার নারী এ কাজে যুক্ত। এভাবে ঘরে বসে ভাগ্য বদলাচ্ছে তারা। আমের পরই রাজশাহীর সিল্কের কদর দেশজুড়ে। এজন্য রাজশাহীকে বলা হয় রেশমনগরী। এখন আমের মৌসুম। আবার একই সময় শুরু হয়েছে ঈদের আমেজ। রাজশাহীর মানুষের ঈদ আর সিল্ক একই সুতোয় গাঁথা। তাই ঈদের কেনাকাটা জমতে শুরু করেছে রাজশাহীর সিল্ক হাউসগুলো। আর রাজশাহীর সিল্কপল্লী এখন বছরের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময় কাটাচ্ছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন শোরুমের তাকে তাকে স্থান পেয়েছে ঐতিহ্যবাহী সিল্কের বাহারি পসরা। বেচাকেনাও জমে উঠতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। আর ক’দিনের মধ্যে দেদার বিক্রির আভাসে পুলকিত হতে শুরু করেছে ব্যবসায়ীদের মনপ্রাণ। রাজশাহীর বিসিক শিল্প এলাকার শোরুমগুলোয় এখন কেউ গেলেই দূর থেকে সবার আগে কানে বিঁধবে তাঁতের খট্ খট্ শব্দ। বিসিক এলাকায় এখন দিনরাত চলছে তাঁতমেশিন। ঈদের মৌসুমে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার সিল্কসমাগ্রী যেমন- শাড়ি, পাঞ্জাবি, সালোয়ার কামিজ বেশি বেশি বেচাকেনা হবে বলে ব্যবসায়ীরা আশা করছেন। ঈদের বাজার ধরতে জেলার ঐতিহ্যবাহী সিল্ক কারখানাগুলোয় চলছে রাতদিন কাজ আর কাজ। শাড়ি বুনন, রঙ, হাতের কাজ চলছে এসব কারখানায়। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় এ বছর ভাল ব্যবসা করবেন বলে ব্যবসায়ীদের আশা। সে অনুযায়ী আগাম কাজ শুরু হয়েছে কারখানাগুলোয়। কেউ তাঁতে কাপড় বুনছে, কেউ করছে হাতের কাজ। আবার কেউ বাহারি নক্শা আঁকছে কাপড়ের ক্যানভাসে। কেউ রং লাগাচ্ছে, কেউবা পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখছে নিজেদের করা হাতের কাজ। সেখান থেকে সরাসরি পাঠানো হচ্ছে শোরুমে। নগরীর বিসিক এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কারখানাগুলোর হরদম কাজ চলছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার এসব কারখানায় আগাম উৎপাদন শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিগত তিন বছরের তুলনায় এবার বেচাকেনা অনেক ভাল হবে। দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহনশীল থাকায় এখন সরব হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী সিল্কের কারখানাগুলো। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সিল্কবস্ত্র কারখানা সপুরা সিল্কমিলে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে পুরোদমে কাজ চলছে। কেউ তাঁতে কাপড় বুননে ব্যস্ত, কেউ ব্যস্ত হাতের কাজ যেমন, ব্লকের ওপর কারচুপি, তসর সিল্কের ওপর স্যাডো, সাধারণ সিল্কে চুমকি ইত্যাদি। সপুরা সিল্ক মিল্সের স্বত্বাধিকারী সদর আলী বলেন, বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবার অনেক ভাল কেনাবেচা হবে। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে রোজার শুরুর দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে কেনাবেচা শুরু হয়। তবে এবার ব্যতিক্রম ঘটেছে। তিনি বলেন, এবার রোজা শুরুর আগের সপ্তাহ থেকে কেনাকাটার একটি আবহ তৈরি হয়েছে শোরুমে। তিনি বলেন, তার অর্ডার নিয়ে এখন বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের ১০ হাজার নারী ঘরে বসে কাজ করছেন আর তাদের শোরুমে সরবরাহ দিচ্ছেন। এবারও সিল্কপ্রেমীদের চাহিদা পূরণে নতুন নতুন ডিজাইন আর বাহারি সব পোশাক নিয়ে হাজির হয়েছে নগরীর সিল্ক হাউসগুলো। ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে নিজেদের নিয়মিত ডিজাইনের সঙ্গে ঈদের জন্য তৈরি করা হয়েছে নতুন নতুন পোশাক। আবহাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে সিল্কের এসব পোশাক স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। রাজধানীর বিভিন্ন শোরুমেও শোভা পাচ্ছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সিল্কের পোশাক। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এরই মধ্যে ক্রেতারা আসছেন রাজশাহীর সিল্ক হাউসগুলোয়। রাজশাহীর সিল্ক কারখানাগুলোয় এবার কী কী নতুন ফ্যাশন আসছে তা নিয়ে ক্রেতাদের খোঁজখবর শুরু হয়ে গেছে। সপুরা সিল্ক প্রতিষ্ঠান এবার নানান ডিজাইন ও দামের পোশাক বাজারে আনছে। শাড়ি-জামা থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ-শিশু সবার জন্যই বিভিন্ন ডিজাইন ও দামের পোশাক তৈরিতে এখন নগরীর বিসিক শিল্প এলাকায় তুমুল ব্যস্ত এর শ্রমিকরা। কারখানার শোরুমে ঈদের জন্য তৈরি করা নতুন ডিজাইনের কিছু পোশাক এরই মধ্যে এলেও বেশিরভাগ নতুন পোশাকের কাজ এখনও চলছে। কারখানার শোরুম ইনচার্জ সাইদুর রহমান জানান, এবারের ঈদে তাদের বড় আকর্ষণ কাটোয়ার ডিজাইনের শাড়ি। আর আছে সিল্কে হাতের কারুকাজ। বিভিন্ন ডিজাইনের এই শাড়িগুলোর দাম রাখা হয়েছে ৩ হাজার ২শ’ থেকে ১০ হাজার ৫শ’ টাকা। মসলিনের ওপর কারচুপি করা ডিজাইনের শাড়িও এবার নতুনভাবে হাজির করেছে তারা। এসব শাড়ির দাম পড়বে ৩ হাজার ২শ’ টাকা থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। এই সিল্কশিল্প নতুন ধরনের পাঞ্জাবিও বাজারে আনছে। কারখানায় এখন পুরোদমে চলছে এসব পাঞ্জাবির কাজ। কয়েক দিনের মধ্যেই শোরুমে আসবে এগুলো। সাইদুর রহমান জানান, সিল্কের সঙ্গে মিলিয়ে প্রিন্ট, স্ট্রাইপ ও নানান ডিজাইনের পাঞ্জাবি তৈরি করা হয়েছে আবহাওয়া মাথায় রেখে। এছাড়া মসলিনের ওপর ব্লক করা থ্রিপিস নতুন ডিজাইন হিসেবে এনেছে এই সিল্ক। এদিকে নগরীর বিসিক শিল্প এলাকায় বিভিন্ন সিল্ক কারখানায় মেশিনচালিত একটি তাঁতও বসে নেই। রাজশাহীর সিল্কপল্লীতে বাহারি ডিজাইনের পোশাক আকর্ষণ করলেও এবার দাম ক্রেতাদের কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলছে। গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় সব ধরনের সিল্কের পোশাকের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিকৃত সুতা, রঙের দাম বৃদ্ধি, মজুরি বৃদ্ধির কারণে সব ধরনের কাপড়ের দাম বাড়াতে হয়েছে তাদের।
×