ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাসদ সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যে তোলপাড়

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৫ জুন ২০১৬

জাসদ সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যে তোলপাড়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জোটবদ্ধ হয়ে সাতটি বছর ক্ষমতায়। নিজ দলের প্রতীক নৌকা ধার দিয়ে জাসদ সভাপতিকে বানিয়েছেন এমপি, পরে দু’দফায় মন্ত্রী। এখন হঠাৎ করেই ক্ষমতাসীন জোটের শরিক সেই জাসদকে টার্গেট করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যেমন তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি ক্ষমতাসীন জোটের মধ্যও সৃষ্টি করেছে অস্বস্তি। এমনকি খোদ শাসক দল আওয়ামী লীগের মধ্যেও সৃষ্টি করেছে অসন্তোষের। দু’পক্ষই বলছে, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির যখন বৃহত্তর ঐক্যে বড়ই প্রয়োজন, ঠিক সেই মুহূর্তে সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্য ঐক্যকে বিনষ্ট করবে, অপশক্তিরাই লাভবান হবে। এ মুহূর্তে ইস্যুটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ানো হবে আত্মঘাতী। আওয়ামী লীগের তরফ থেকেও বলা হয়েছে, সৈয়দ আশরাফের মন্তব্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, দল বা সরকারের নয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র তৈরিতে জাসদকে দায়ী করে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যে নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে সর্বত্র চলছে একই আলোচনা। হঠাৎ করেই জাসদকে টার্গেট করা হলো কেন? এমনিতেই অত্যন্ত সজ্জন, মিতব্যয়ী এবং ভাল রাজনীতিক বলে পরিচিত সৈয়দ আশরাফ। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই ব্যক্তির মুখ থেকে নিজেদের জোটেরই এক শরীককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর নেপথ্যের রহস্য খুঁজতেই ব্যস্ত এখন সবাই। জাসদের অতীতের সব ভূমিকা জেনেই আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে জোট করেছে, একসঙ্গে দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন করেছে, আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা দিয়ে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে এমপি বানিয়েছে। নির্বাচনে বিজয় লাভের পর প্রথম সরকারের সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এতদিন ক্ষমতায় থেকে এখন হঠাৎ করে জাসদ কেন টার্গেটে পরিণত হলো সৈয়দ আশরাফের? এটা নিছকই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ব্যক্তিগত বক্তব্য, নাকি সরকারেরও বক্তব্য? এটা কী শুধুই বিতর্ক? নাকি রাজনীতির নতুন মেরুকরণের আভাস? এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন বিশ্লেষকরা। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ খুশি হলেও অধিকাংশ প্রবীণ নেতাই এই মুহূর্তে জাসদ নিয়ে বিতর্কের বিপক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, এই বিতর্ক স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি অর্থাৎ শত্রুপক্ষকে দেশবিরোধী কর্মকা-ের সুযোগ করে দিতে পারে। ওৎ পেতে থাকা শত্রুরা সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করবে। জাসদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বর্তমান যে মেলবন্ধন তা জঙ্গীবাদবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য। তাই এ মুহূর্তে এই ইস্যুটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ানো হবে আত্মঘাতী। এ ব্যাপারে মঙ্গলবার সাংবাদিকরা প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাসদ সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য তার নিজের ব্যক্তিগত অভিমত। এটি আওয়ামী লীগ বা সরকারের বক্তব্য কিংবা সিদ্ধান্ত নয়। তাই এ বিষয়ে আর কোন মন্তব্য করতে চাই না। ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তার প্রতিক্রিয়ায় জনকণ্ঠকে বলেন, ১৪ দলীয় জোটে থাকা সকল রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই-সংগ্রাম করেছি, এখনও করছি। জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ ও নানামুখী ষড়যন্ত্রের বিপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যে বড়ই প্রয়োজন, তখন জাসদকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে বিভ্রান্তিরই সৃষ্টি করবে। যেটি কারোরই কাম্য নয়। গত সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ক্ষেত্র তৈরিতে জাসদকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারক-বাহকরা সদ্য স্বাধীন দেশকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছিল। এ দল থেকে মন্ত্রী বানানোর জন্য আওয়ামী লীগকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতে পারে। তার এমন বক্তব্যে নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তোলপাড়ের সৃষ্টি করে। জাসদের পক্ষ থেকেও সৈয়দ আশরাফের এমন বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। মঙ্গলবার রাজধানীতে এক সমাবেশে স্বাধীনতা পরবর্তী জাসদের অন্যতম নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি আপনার মন্ত্রীকে থামান, ঐক্য বিনষ্টকারীকে থামান। আপনাকে পরিষ্কার করতে হবে, আপনি ঐক্য চান কি না? আপনি মুখে ঐক্যের কথা বলবেন, আর ঐক্য বিনষ্টকারীরা কাদা ছুড়াছুড়ি করবে, জাসদ এসব মেনে নিতে পারে না। তিনি বলেন, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর অশুভ তৎপরতা চলছে দেশজুড়ে। তাদের টার্গেট হত্যাকা-ের ঘটনায় অনেকেই এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এই সময়ে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা হলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে। তাই কোন অবস্থাতেই তৃতীয় পক্ষকে সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। আমাদের দেশের স্বার্থে সবাইকে একযোগে কাজ করারও আহ্বান জানান এই শিক্ষাবিদ। জাসদ (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আকতারও সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, আজ সময় এসেছে অবস্থান পরিষ্কার করার। আপনারা যদি মনে করেন ১৪ দলের কোন প্রয়োজন নেই, তাও স্পষ্ট করতে হবে। যদি প্রয়োজন থাকে তাহলে নিজেদের মধ্যে কোন বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা ঠিক হবে না। একদিকে ঐক্যের কথা বলা হবে, অন্যদিকে বিভেদ সৃষ্টি করে বক্তব্য দেয়া হবে- দুটি কাজ একসঙ্গে চলতে পারে না। গত বছরের ২৩ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমও বঙ্গবন্ধুর হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য জাসদকে দায়ী করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে শেখ সেলিম বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধীরা কখনও বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানতে পারত না, যদি এই গণবাহিনী, জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি করে, মানুষ হত্যা করে, এমপি মেরে পরিবেশ সৃষ্টি না করত। সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল রহস্য বের করতে হবে, কারা কারা জড়িত ছিল?’ তখনও শেখ সেলিমের বক্তব্যে নিয়েও বিতর্কের ঝড় উঠেছিল খোদ ১৪ দলীয় শরিক দলগুলোর মাঝেই। দলের হাইকমান্ড থেকেও ওই সময় এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য দু’পক্ষকেই বলা হয়েছিল। তখন নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক বলেছিলেন, বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত জাসদ রাজনৈতিক দল হিসেবে কী কর্মকা- করেছে, কী ভূমিকা রেখেছে, জাসদ নেতাদের কী ভূমিকা ছিল- তা পত্র-পত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। জাসদ সৃষ্টির পর থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিভিন্ন সময় নেয়া পদক্ষেপ ভুল ছিল না সঠিক ছিল, সেটি ইতিহাসই বিচার করবে। ১৯৭২-৭৫ সময়ে দলের ভূমিকা নিয়ে জাসদের অন্য অংশের কার্যকরী সভাপতি মইন উদ্দিন খান বাদল তখন বলেছিলেন, তারা এখন ওই সময়ের ভুলের ‘কাফফারা’ দিচ্ছেন।
×