মীর শাহ আলম, কুমিল্লা ॥ কুমিল্লায় অর্থ-সম্পদের লোভ এবং পরকীয়ার জেরে স্ত্রী তাছলিমার ভাড়াটে খুনীদের হাতে নিহত প্রবাসী স্বামী ময়নাল হোসেনের লাশ সাড়ে ৭ মাস পর খাল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে জেলা ডিবি পুলিশ কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে জেলার মুরাদনগর উপজেলার আন্দিকোট ইউনিয়নের জাড্ডা হাহাতি গ্রামের হাতিখালের (হাইত্যানী খাল) তলদেশে ৬ ফুট গভীর মাটি খুঁড়ে লাশটি উদ্ধার করে। এদিকে দীর্ঘদিন পর খাল থেকে ওই প্রবাসীর লাশ উত্তোলন করা হবে এমন খবরে এলাকায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। মঙ্গলবার সকাল থেকে উদ্ধারস্থল ঘিরে উৎসুক হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে। এ সময় খুনীদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে এলাকাবাসী সেøাগান দেয়। লাশ উত্তোলনের সময় ময়নালের মা-বোন ও স্বজনদের আহাজারিতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
লাশ উদ্ধারের সময় উপস্থিত ছিলেন কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মোঃ আলী আশ্রাফ ভূঁইয়া, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আলী আজগর, জেলা ডিবির ওসি একেএম মনজুর আলম, বাঙ্গরা থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির এসআই সহিদুল ইসলাম।
জানা যায়, গত বছরের ৩০ অক্টোবর ময়নাল হোসেন সৌদী আরব থেকে দেশে আসার পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অবস্থান করেন। তিনি তার স্ত্রী তাছলিমার কাছে বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থের হিসাব চান এবং স্ত্রীর পরকীয়ার বিষয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। এতে তার স্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে স্বামীকে হত্যার জন্য পরকীয়া প্রেমিকের পরিকল্পনা মতে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ৬ জন সন্ত্রাসীর সঙ্গে চুক্তি করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক গত বছরের ১ নবেম্বর রাতে ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করার পর স্ত্রীর ভাড়াটে খুনীরা কৌশলে ওই প্রবাসীকে তার শ্বশুরবাড়ির অদূরে খালপাড়ের নির্জন স্থানে নিয়ে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে লাশটি পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে খালের তলদেশে প্রায় ৬ ফুট মাটির গভীরে গুম করে রাখে। এ ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে প্রথমে তাছলিমা আক্তার তার স্বামী নিখোঁজ হয়েছে মর্মে গত ৭ নবেম্বর মুরাদনগর থানায় জিডি করেন এবং এক পর্যায়ে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পরে ময়নালের মা আমেনা বেগম বাদী হয়ে ১ ডিসেম্বর মুরাদনগর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মুরাদনগর থানার ওসি (তদন্ত) ফজলুল কাদেরের বিরুদ্ধে গড়িমসির কারণে পরবর্তীতে ৮ ডিসেম্বর আমেনা বেগম কুমিল্লার আদালতে আরও একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় তাছলিমা, আবদুল জলিল, নুরু মিয়া, জোহরা বেগম, শহীদ মিয়া, গফুর মিয়া, সাদ্দাম হোসেনসহ ৫-৬ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। পরে কুমিল্লার পুলিশ সুপারের নিকট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ৩ জানুয়ারি মামলাটি তদন্তের জন্য জেলা ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। চলতি বছরের গত ৮ মার্চ কুমিল্লা মহানগরের ফৌজদারি মোড় এলাকা থেকে মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই শাহ কামাল আকন্দ পিপিএম নিহতের স্ত্রী তাছলিমাকে গ্রেফতার করেন। পরে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তাছলিমা তার স্বামী ময়নালকে হত্যার কথা স্বীকার করে চাঞ্চল্যকর জবানবন্দী দেয়। পরদিন গ্রেফতার করা হয় তাছলিমার প্রেমিক শরিফুল ইসলামকে। গত ১০ মার্চ নিহতের স্ত্রী তাছলিমা আক্তার হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের নাম প্রকাশ করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। এরপর ডিবি পুলিশ অপর আসামি গ্রেফতার অভিযানে মাঠে নামে। মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির এসআই সহিদুল ইসলাম জানান, গত ১২ জুন কসবা থেকে প্রবাসী ময়নাল হোসেনের ঘাতক মুরাদনগর উপজেলার জাড্ডা হাহাতি গ্রামের সোনা মিয়ার ছেলে বদি আলম ওরফে বদি ডাকাত (৩৫) এবং সোনারামপুর গ্রামের চারু মিয়ার ছেলে বাবু মিয়াকে (২৫) গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা ময়নালকে খুন করে লাশ গুম করার বিষয়টি স্বীকার করে এবং স্থানটি শনাক্ত করে। পরে গত রবিবার আদালতে আবেদন করলে আদালত লাশ উদ্ধার ও ময়নাতদন্ত করতে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগকে ৩ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের নির্দেশ দেয়। মঙ্গলবার ওই প্রবাসীর লাশ উদ্ধারের সময় গ্রেফতারকৃত বদি ডাকাত ও বাবু মিয়া সেখানে উপস্থিত ছিল এবং তারা লাশ পুঁতে রাখার স্থান দেখিয়ে দেয়। শ্রমিক নিয়োগ করে ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে ঘটনাস্থল ওই খালের দু’পাশে বাঁধ দিয়ে প্রায় ৪ ফুট পরিমাণ পানি সেচ দিয়ে খালের তলদেশের প্রায় ৬ ফুট মাটি খুঁড়ে তুলে আনা হয় প্রবাসী ময়নালের লাশ। এদিকে লাশ উদ্ধারের সময় পার্শ্ববর্তী ইসলামপুর, আকবপুর, আন্দিকোট, হাহাতি, জাঙ্গাল, গাঙ্গেরকুল, গাজীপুর, হীরাকাশিসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের হাজারো উৎসুক জনতা ভিড় জমায়। বিকেলে ডিবির এসআই সহিদুল ইসলাম জানান, ময়নাল হোসেনের মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ বুধবার (আজ) তার স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করা হবে। বর্তমানে এ মামলায় কারাগারে আটক রয়েছেন ওই প্রবাসীর স্ত্রী তাছলিমা আক্তার, তার নিকটাত্মীয় জাকির, জুয়েল ও পরকীয়া প্রেমিক শরিফুল ইসলাম।