ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আষাঢ়স্য প্রথম দিন আজ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৫ জুন ২০১৬

আষাঢ়স্য প্রথম দিন আজ

মোরসালিন মিজান ॥ এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,/গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা...। বাঙালীর ভীষণ প্রিয় বর্ষা এসেছে আবারও। আজ বুধবার ১ আষাঢ়, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। আষাঢ়স্য প্রথম দিবস থেকে আনুষ্ঠানিক শুরু হলো বর্ষার। অনন্য ঋতুর আগমণে এরই মাঝে নতুন প্রাণ পেয়েছে প্রকৃতি। কবিগুরুর বর্ণনায়- তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে-/মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা...। মানুষের মনেও এখন আশ্চর্য দোলা! নজরুলের ভাষায়- রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে।/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে...। ভাটি বাংলার লোককবি উকিল মুন্সি থেকে বললে- যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখি রে/ অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে...। এমন আরও অনেক কথা কবিতা গানে আজ বর্ষাকে বরণ করে নেবে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। চলবে বর্ণাঢ্য বর্ষা বন্দনা। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে অনেক কিছুই আর আগের মতো নেই। বর্ষাও দিন ক্ষণ মানে না। অনেকদিন আগে থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। হালকা মাঝারি ও ভারি বর্ষণ মূলত আভাস দিচ্ছিল- বর্ষা আসছে। আর আনুষ্ঠানিক শুরুটা হলো আজ। ঋতু বৈচিত্র্যের বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। এ সময় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। নিয়মিত বর্ষণে বদলে যায় চারপাশের পরিবেশ। এ বদলে যাওয়া রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা বলেন, বর্ষার ভারি বর্ষণে শরীর ধুয়ে নেয় প্রকৃতি। পরিচ্ছন্ন হয়। নতুন করে জেগে ওঠে। বেলী, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। আর মিষ্টি হাসি হয়ে ফোটে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।’ ময়ূর পেখম মেলে নাচে। বর্ষার চিত্ত চাঞ্চল্য প্রকাশ করে কবিগুরু লিখেছেন- হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে...। ময়ূরের মতোই বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে কাটে বাঙালীর শৈশব। স্কুলে যাওয়ার সময় কিংবা ফেরার পথে দুরন্ত কিশোরী আনন্দে গায়ে মাখে বৃষ্টির ফোঁটা। আর যত্ন করে ব্যাগে পুড়ে রাখে রঙ্গিন ছাতাটি। তুমুল বৃষ্টিতে গাঁয়ের ছেলেরা নেমে পড়ে ফুটবল নিয়ে। বর্ষার এইত রূপ! মানুষের মনে অদ্ভুত শিহরণ জাগায় বর্ষা। প্রেমের বোধ উস্কে দেয়। কবিগুরুকে তাই লিখতে হয়- তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা...। একই অনুভূতি থেকে নজরুল লেখেন- রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঝরে শাওন ধারা।/গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা।/ ঘুমন্ত ধরা মাঝে/জল-নূপুর বাজে,/বিবাগী মন মোর হলো পথহারা...। ঠিক পরের স্তবকে প্রিয়ার সান্নিধ্য লাভের আকুলতার কথা জানিয়ে কবি লেখেন- চেনা দিনের কথা ভেজা সুবাসে,/অতীত স্মৃতি হয়ে ফিরে ফিরে আসে।/এমনি ছলছল ভরা সে-বাদরে/তোমারে পাওয়া মোর হয়েছিল সারা...। কবি নির্মলেন্দু গুণ আরও নতুন কিছু বলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছে মহাভারতের পঞ্চপা-ব! হয়ত এ কারণেই বর্ষায় বিরহ বেড়ে যায়। পুরনো বিয়োগ ব্যথা বুকে বাজে। অভিন্ন অনুভূতির কথা জানিয়ে বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছেনÑ এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা ভাদর/ মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর...। হয়ত একই কারণে মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলেছিলেন। এমন দিনে সবচেয়ে আপনজনকে কাছে না পাওয়ার বেদনা থেকে লোককবি দুর্বিন শাহ লেখেনÑ প্রাণ সখিরে, আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ার, ডুবায় গাঙ্গের দুটি পাড়/খেলব সাঁতার কারে সঙ্গে লইয়া...। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বলাটি এ রকমÑ বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের বেদন আসে/ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল...। আর নজরুলের সেই বিখ্যাত গান তো সকল বিরহীরÑ শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না/বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না...। কবি অন্যত্র লেখেনÑ অথৈ জলে মাগো, মাঠ-ঘাট থৈ থৈ/আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই...। এভাবে অসংখ্য কবিতারও জন্ম হয় বর্ষায়। বলা হয়ে থাকে, বর্ষা ঋতুতেই জীবনের প্রথম কাব্য রচনা করেন বাংলার কবিরা। পরিণত কবিও বর্ষাকে আশ্রয় করেন। আলাদা করে বলতে হয়, হাওড় এলাকার কথা। বর্ষায় হাওড়ের চেহারা আমূল বদলে যায়। গ্রীষ্মে হাওড়ের যে অংশ পায়ে হাঁটার পথ, বর্ষায় তা অথৈ জল নদী। শুকনো মৌসুমে যে জায়গায় হালচাষ করে কৃষক, ভরা বর্ষায় সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরে জেলে। বর্ষায় ভাটি অঞ্চলের বাবা-মায়েরা নৌকোয় করে তাঁদের মেয়েকে নাইওর আনার ব্যবস্থা করেন। সেই দৃশ্য দেখে ভাটির বাউল উকিল মুন্সি গেয়ে ওঠেনÑ গাঙে দিয়া যায়রে কত নায়-নাইওরির নৌকা সখি রে/মায়ে-ঝিয়ে বইনে-বইনে হইতেছে যে দেখা রে...। বর্ষায় এসব অঞ্চলে প্রচুর বিয়ের প্রচলন আছে। নৌকো করেই বর যান বিয়ে করতে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এই সাতটি জেলার লোককবিরা বর্ষা দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁদের কালজয়ী সৃষ্টি সে কথা বলে। অবশ্য বর্ষার সবই উপভোগ্য, উপকারের এমনটি বললে কিছু বেশি বলা হবে বৈকি। ভারি বর্ষণে, পাহাড়ী ঢলে গ্রামের পর গ্রাম যে ভাসিয়ে নেয় সে-ও বর্ষা! বন্যাকবলিত নিচু এলাকার মানুষ তাই আতঙ্কে পার করে বর্ষা। একই কারণে সারাবছরের অর্জন ফসল তলিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। শাহ আবদুল করিম সে অবস্থা তুলে ধরে গানÑ আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি/ গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায়/ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না/বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায়...। একইভাবে ঝড়ে খেই হারানো জেলের নৌকোটিও ফেরে না কত দিন! আর কর্দমাক্ত পথে পা পিছলে পড়ার গল্পতো প্রতিদিনের। এরপরও বর্ষার কোন তুলনা হয় না। অতুলনীয় ঋতুর কাছে কবিগুরুর প্রার্থনাÑ এমন দিনে সকলের সবুজ সুধার ধারায় প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধারায়,/বামে রাখ ভয়ঙ্করী বন্যা মরন-ঢালা...। বর্ষাবরণ উৎসব ॥ প্রতিবারের মতো এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজনে বরণ করে নেয়া হবে প্রিয় ঋতুকে। রাজধানী ঢাকায় সারাদিনই থাকবে উৎসব অনুষ্ঠান। আজ বুধবার সকালে বাংলা একাডেমির বটতলায় বর্ষা উৎসবের আয়োজন করবে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সকাল ৭টায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশনা দিয়ে শুরু হবে বর্ষা বন্দনা। গাইবেন প্রিয়াঙ্কা গোপ। পরে একসঙ্গে বেজে ওঠবে বাংলার লোক ঐতিহ্যের বাদ্যযন্ত্র। যন্ত্রসঙ্গীতের এই পরিবেশনা শেষে থাকবে অগ্নিবীণা ও ফোক বাংলা’র দলীয় সঙ্গীত। একক সঙ্গীত পরিবেশন করবেন ছায়া কর্মকার, আজিজুর রহমান তুহিন, অনিমা মুক্তি গোমেজ, শারমিন সাথী ময়না, বুলবুল ইসলাম, বিমান বিশ্বাস, মহাদেব ঘোষ, বিজন মিস্ত্রী, জিনাত ফেরদৌস প্রমুখ। প্রিয় কবিতায় বর্ষা বন্দনা করবেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ও বেলায়েত হোসেন। নাচের ছন্দে বর্ষা বরণ করবে নৃত্যম ও স্পন্দন। উৎসবে গীতি-আলেখ্য ‘বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর’ পরিবেশন করবেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা। এছাড়াও, থাকবে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর মিরপুর, বাড্ডা, তুরাগ, ধানম-ি, কাফরুল ও নবাবগঞ্জ শাখার শিল্পীদের পরিবেশনা। অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকবে বর্ষা কথন। এতে অংশ নেবেন উদীচীর সভাপতি কামাল লোহানী, শিক্ষাবিদ কাজী মদিনা, অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী, কৃষিবিদ রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা, কাজী মোহাম্মদ শীশ। বর্ষার ঘোষণা পাঠ করবেন নিবাস দে। অন্যান্য বছরের মতোই বর্ষা বরণ উৎসবের আয়োজন করবে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। তবে, সময়টি পিছিয়ে নেয়া হয়েছে। আগামী ৭ শ্রাবণ চারুকলার বকুলতলায় চলবে দিনভর উৎসব।
×