ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী মদিনা

চেতনাকে শাণিত করুক অমৃতবর্ষণ

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১৫ জুন ২০১৬

চেতনাকে শাণিত করুক অমৃতবর্ষণ

আজকাল আষাঢ়ের প্রথম দিনে সজল মেঘে রাজধানী ঢাকা যেমন সাজে না তেমনি বাংলার বৃহত্তর জনপদের বেশিরভাগ এলাকার দৃশ্যপট থাকে একই রকম। যথাসময়ে বাদল মেঘে মাদল না বাজলেও সমগ্র দেশবাসী বর্ষণের প্রতীক্ষায় উদগ্রীব হয়ে থাকে। গ্রীষ্মের অগ্নিক্ষরা দিনগুলো প্রকৃতিকে যেমন করে বিবর্ণ শুষ্ক তেমনি জনজীবনকে করে অসহনীয়। কৃষকরা চাতকের মতো বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে শস্য বপনের আশায়। বাঙালীর বাস্তব জীবনের স্বাদ ও সৌরভ, আশা আর আনন্দ, দুঃখ ও বেদনার গাথা নির্ভর করে বর্ষার বর্ষণের ওপর। ‘বৃষ্টি পড়ুক না পড়ুক’ আষাঢ়ের প্রথম দিনটি ঠিকই বাঙালীর হৃদয়ে নাড়া দেয়। কৃষককুলের সঙ্গে ঢাকার নাগরিকদেরও বর্ষা বন্দনায় কোন রকম ঘাটতি দেখা যায় না। বিগত কয়েক বছর থেকে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকভাবে আষাঢ়ের প্রথম দিনে বর্ষাকে আবাহন জানিয়ে নগরবাসীকে জানান দেয়। আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৯৯ বঙ্গাব্দে ২ আষাঢ় শিলাইদহে বসে সেই কবে লিখেছেন- ‘আমার জীবনের প্রতি বৎসরে সেই আষাঢ়ের প্রথম দিন তার সমস্ত আকাশজোড়া ঐশ্বর্য নিয়ে উদয় হয়- সেই প্রাচীন উজ্জয়িনীর প্রাচীন কবির সেই বহু বহু কালের শত শত সুখ দুঃখ বিরহ মিলনময় নর-নারীদের আষাঢ়স্য প্রথম দিবস।’ আকাশ জোড়া মেঘের পর মেঘ জমে কালো মেঘের জয়ধ্বজা উড়িয়ে যখন প্রবল বর্ষণ নামে তখন সত্যিই বাঙালী অনুভব করে ঐশ্বর্য উদয় হয়েছে। বহুশত বছর আগে কবি কালিদাস ‘ঋতুসংহারে’ বর্ষার অভিষেক বর্ণনা করেছেন রাজকীয় ভাষায়- ‘বর্ষা এলো রাজার মতো। জলকনায় পরিপূর্ণ মেঘ তার মত্ত হাতি, বিদ্যুত তার পতাকা, বজ্রধ্বনি তার মাদল।’ আমরা বসন্ত ঋতুকে ঋতুরাজ বলি। আমার মনে হয় ঋতুরাজ হওয়া উচিত বর্ষাঋতু। একমাত্র বর্ষাঋতুই হাজির হয় রাজকীয় প্রতাপে। সব ভাসিয়ে, সব ছাপিয়ে চরাচর একাকার করে প্রবল দাপটে জানান দেয় ‘এসেছে বরষা’। গগন ভরে নিয়ে এসেছে ভুবন ভরা ভরসা। বর্ষণের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে নীল আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে অঝোরে বৃষ্টি নামার পর উজ্জীবিত দেশবাসী পরম আশ্বাসে গেয়ে ওঠে- ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি।’ বর্ষার বর্ষণের পর ভূমিভেদ করে যে জল ভূমিকে সিক্ত করে তা পৃথিবীর বন্ধ্যত্ব ঘুচায়। কৃষকরা ফসল ফলায়। জনপদ বধূরা প্রীতিস্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফলনের দিকে। বর্ষা তাই শুধু বিরহের কাতরতা নয়। বর্ষার বর্ষণে আবহমান কাল রচিত হয়ে চলেছে নবজীবনের গান। আগে বর্ষার বৃষ্টি নামত টানা কয়েকদিন। তোলপাড় করা বৃষ্টি গাছের ডালপালায় ছড়িয়ে পড়ত। গ্রীষ্মের প্রকোপে যা ছিল শুষ্ক, পা-ুর তা নিমিষেই তাজা চকচকে হয়ে উঠত। কখনও ঝুরঝুর, কখনও ঝমঝম, কখনও রিনিক ঝিনিক, কখনও বারবার বারিধারা ঝরছে তো ঝরছেই। অঝর ধারার বর্ষণ যেমন প্রকৃতিকে সতেজ, সজীব করে। তেমনি জনপদবাসীর কর্মে এনে দেয় প্রাণচাঞ্চল্য। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তন এসেছে। এখন বড় বড় ফোঁটায় সামান্য ব্যবধানে প্রবল বৃষ্টি আসে ঠিকই কিন্তু অল্প সময়ের জন্য। দেশের এক প্রান্তে হয়ত অতিবর্ষণ হচ্ছে। অন্য প্রান্তে মোটেই বৃষ্টি হচ্ছে না। বর্ষার বর্ষণের সুজলা-সুফলা দেশ খরার কবলে পড়ে হচ্ছে বিপর্যস্ত বিদীর্ণ। প্রচ- তাপপ্রবাহ জনজীবনকে করছে বিপন্ন। এই পটপরিবর্তনের কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন। আমরা সবাই জানি এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী কারা? ধনী ও উন্নত দেশের ভোগবিলাস এবং অপরিণামদর্শিতার দায় বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশসহ অন্যান্য অনুন্নত দেশকে। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রতিমুহূর্তে বেড়েই চলেছে। এ কাজটি করছে উন্নত বিশ্ব। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে বৃষ্টি হচ্ছে না সময়মতো। কখনও অতিবর্ষণ অথবা অসময়ে বর্ষণ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক জীবনে বৈরী প্রভাব ফেলছে, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ রয়েছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। কৃষিকাজ মানে তো শুধু শস্য উৎপাদন নয়Ñ মৎস্য আহরণ, পশুপালন, শাকসবজি উৎপাদন, বনজ সম্পদ আহরণ প্রভৃতি। সময়মতো বৃষ্টি না হলে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ কমে যায়। অভ্যন্তরীণ নদীপথের গতি ব্যাহত হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসে স্থবিরতা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশবাসী। আমরা সবাই জানি বাংলার প্রকৃতিÑ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভাঙ্গনের ও ধ্বংসের বিশিষ্টতা নিয়েই গঠিত। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এই দুর্যোগের সঙ্গে সহাবস্থান করেই আবহমান কাল ধরে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। প্রত্যয় ও দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করে জীবনধারা প্রবহমান রেখেছে। তবে বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ধরনের দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে তার সঙ্গে তারা পরিচিত নয়। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নতুন সৃষ্ট দুর্যোগের মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজ দেশেই হচ্ছে উদ্বাস্তু। এ সমস্ত বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিতে হবে রাষ্ট্রকে। এটি স্থানীয় সমস্যা নয়, আন্তর্জাতিক সমস্যা। এমন অবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেন দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিজ পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিজস্ব এলাকায় বসবাস করতে পারে। আর এর জন্য প্রয়োজন বৈশ্বিক কাঠামো খাতে অধিকারভিত্তিক সমাধান। তাই সময় এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যারা দায়ী তাদের চিহ্নিত করা এবং সমাধানের জন্য ব্যবস্থা করা। এ কাজটি করতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। আমরা সবাই জানি বর্ষা ঋতু বাঙালীর জীবনকে করে ঐশ্বর্যবান। বর্ষার প্রবল জলের তোড়ে মাটির গভীরে প্রবেশ করে জল। সিক্ত হয় ভূমি। সজীব করে কৃষিক্ষেত। বাঁধনহারা বৃষ্টি ধারা নদীর পানি বাড়িয়ে দেয়। ঘন গৌরব নবযৌবনা বর্ষা গ্রাম বাংলার জনপদবাসীর জীবনকে করে উজ্জীবিত। মনে পড়ে পঞ্চাশ দশকের কথা। থাকতাম গোপীবাগে। মতিঝিলের খালটি কমলাপুরকে বেষ্টন করে গোপীবাগ থার্ড লেনের প্রান্ত ঘেঁষে বুড়িগঙ্গায় মিশেছে। বর্ষায় খালটি কানায় কানায় জলে পরিপূর্ণ হয়ে যেত। সেখানে নোঙর বাঁধত ছোট বড় বিচিত্র নৌকা। নানারকম মধুমাসের ফল বিশেষ করে কাঁঠাল বোঝাই নৌকা মাটির হাঁড়িকুড়ি ভর্তি ও ইট বালু ভর্তি নৌকা ভিড় জমাত। অবাক বিস্ময়ে দেখতাম বর্ষার পানি নেমে গেলে কোথায় যে চলে যেত নৌকাগুলো। কত মানুষের উপার্জনের একটা বিধি ব্যবস্থা করে দিত নবীন বর্ষা। আর এখন ঢাকায় সমস্ত খাল ভরাট করে বহুতল বাড়ির ভিড়ে বৃষ্টি হতে না হতেই পানি জমে জনজীবন করে দুর্বিষহ। কোথায় বা সেই আকাশজোড়া মেঘের শোভা। আর প্রবল বর্ষণের ধারা? নদীর পলিমাটি দিয়ে গড়া এই দেশ। বর্ষা ঋতু ছাড়া এদেশের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না। বর্ষার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে ফসল ফলে। গুরু গুরু মেঘের মাদল বাজিয়ে রিমঝিম বারিধারা নিয়ে আসে শান্তির বারি। বজ্রে বাঁশি বাজিয়ে বিদ্যুত শাণিত করে মানুষের চিন্তা, মনন ও ভাবনা। আসুন প্রার্থনা করি বর্ষা সকল কলুষ, গ্লানি, ক্লেদ দূর করে আমাদের জীবনে নিয়ে আসুক আনন্দময় উজ্জ্বল পরমায়ু। বাংলার প্রতিটি মানুষের চেতনাকে উজ্জীবিত করুক বর্ষার অমৃতবর্ষণ। লেখক : সাংস্কৃতিক কর্মী
×