ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১৪ জুন ২০১৬

‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শুদ্ধ সাহিত্য সংস্কৃতি ও কৃষ্টি বিকাশে, প্রজন্মকে হাতে হাত ধরে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে ২০০০ সালে সিলেট শহরে জন্ম নেয় শ্রুতি-সিলেট। দেশপ্রেম, মেধা, মনন, কর্মদক্ষতা, সৃজনশীলতা, প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা আর বহুমুখী জ্ঞানের সমাবেশ ঘটানোর লক্ষ্যেই শ্রুতির জন্ম। আঁতুড়ঘর থেকে এখন পর্যন্ত সংগঠনটি শিশু-কিশোরদের আবৃত্তি, সঙ্গীত, চিত্রকলায় প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের পাশাপাশি তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে নিয়মিত আয়োজন করে চলেছে শিল্পকলার বিভিন্ন শাখার প্রতিযোগিতা। আবহমান বাঙালী সংস্কৃতির বিভিন্ন আচার-কৃষ্টি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে নিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে অনুষ্ঠানমালার। বর্তমান সদস্য সংখ্যা শতাধিক। প্রশিক্ষিত সদস্য প্রায় তিন শতাধিক। ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ সবার কণ্ঠে সমস্বরে উচ্চারিত হচ্ছে। তার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের হাতে শত-শত আলোর বার্তা। আলোর মিছিল। এ আলোকবার্তা অর্থনৈতিক মুক্তির বার্তা, শুদ্ধ সংস্কৃতি রক্ষার বার্তা। সূর্যের আলো অস্তগামী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোর মিছিল এগিয়ে চলে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে। প্রায় চার শতাধিক বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম এগিয়ে চলে একই প্রত্যয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। বিগত ২০০৫ থেকে আলোর মিছিল অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শ্রুতির বর্ণমালার মিছিল নজর কাড়ে নগরবাসীর। প্রভাতফেরির আদলে মিছিলটি সাতসকালে খালি পায়ে একুশের গান গেয়ে বর্ণমালা হাতে বড়দের সঙ্গে এগিয়ে চলে ছোট্টমণিরা। যতদূর দেখা যায়Ñ শুধু বর্ণ আর বর্ণ! এ যেন বর্ণমালার উৎসব। মিছিলটি শেষ হয় ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে। তারপর শুরু“হয় নতুনদের হাতেখড়ি উৎসবের। নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা হয় শুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চা করার জন্য। আবৃত্তি প্রতিযোগিতা এবং বিশেষ দেয়ালিকা প্রকাশ করা হয়। উৎসবপ্রিয় বাঙালীর জীবনে শীত এলেই শুরু হয় ঘরে ঘরে পিঠাপুলির উৎসব। আমাদের সংস্কৃতির এই বর্ণাঢ্য আয়োজনকে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য ২০০৬ সাল থেকে শ্রুতি ধারাবাহিকভাবে আয়োজন করে আসছে দিনব্যাপী পিঠা উৎসব। এ উৎসব যেন প্রকৃতি বন্দনার এক মহোৎসব। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সপ্তসুরের আহ্বানে আর মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসবের। এতে অংশগ্রহণ করেন সিলেটের পঁচিশ থেকে ত্রিশটি প্রগতিশীল সংগঠন। প্রায় দুই শতাধিক শিশুকিশোরের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় বিষয় ও বিভাগভিত্তিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। সঙ্গে থাকে দিনব্যাপী পিঠা প্রতিযোগিতা। বর্ষবরণ উৎসব আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী উৎসব। পুরনো দিনের জীর্ণতা মুছে ফেলে পুরো জাতি একাকার হয়ে যায় বর্ষবরণের উৎসবে। নবআনন্দের আবাহনে শ্রুতি পরিবার মেতে ওঠে, যোগ দেয় উৎসবে। নববর্ষের ভোরে মঙ্গলঢাক আর শতকণ্ঠে বরণ করে বাংলা নববর্ষকে। শ্রুতির সদস্য ছাড়াও সিলেটের অগাণিত শিশুকিশোর যোগ দেয় নববর্ষের শোভাযাত্রায়। দিনব্যাপী আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলক পরিবেশনা, পঞ্চকবির গান, লোকসঙ্গীত পরিবেশনা ও বাউল মেলা। বাংলার ঐতিহ্য বৈশাখী মেলা, হাতের লেখা প্রতিযোগিতা চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার। দিনব্যাপী এ উৎসব নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের আবহমান বাঙালী সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করতে উদ্বুদ্ধ করে। শ্রুতি-সিলেট সমাজের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বদের শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘শ্রুতি গুণীজন সম্মাননা’ নামে একটি পুরস্কার প্রবর্তন করেছে। প্রতিবছর একজন ব্যক্তিত্বকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ পর্যন্ত যারা গুণীজন সম্মাননা পেয়েছেন তাঁরা হচ্ছেনÑ গণসঙ্গীতে প্রয়াত ভবতোষ চৌধুরী ১৪১২ বঙ্গাব্দ, কবিতায় কবি তুষার কর ১৪১৩ বঙ্গাব্দ, নজরুল সঙ্গীতে ওস্তাদ করিম শাহাবুদ্দিন ১৪১৪ বঙ্গাব্দ, লোকসঙ্গীতে প্রয়াত চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ ১৪১৫ বঙ্গাব্দ, চারুকলায় চিত্রশিল্পী অরবিন্দ দাশগুপ্ত ১৪১৬ বঙ্গাব্দ, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় ড. সুরেশ রঞ্জন বসাক ১৪১৭ বঙ্গাব্দ, রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রমোদ দত্ত ১৪১৮ বঙ্গাব্দ, আবৃত্তিতে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ১৪১৯ বঙ্গাব্দ, রবীন্দ্রসঙ্গীতে ড. মকবুল হোসেন ১৪২০ বঙ্গাব্দ। ১৪২১ বঙ্গাব্দের গুণীজন সম্মাননা পেয়েছেন সিলেটের বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আরশ আলী, সর্বশেষ এ বছর সাহিত্যে কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতার। শ্রুতি-সিলেটের শুরু থেকেই বাঙালীর প্রাণজন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী পালন করে আসছে। প্রতিবারই দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজনে বাঙালীর চিন্তা-চেতনার জন্মতিথি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে। এতে অংশ নিয়েছেন দেশের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ এবং শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ। আউলবাউলের স্মৃতিবিজড়িত বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের লোকসংস্কৃতির প্রাণপুরুষদের নিয়ে শ্রুতি আয়োজন করে লোক উৎসবের। সংস্কৃতিচর্চার পাশাপাশি কীর্তিমান পুরুষদের নিয়ে এসব আয়োজন মূলত নতুন প্রজন্মকে তাঁদের সৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। শ্রুতি-সিলেটের মূল কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শিশুকিশোরদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে আয়োজন করা হয় মাসিক পাঠচক্রের। নিয়মিত আয়োজন করা হয় আবৃত্তি, সঙ্গীত চিত্রকলাবিষয়ক প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার। এতে অংশগ্রহণকারী প্রশিক্ষণার্থীরা অংশ নেয় বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। এছাড়া আর্তমানবতার সেবায় শীতকালে শিশুকিশোরদের সংগৃহীত শীতবস্ত্র প্রদান করা হয় শীতার্ত শিশুকিশোরদের মধ্যে। এছাড়া আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিশুদের মধ্যে প্রদান করা হয় মেধাবৃত্তি। শ্রুতির প্রকাশনায় রয়েছে শিশু কশোরদের মননশীল লেখা নিয়ে ত্রৈমাসিক। প্রকাশিত হয়েছে গুণী লেখকদের লেখনী সমৃদ্ধ ষান্মাষিক প্রকাশনা। বাংলা একাডেমির অমর একুশের গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে সৃজনশীল তিন তিনটি গ্রন্থ। প্রতিটি প্রকাশনাতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে নতুন প্রজন্মকে। ২০১৫ সালে ২ মে সৃষ্টিশীল কাজ এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনের জন্য শ্রুতি, সিলেটকে প্রদান করা হয় জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এ পুরস্কার তুলে দেন। এছাড়া বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আয়োজিত শিশু আনন্দ মেলা ও শিশু নাট্য প্রতিযোগিতায় টানা চতুর্থবার প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগঠন। অর্জন করেছে দেশের অন্যতম মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক বাংলাদেশ উৎসব-সম্মাননা ২০১৪। শুদ্ধ সাহিত্যÑ সংস্কৃতির বিকাশে তরুণ ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই শ্রুতি কাজ করে যাচ্ছে। তাদের পড়াশোনার অবসরে শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা তথা সঙ্গীত, আবৃত্তি চারুকলাসহ সৃজনশীল কর্মকা-ে উদ্বুদ্ধ করা। তাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে সাহায্য করা। সমাজের অবহেলিত শিশুকিশোরদের সুশিক্ষায় ও সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে তাদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। নিয়মিত পাঠচক্র ও লেখালেখির কর্মশালার মাধ্যমে প্রজন্মকে শুদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতিবান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শুদ্ধ সংস্কৃতির বার্তা ছড়াবে যুগ যুগ ধরেÑ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
×