ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টুটুল মাহফুজ

আমি আমারই সমাজের প্রতিচ্ছবি ॥ টুপেক

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১৪ জুন ২০১৬

আমি আমারই সমাজের প্রতিচ্ছবি ॥ টুপেক

৭ সেপ্টেমবর, ১৯৯৬। আমেরিকার লাস ভেগাসে এমজিএম গ্রাউন্ডে মাইক টাইসন ও ব্রুস সেলডনের একটি বক্সিং ম্যাচ ছিল। টুপেক সাকুর ও তার বন্ধু ‘ডেথ র’ রেকোর্ডের সিইও সুজ নাইট সেই ম্যাচ দেখে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে তাদের গাড়ি আটকে দেয় ‘ক্রিপস গ্যাং’ নামের আফ্রিকান আমেরিকান একটি দুর্ধর্ষ কিলার দলের সদস্য ওরল্যান্ডো বেবি লেন এ্যান্ডারসন নামের এক যুবক। যে ছিল সুজ নাইটের পূর্ব পরিচিত। এই এ্যান্ডারসন নাইটের ডেথের স্টুডিও থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ ডাকাতি করে নিয়ে যায়। সেই ডাকাতির মুহূর্তের ভিডিও কোনভাবে পেয়ে যায় নাইট। এরপর তা নিয়ে এ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ রকম কিছু পূর্ব সমস্যা নিয়ে সেই দিন রাতে ক্যালিফোর্নিয়ার চ্যামটন শহরের একটি জনমানবহীন রাস্তায় তাদের মধ্যে বাকবিত-া চলতে থাকে। রাত ১১.১৫ মিনিটের সময় একটি গাড়ি এসে তাদের পাশে থামে। সেই গাড়ি থেকে দুই বন্দুকধারী নেমেই এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে সাকুরকে লক্ষ্য করে। সেদিন চারটি গুলি তার গায়ে লেগেছিল। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আইসিইউতে রাখা হয়। ১৩ তারিখ তার অবস্থার অবনতি হয়। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তার মস্তিষ্কে আবার রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সেদিন সুজ নাইটের গায়েও গুলি লেগেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁচে যান। কিন্তু সেদিন চলে যান পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় র‌্যাপার টুপেক সাকুর। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর। ১৯৭১ সালের ১৬ জুন নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে জন্ম হয় সাকুরের। তার নাম রাখা হয়েছিল লিসান প্যারিস ক্রুক। তিনি ছিলেন আফ্রো-আমেরিকান। এর এক বছর পর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় টুপেক আমারু। তবে তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় বিশেষ করে মঞ্চে টুপেক এবং মেকাভেলি নামে পরিচিত ছিলেন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এক হিসাবে দেখা গেছে, পৃথিবীব্যাপী তার ৭৫ মিলিয়ন এ্যালবাম বিক্রি হয়েছে। সাকুর তার সঙ্গীত জীবনে মোট ৫টি স্টুডিও এ্যালবাম প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘অল আইস অন মি’। যেটা ছিল সেসময় আমেরিকার ব্রেস্ট সেলিং এ্যালবাম। বিখ্যাত ম্যাগাজিন রোলিং স্টোনের ১০০ জন শিল্পীর জরিপে সাকুরের অবস্থান ৮৬ নম্বরে। তবে সর্ববিচারে টুপেক সাকুর পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত র‌্যাপার এবং অন্যতম প্রভাববিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব। তার প্রভাবে আমেরিকায় সেসময় অনেকেই র‌্যাপ গান গাওয়া শুরু করে। এ ধরনের গানের ওপর আকৃষ্ট হয়। সাকুর র‌্যাপ গানের পাশাপাশি ছিলেন একজন মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব ও কবি। তিনি অভিনয়ও করেছেন। তার সঙ্গীতজীবন শুরু হয় ১৯৮৭ সাল থেকে। তিনি তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন কনসার্টের সহযোগী ও ব্যাক আপ ডান্সার হিসেবে। ঠিক এ সময় থেকেই তিনি হিপহপ র‌্যাপ মিউজিকের সঙ্গে জড়িয়ে যান। সাকুর তার নিজের গান নিজেই লিখতেন এবং গাইতেন। তার গানের থিম ছিল সন্ত্রাস, বর্ণবাদ, সামাজিক সমস্যা। ‘আউটলজ’, ‘থাগ লাইফ’, ‘ড্যানি বয়’, ‘ডিজিটাল আন্ডার গ্রাউন্ড’ নামে তার কিছু গ্রুপ ছিল যারা ছিল তার ভক্ত অনুসারী।’ টুপেক সাকুরের মা ছিলেন এ্যাফিনি সাকুর, বাবা বিলি গ্যারল্যান্ড যিনি ছিলেন সেসময় একটি নিষিদ্ধ দল ‘ব্লাক প্যানথার পার্টি’র সক্রিয় সদস্য। এ কারণে তিনি ছোটবেলা থেকেই ‘ব্লাক লিবারেশন আর্মি’ নামের দলের সঙ্গে বড় হন। যারা ছিলেন সেসময় পুঁজিবাদ, বর্ণবাদবিরোধী। সাকুরের জীবনে এর প্রভাব ছিল গভীরভাবে। যা তার গানের মধ্যে চলে এসেছে। টুপেকের সবগুলো এ্যালবাম আমেরিকা সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক সমালোচিত হয়। অর্থাৎ তা সবসময় পুঁজিবাদ বর্ণবাদের বিপক্ষে গিয়েছে। তবে অন্য যারা অধিকার বঞ্চিত ও নির্যাতিত তাদের মন কেড়ে নিত সে গান। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, সারা পৃথিবীর মানুষ মূলত দুইভাগে বিভক্ত। দুটি দল। এক দল শাসন করে আর একদল সেই শাসনের ভেতর দিয়ে বড় হয়। এরা আসলে শোষিতদের অর্ন্তভূক্ত। অনেকই থাকে এই দলে যারা তা মেনে নিতে পারে না। তখন হয় বিপ্লব। সাকুর ছিলেন মূলত একজন বিপ্লবী। তার বিপ্লবের অস্ত্র ছিল র‌্যাপ গান। রিভোলিউশোনারি গান। সাকুরের মৃত্যুর পর তাই তাকে বিপ্লবী বব মার্লে, চেগুয়েভারার সঙ্গে তুলনা দেয়া হয়েছে। ব্রাজিলে, দক্ষিণ আফ্রিকায় তার স্মরণে আলাদা আলাদা দল হয়েছে। এর কারণ সেই দিক থেকে দেশে দেশে এই দুই শ্রেণীর মানুষের নিজেদের মধ্যে এক ধরনের আন্তঃযোগাযোগ আছে। না দেখে তাই শুধু গান শুনেই আমরা এভাবে অনুপ্রাণিত হই।
×