ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরবনে স্মার্ট প্যাট্রোলিং

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৪ জুন ২০১৬

সুন্দরবনে স্মার্ট প্যাট্রোলিং

বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট প্যাট্রোলিং একটি উত্তম পন্থা। বনে চুরি-ডাকাতি-দস্যুতা দমনেও এটি সবিশেষ সহায়ক হতে পারে। স্মার্ট প্যাট্রোলিং বলতে বোঝায় স্পেশাল মনিটরিং, এনালাইজিং এ্যান্ড রিপোর্টিং টুলস। এহেন স্মার্ট প্যাট্রোলিং পদ্ধতি বিশ্বের ৩১টি দেশের ১৪০টির বেশি বন সুরক্ষায় প্রচলিত রয়েছে। ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ডের বনাঞ্চল, বন্যপ্রাণীসহ বিভিন্ন জাতীয় উদ্যানের সুরক্ষায় এটি সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অতঃপর সর্বাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বন পাহারায় প্রবেশ করল বাংলাদেশও। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে স্ট্রেংথেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রটেকশন প্রকল্পের আওতায় শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে বন পাহারার এই কার্যক্রম। এর আওতায় বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনকে ৪টি রেঞ্জে ভাগ করে পরিচালিত হচ্ছে কার্যক্রম। স্মার্ট প্যাট্রোলিং দলে একজন উর্ধতন বন কর্মকর্তার নেতৃত্বে ৭ কর্মকর্তা ও ৯ বনরক্ষী থাকছে। তৃতীয় একটি দল থাকছে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে। প্রতিটি দলের জন্য রয়েছে দুটি করে লঞ্চ, স্পিডবোট, ট্রলার, সর্বোপরি বিশেষ প্রয়োজনে কেবিন ক্রুজার। বনের যাবতীয় কার্যক্রম পরিদর্শনকালে দলটি গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএসের সাহায্য নিতে পারবে। এতে বনের বিভিন্ন সুগম ও দুর্গম স্থানে বন ও বন্যপ্রাণীসহ ভুবনখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, জীবিত ও মৃত বন্যাপ্রাণী, জলজপ্রাণী ইত্যাদি সম্পর্কেও তথ্যাদি সংগ্রহ করতে পারবে। এসব তথ্য-উপাত্ত কেন্দ্রীয়ভাবে জিআইএস ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সংরক্ষণ করা হবে। পরে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে গ্রহণ করা হবে বন ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ও যথাযথ কার্যক্রম। এতে সুন্দরবনের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত হবে বলে ধারণা করা যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে অবশ্য মাত্র ছয় মাসের জন্য গোটা সুন্দরবনে শুরু হয়েছে স্মার্ট প্যাট্রোলিং। সত্য বটে, সুন্দরবনের অস্তিত্ব বর্তমানে রীতিমতো হুমকির মুখে। বনদস্যুদের ক্রমাগত অত্যাচারে বৃক্ষ নিধন শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। বনসংলগ্ন স্থানীয় অধিবাসীর জীবনজীবিকা প্রধানত বনকে ঘিরেই পরিচালিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। মৌয়ালরা যেমন মধু আহরণের জন্য সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল তেমনি জেলেরা নির্ভরশীল সুন্দরবনের মাছের ওপর। জ্বালানি কাঠের জন্যও সবাই এই বনের ওপর নির্ভরশীল। ইদানীং নতুন করে শুরু হয়েছে আগুন লাগিয়ে বন উজাড় করে মৎস্য চাষের উৎপাত। সম্প্রতি বনে আগুন লাগানোর অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেফতারসহ মামলার খবরও আছে। পাশাপাশি সুন্দরবন দুর্গম বিধায় একশ্রেণীর সমাজবিরোধী ও ডাকাতের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সাধারণ ক্ষমার আওতায় ইতোমধ্যে কয়েক ডাকাত আত্মসমর্পণও করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। এত ডামাডোলে সুন্দরবনের জগদ্বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন হতে চলেছে। সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে মাত্র ১০৪টি বাঘ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিপন্ন প্রজাতি বাঘের চোরা শিকারসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও চামড়া বেচাকেনা, চিত্রল হরিণের মাংস ও চামড়া বিক্রি একরকম ওপেন সিক্রেট। ফলে সুন্দরবন প্রায় নিঃস্ব ও উজাড় হওয়ার পথে। এর জন্য অবশ্য বন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও কম দায়ী নয়। সে অবস্থায় সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেও সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না, যদি না বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বাংশে সৎ ও আন্তরিক না হন। বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধিজনিত কারণে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশও রয়েছে এই পরিবর্তনের সমূহ ঝুঁকিতে। সে অবস্থায় সুন্দরবনের সুরক্ষা আরও বেশি কাক্সিক্ষত ও অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। কেননা, সুন্দরবন এমনিতেই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দেয়াল হয়ে সিডর, আইলার মতো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করছে দেশকে। অন্যদিকে এটি ক্লোরোফ্লুরোকার্বন বা সিএফসি গ্যাস পরিশোধনেরও অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং, সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশ নয় বরং বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলারও অন্যতম হাতিয়ার। এতসব বিবেচনায় স্মার্ট প্যাট্রোলিং সিস্টেম কার্যকর ও ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হলে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় এই প্রকল্পের মেয়াদ আরও বাড়ানো যেতে পারে। পরে না হয় দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই বিবেচনায় একে আত্তীকরণ করা যাবে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে।
×