ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকিং খাতে অভিজ্ঞ এমডিদের পুনর্নিয়োগ জরুরী

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৪ জুন ২০১৬

ব্যাংকিং খাতে অভিজ্ঞ এমডিদের পুনর্নিয়োগ জরুরী

রহিম শেখ ॥ ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন বিধানে বয়সের সীমারেখা বেঁধে দেয়ায় ব্যাংকিং জগতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ অনেক এমডির চাকরির মেয়াদ শেষ হবে এ বছরের মধ্যে এবং আগামী বছরের শুরুতেই। এতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সঙ্কটে পড়বে ব্যাংকিং খাত। এ সঙ্কট মোকাবেলায় অভিজ্ঞ ও সিনিয়র এমডিদের পুনর্নিয়োগ জরুরী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে অভিজ্ঞ ও সিনিয়র ব্যাংকারদের বিকল্প নেই। অভিজ্ঞ ব্যাংকাররা না থাকলে ব্যাংকিং খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। চরম সঙ্কট দেখা দিবে আর্থিক খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জারিকৃত বিআরপিডি সার্কুলার নং ১৮তে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির বয়স ৬৫ (পঁয়ষট্টি) বছর অতিক্রান্ত হলে তিনি কোন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না। সার্কুলারের ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাহীর নিয়োগের মেয়াদ হবে তিন বছর, তবে তিনি পুনর্নিয়োগযোগ্য হবেন। প্রার্থীর বয়স যদি ৬৫ বছর অতিক্রান্ত হতে তিন বছরের কম সময় থাকে তবে সেক্ষেত্রে উক্ত সময়ের জন্যও তাকে নিয়োগ করা যাবে। এদিকে ব্যাংক কোম্পানি আইনে (২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত) পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, বিশেষায়িত ব্যাংক ব্যতীত অন্য যে কোন কোম্পানিকে উহার পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিযুক্তি বা পদায়নের পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। এইরূপ নিযুক্ত কর্মকর্তাগণকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে তার পদ হতে অব্যাহতি দেয়া, বরখাস্ত করা বা অপসারণ করা যাবে না। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা এমডি নিয়োগ দিবে, তবে তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন লাগবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এখন আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। এমডি পদে অভিজ্ঞতা অর্জনকারীদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি থাকে। নতুন প্রজন্মও দক্ষ হচ্ছে। কিন্তু দক্ষতার সঙ্গে যদি অভিজ্ঞতার সংযোগ হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হয়। ব্যাংকের আর্থিক দিক স্থিতিশীল হয়। সেজন্য অভিজ্ঞদের কাছ থেকে আরও কিছুদিন সেবা নিতে পারলে দেশের ব্যাংকিং খাত সমৃদ্ধ হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এমডিদের চাকরি ৬৫ বছরের মধ্যে থাকলে তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চুক্তিভিত্তিক হিসেবে রাখা যেতে পারে। কারণ সিনিয়র ও অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের দেশে যথেষ্ট অভাব রয়েছে। জানা গেছে, সোনালী, অগ্রণী এবং রূপালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রদীপ কুমার দত্ত, সৈয়দ আব্দুল হামিদ এবং এম. ফরিদউদ্দিন। দীর্ঘদিনের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। এই সময়ে তারা দক্ষতার সঙ্গে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। দু’একটি ঘটনা ছাড়া ব্যাংকিং খাত অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। শ্রেণীকৃত ঋণ আদায় বাড়ছে। বিনোয়গ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুনাফা হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশ ঘটছে। লোকসানী শাখার সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। তরুণ ও মেধাবীদের ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব বাড়ছে। সরকার লভ্যাংশ পাচ্ছে। দেশের কর্মসংস্থান বাড়ছে। বেকারত্ব লাঘব হচ্ছে। অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের নিখুঁত ব্যবস্থাপনা ও দক্ষ নেতৃত্বের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে যারা ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন, তারা সকলেই চুক্তিভিত্তিক। তবে এমডি হওয়ার বয়সের যে সময়সীমা দেয়া হয়েছে (৬৫ বছর) তার মধ্যেই তারা কর্মরত। তাদের প্রত্যেকের প্রায় ৫০ বছরের ব্যাংকিং পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এছাড়া এমডি হিসেবে তারাই সফলতার সঙ্গে ব্যাংক পরিচালনা করছেন। দেশের বৃহত্তর মানুষদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসার জন্য এসব অভিজ্ঞ ব্যাংকাররাই ছিল অগ্রসৈনিক। দেশে ও দেশের আর্থিক খাতের স্বার্থে এসব অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের বিকল্প নেই । সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বয়সের বাধ্যবাধকতা নয়, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রের ভিত্তিতেই দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে এমডি নিয়োগ দেয়া উচিত। কারণ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সরকার তথা দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। এসব ব্যাংকে অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ লোক এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলে ব্যাংকিং খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। পাশাপাশি সরকারের সামগ্রিক কর্মকা-ে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই সোনালী, অগ্রণী, জনতা এবং রূপালী ব্যাংকে এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ এমডির বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ব্যাংকিং খাতে এমনিতেই এমডি বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পর্যায়ে অভিজ্ঞতার সঙ্কট রয়েছে। অভিজ্ঞ ব্যাংকারের সঙ্কটের কারণে এমডি পদে ৬৫ বছরের যে সময়সীমা বর্তমানে আছে তা বাড়ানোরও দাবি উঠেছে। সার্কভুক্ত দেশ পাকিস্তানে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত এমডি পদে নিয়োগের বিধান রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোসহ অনেক দেশে বয়সের কোন সীমারেখাই নির্ধারণ করা নেই। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ যে কোন দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিকেই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বা এমডি পদে নিয়োগ করা যায়। বাংলাদেশেও বয়স বাড়ানোর সময় এসেছে বলে মনে করছেন ব্যাংকিং খাতের বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকের এমডি নিয়োগে ব্যক্তিদেও নৈতিকতা ও পেশাগত দক্ষতাকেই বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ এমডিদের প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা থাকলে এমডিদের দায়িত্ব পালনে বয়স কোন সমস্যা হতে পারে বলে আমি মনে করি না। যেহেতু এমডিদের বেলায় দায়িত্ব পালনে ৬৫ বছর বয়স নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিধান আছে, সে জন্য সরকারের অন্যান্য সার্ভিস বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ বলেন, ব্যাংক পরিচালনা করতে অভিজ্ঞ ব্যাংকার জরুরী। অভিজ্ঞ ব্যাংকার ছাড়া ব্যাংক পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬৫ বছর ধরে রাখলে হবে না। সরকারী ব্যাংকগুলোতে প্রয়োজনে চুক্তিভিত্তিক এমডি নিয়োগ দেয়া উচিত।
×