ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী তৎপরতার পেছনে জামায়াত, উগ্রপন্থীরা

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৪ জুন ২০১৬

জঙ্গী তৎপরতার  পেছনে  জামায়াত, উগ্রপন্থীরা

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ দেশে এতগুলো জঙ্গী সংগঠনের নাম পাঁচ বছর আগেও শোনা যায়নি। জামায়াত-শিবির যতই কোণঠাসা হচ্ছে ততই যেন বাড়ছে জঙ্গী সংগঠনের তৎপরতা। একের পর এক ঘটছে খুনের ঘটনা, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় দায় স্বীকার করছে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন। কিন্তু এরা কারা? এতদিন কোথায় ছিল এই সংগঠনগুলো? এরা কি নতুন কিছু, নাকি নতুন বোতলে পুরনো মদ- এমন প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। জামায়াত-শিবিরের গুটিয়ে যাওয়া এবং উগ্রবাদী নতুন নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশের মধ্যে যোগসূত্র থাকার বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সূত্রে জানান দেয়া হচ্ছে- যা কিনা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের তথ্যগুলো বলছে, নাম ভিন্ন হলেও ঘুরে ফিরে তারা মূলত একই। একই মতাদর্শের উগ্রবাদীরা ভাগাভাগি হয়ে আছে বিভিন্ন সংগঠনে। দেশে জঙ্গীবাদীদের উত্থান ঘটেছে। সর্বত্র এরা নানা নামে তৎপর। বিএনপির সঙ্গে গাটছড়া বেঁধে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত এদেশে সরকারে যাওয়ার যে দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করে বিপরীতে তা বাঙালী জাতির জন্য হয়েছে বড় ধরনের চপেটাঘাত। যে কলঙ্ক তিলক মুছবে না কখনও। বর্তমানে পর পর দুই দফায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যখন স্বাধীনতার মূল চেতনা তৎপর, যুদ্ধাপরাধীর বিচার যখন চলছে, রায় যখন কার্যকর হচ্ছেÑ তখন বিএনপি এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও দোসর এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিগুলো একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছে। কিন্তু সরকার কঠোরভাবে তৎপর থাকায় এরা সুবিধা করতে পারছে না। জ্বালাও-পোড়াও পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করে কোন সুফল না আসায় এখন তারা গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। চালাচ্ছে টার্গেট কিলিং। সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পুরোহিত, সেবায়েত, ভিক্ষুসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের টার্গেট করে প্রাণ হরণ করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধান ও বিশেষজ্ঞ মহল অভিন্ন সুরে বলছে দেশে যে জঙ্গীপনার উত্থান ঘটেছে এর নেপথ্যে মূল নায়ক জামায়াত। জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডার কিলিং ও সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্যদের বড় একটি অংশ এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত। সূত্রমতে, দেশে যেসব সংগঠন জঙ্গীপনায় জড়িত এদের অধিকাংশে জড়িয়ে আছে জামায়াতের দুর্ধর্ষ ক্যাডার বাহিনীর সদস্য। সরকারীভাবে বলা হয়ে থাকে দেশের ৬টি জঙ্গী সংগঠনের মধ্যে বর্তমানে জেএমবি ও আনসারুল ইসলাম (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) তৎপর। কিন্তু আরও বহু নামে জঙ্গীপনার কর্মকা-ের বিস্তৃতি ঘটেছে। এদের সকলের আসল শেকড় জামায়াত থেকেই বিস্তৃতি। আর জামায়াত ভর করে আছে বিএনপির ওপর। জামায়াত ছাড়া বিএনপি যেমন মাজাভাঙা, তেমনি বিএনপি ছাড়া জামায়াতের অস্তিত্বই থাকে না। ভবিষ্যতে জামায়াতকে যদি নিষিদ্ধ করা হয় তারপরও ভিন্ন নামে জামায়াত-বিএনপিকে বাহুবন্ধনে রাখতে সচেষ্ট থাকবে। ধর্মের ব্যানারে ধর্মপ্রিয় সাধারণ মানুষকে সুড়সুড়ি দিয়ে এরা জনসমর্থন আদায় করার অপচেষ্টায় লিপ্ত সেই তখন থেকেÑ বিএনপি জামায়াত একই পতাকাতলে গিয়ে সরকার গঠন করে। আর তাদের মেয়াদকালীন সময়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লাইন ধরে নিয়োগ লাভ করেছে জামায়াত-বিএনপির ঘরানার সদস্যরা। যারা এখন বিন্দু থেকে বৃত্তে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ, আদালত আঙ্গিনা, গোয়েন্দা সংস্থা এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীতেও এদের কমতি নেই। বর্তমান সরকার পক্ষেই এরা যতই নিজেদের যতœবান হিসেবে প্রকাশ করার চেষ্টা করুক না কেন শেকড় কিন্তু আসল জায়গায় নিহিত। চট্টগ্রামে এসপিপতœী হত্যাকা-ের ঘটনার পর আদালত আঙ্গিনায় এ ধরনের ঘটনা নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে রিপোর্টও করা হয়েছে। সূত্র জানায়, টার্গেট কিলিংয়ের শুরুটা হয়েছিল ব্লগার হত্যার মধ্য দিয়ে। কিন্তু এখন তা আর সেই একটি জায়গায় সীমিত নেই। হত্যার শিকার হয়েছেন মুক্তমনা লেখক, খ্রীস্টান ধর্মের যাজক, হিন্দু ধর্মের পুরোহিত, বিদেশী নাগরিক এবং সর্বশেষ পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী। প্রায় সকল হত্যাকা-েরই দায় স্বীকার করেছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আনসার আল ইসলাম। শুধু চট্টগ্রামের এসপিপতœী হত্যার পর কোন পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করা হয়নি। তাই বলে ঘটনাটি যে একই গোষ্ঠী ঘটিয়েছে অনেকটাই নিশ্চিত পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। প্রশ্ন উঠেছে, দিনে দিনে এত জঙ্গী সংগঠন কিভাবে গড়ে উঠছে দেশের মাটিতে। এদের পৃষ্ঠপোষক কারা? পুলিশ বলছে, ভিন্ন ভিন্ন সংগঠনে থাকলেও এরা প্রায় সকলেই এক সময় সম্পৃক্ত ছিল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে। তাদের রাজনীতির পাঠশালা একই। জামা’আতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকত উল জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, হিযবুত তাহরী’র ও শহীদ হামজা ব্রিগেড এবং এ ধরনের নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনগুলো এখন দেশে বেশ পরিচিত ও আলোচিত। এখানেই শেষ নয়, এ ধরনের নতুন নতুন সংগঠনের জন্ম হচ্ছে। গ্রেফতার কিংবা আস্তানা আবিষ্কারের পর বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন নাম। এর মধ্যে ক’টি ক্রিয়াশীল আর ক’টি প্যাডসর্বস্ব তাও পরিষ্কার নয়। পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা আইজিপি শহীদুল হক রবিবার চট্টগ্রামে প্রেস ব্রিফিং ও সুধী সমাবেশে উল্লেখ করেছেন বেশ ক’টি জঙ্গী সংগঠনের নাম। তবে তার বক্তব্যে বাদ পড়েছে হিযবুত তাহরীর। এ সংগঠনটির বিস্তৃতি এখন বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি ইংরেজী মাধ্যমের নামী কলেজ-ভার্সিটিতেও। বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে তারা চাকরিও করছে। বিশেষ করে পুস্তিকা ও লিফলেটের মাধ্যমে এ সংগঠনের প্রচার সর্বাধিক। আইজিপির বক্তব্যে হিযবুতের নামটি না আসায় অনেকেই উষ্মা প্রকাশ করেছেন। আবার বলার সময় ভুলবশত নামটি বাদ পড়তে পারে এমনও মনে করেন কেউ কেউ। তবে পুলিশের এ শীর্ষ কর্মকর্তার বক্তব্যেও দেশজুড়ে টার্গেট কিলিংয়ের নেপথ্যে সন্দেহের তীর জঙ্গীগোষ্ঠীর দিকে। এ বিষয়টিকেও অবশ্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বোদ্ধা মহল। কেননা, মাঝে শুরু হয়ে গিয়েছিল ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পার পাওয়ার চেষ্টা। সর্বশেষ চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকা-ের পর নড়েচড়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঘোষণা দিয়েই শুরু হয়েছে জঙ্গী ও অপরাধী ধরার অভিযান। পুলিশের এই তৎপরতা সাধুবাদ পেলেও প্রশ্নÑ এমন একটি অভিযান শুরু করার জন্য কি তাহলে একজন এসপির স্ত্রী নিহত হবার প্রয়োজন ছিল? পুলিশের শীর্ষ পর্যায় এতদিনও জানত জঙ্গী সংগঠনগুলোর তৎপরতা, উৎপত্তি ও পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে। তবে সর্বশেষ বড় অগ্রগতি হলো, দেশে জঙ্গী আছে বলে স্বীকার করে নেয়া। কেননা, সমস্যা চিহ্নিত বা স্বীকার করা না হলে এর সমাধান কিংবা মূল উৎপাটনের প্রশ্নই যে আসে না। বাংলাদেশে একের পর এক গুপ্তহত্যার ঘটনা এখন আর বিচ্ছিন্ন বলে চালিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। সাম্প্রতিক কিছু হত্যাকা-ের পর প্রতিক্রিয়াই শুধু নয়, সরজমিন অকুস্থল পরিদর্শন ও নিহতের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। ইউরোপ, আমেরিকা ও প্রতিবেশী ভারতের কাছ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। খুনীদের ধরতে সাহায্যের অফারও দেয়া হচ্ছে। আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশ মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারদের আশ্রয় দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখা হলেও দেশের জন্য ঠিকই নেতিবাচক। বিদেশীদের উদ্বেগের পাশাপাশি আশ্রয়দানের চিন্তা ভাবনা প্রকারান্তরে এই ম্যাসেজটাই দিচ্ছে যে, বাংলাদেশে মুক্ত চিন্তা ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা নিরাপদ নয়।
×