ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হোতারা কেন পার পায়

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৩ জুন ২০১৬

হোতারা কেন পার পায়

শংকর কুমার দে ॥ দেশব্যাপী টার্গেট কিলিং বন্ধে দৃশ্যমান অগ্রগতির লক্ষ্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে মাঠে এখন দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল ইউনিট। টার্গেট কিলার কারা এবং তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিতে তৎপর গোয়েন্দারা। একই কায়দায় সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতাবলম্বীদের কুপিয়ে হত্যাকা- ঘটানো এবং হত্যাকা-ের পর পরই আন্তর্জাতিক ওয়েব সাইট থেকে আইএস’র নামে দায় স্বীকার করার ঘটনার নেপথ্যে যে সহিংস সাম্প্রদায়িক রাজনীতি জড়িত সেই তদন্তে নিশ্চিত তারা। কিন্তু টার্গেট কিলাররা কোথা থেকে এসে কিলিং শেষে আবার কোথায় গিয়ে অদৃশ্য হয়ে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে সেই প্রকৃত কিলারদের চিহ্নিতকরণ করে রহস্য উদ্ঘাটনের তদন্তে তৎপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেন, মাঠ পর্যায়ে তদারকির অভাব, গোয়েন্দা নজারদারির দুর্বলতা, তদন্তের ত্রুটির কারণে টার্গেট কিলাররা ধরা পড়ছে না, যার কারণে টার্গেট কিলিং বন্ধে দৃশ্যমান অগ্রগতি হচ্ছে না। প্রকৃত টাগেট কিলাররা ধরা না পড়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে একেক সময়ে একেক কথা বলার মধ্যদিয়ে অনেকটা অপরাধীদের ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করা হচ্ছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। কারণ কিছু দিন বিরতি দিয়েই একের পর এক টার্গেট কিলিং ঘটানো হচ্ছে এবং টার্গেট কিলিংয়ের শিকারে পরিণত হচ্ছে নিরীহ নিরপরাধ গ্রাম গঞ্জের বিশেষ করে হিন্দু ও খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের পাদ্রি, পুরোহিত ও ভিন্নমতাবলম্বীরা। যারা টার্গেট কিলিংয়ের শিকারে পরিণত হচ্ছেন তাদের আগে রেকি করা হয়, রেকি করার পর অগ্রবর্তী দল পাঠানো হয়, অগ্রবর্তী দলের দেখানো মতে কিলার গ্রুপ এসে চোখের পলকে টার্গেট কিলিং শেষে উধাও হয়ে যায়। তারপর আর টার্গেট কিলারদের হদিস করা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন ? উদাহরণ হচ্ছে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু (২৬)। প্রকাশ্য দিবালোকে তেজগাঁও এলাকায় অসংখ্য মানুষজনের সামনেই রাস্তায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয় তাকে। খুন করে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে এক হিজড়া ঝাপটে ধরে ফেলে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল নামের দুই মাদ্রাসা ছাত্রকে। গত বছরের এই ঘটনা। দুই টার্গেট কিলার ধরা পড়েছে। অদ্যাবধি হাতেনাতে ধরা পড়া দুই জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও তাদের নেটওয়ার্ক সন্ধান করে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি তাদের খুন করতে পাঠিয়েছে কারা ? এই ধরনের উদাহরণ আরও আছে। ২০১৩ সাল থেকে গত ৩ বছরে সারাদেশে ৪৯টি জঙ্গী গোষ্ঠীর হামলায় প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, পুরোহিত, মুয়াজ্জিন, ধর্মযাজক, বিদেশী, মানবাধিকার কর্মী, সেবক, দর্জি, মুদি দোকানি, পুলিশ ও পুলিশ পরিবারের সদস্য, হিন্দু, খ্রীস্টান, ভিন্ন ধর্মালম্বী ও মতাবলম্বীসহ ৫২ জনকে গুপ্ত হত্যা করেছে খুনী চক্র, যাদের পরিচয় বলা হচ্ছে জঙ্গীগোষ্ঠী। একই কায়দায় খুন করে চলেছে টার্গেট কিলাররা। এর মধ্যে গত শনিবার রংপুরের পুরোহিত উত্তম কুমার মোহন্তকে অপহরণের পর উদ্ধার করা হয়েছে। পাবনার হেমায়েতপুরে সেই একই কায়দায় খুন হলেন শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পা-ে (৬২)। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে। একই দিনে খুন হন নাটোরে মুদি দোকানি সুনীল গোমেজ। এর আগে খুন হন ঝিনাইদহে পুরোহিত আনন্দ গোপাল। এখন যারা নিহত হচ্ছেন তাদের মধ্যে অনেকেই হিন্দু ও খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী। মাত্র ৩ দিনের ব্যবধানে একই কায়দায় এসব খুনের ঘটনায় কূলকিনারা করতে না পারায় মারাত্মকভাবে গোয়েন্দাদের ভাবিয়ে তুলেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানান, তদন্তে গত কয়েকদিনের এসব হত্যাকা-ের মধ্যে রংপুর, ঝিনাইদহ, পাবনা, চট্টগ্রামের টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনার সঙ্গে শিবিরের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি। তবে এখন পর্যন্ত পরিকল্পনাকারী ও মদদদাতা কিংবা মাস্টার মাইন্ড কাউকেই আটক করতে পারেনি। এ ধরনের টার্গেট কিলিংয়ের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যত এখনও রয়ে গেছে অন্ধকারেই। এই পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য টার্গেট কিলার কারা এবং তাদের নির্দেশদাতাদের খুঁজে বের করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। যারা টার্গেট কিলিং করছে তারা একই কায়দায় মোটরসাইকেল যোগে এসে চাপাতি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গলা কেটে হত্যার পর গুলি করে হত্যাকা- নিশ্চিত করে নির্বিঘেœ পালিয়ে যাওয়ার পরও প্রকৃত খুনীরা চিহ্নিত হচ্ছে না কেন? এ কারণে এমন টার্গেট কিলিংয়ের সংখ্যা বেড়েই চলছে। একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনার পর পর তদন্তকারী সংস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ রহস্য উদ্ঘাটনের কথা বলে সন্দেহভাজনদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু টার্গেট কিলিং বন্ধ করা যাচ্ছে না। কেন টার্গেট কিলিং বন্ধ হচ্ছে না সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে গোয়েন্দারাও। পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হচ্ছে টার্গেট কিলিং, যা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা খুঁজেই পাচ্ছেন না। যেমন গত ৭ এপ্রিল সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে হত্যা করা হয়। দুই মাস পরও এ ঘটনায় জড়িত একজনকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে ইউএসএইড কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজে পাঁচজনকে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। এ ঘটনায় শরিফুল ইসলাম শিহাব নামে পুলিশ সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেফতার করলেও মূল আসামিরা এখনও ধরা পড়েনি। গত ৩০ এপ্রিল টাঙ্গাইলে হিন্দু দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দারকে হত্যা করা হয়। পুলিশ বলছে, ওই ঘটনায় জেএমবির সম্পৃক্ততা রয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু মূল আসামিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ছাড়া গত বছরের ২ নবেম্বর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার ঘটনায় একজনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলের ওপর হামলাকারীরা এখনও আইনের আওতায় আসেনি। এসব টার্গেট কিলিং ঘটলেও টার্গেট কিলাররা চিহ্নিত হচ্ছে না কেন? কিংবা কারা করছে তাও হদিস করতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। টার্গেট কিলারদের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিতে পারলে টার্গেট কিলিংয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটত না। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তের সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গী গোষ্ঠীর এসব হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনার বেশিরভাগ মামলারই কোন কূলকিনারা করা যায়নি, শনাক্ত হয়নি প্রকৃত খুনী যারা জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্য এবং এই ধরনের হত্যাকা-ের নেপথ্যের মূল হোতারাও রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ফলে কিছু দিন তৎপরতা বন্ধ রেখে আবারও একই ধরনের খুনের পুনরাবৃত্তি ঘটানো হচ্ছে, যার মধ্যে এবার পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যাকা-ের ঘটনায় জঙ্গী গোষ্ঠীর হত্যাকা-ের তৎপরতায় নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। প্রতিটি হামলার তদন্তের শুরুতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কোন কোন উগ্রপন্থী সংগঠনকে দায়ী করা হচ্ছে। দু’একজনকে ধরার খবরও দেয়া হচ্ছে। তারপর কয়েক দিন পরই কোথায় যেন তদন্ত মিলিয়ে যাচ্ছে, জঙ্গী গোষ্ঠীর খুনীরাও অধরা থেকে যাচ্ছে, আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে জঙ্গী গোষ্ঠী। তবে এসব জঙ্গী গোষ্ঠীর মধ্যে জেএমবি, এটিবি বেশি তৎপর। এই দু’টি জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে মিশে গেছে জামায়াত-শিবির। জামায়াত-শিবিরের শেল্টারেই এখন টার্গেট কিলিং ঘটানো হচ্ছে বলে মনে করেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, শরিফুল নামে এক জঙ্গী এবিটির সংগঠনের সদস্যদের সামরিক ও আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিত। টিএসসিতে অভিজিৎ রায়, গোড়ানে নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয়, লালমাটিয়ায় আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টা ও সাভারে শান্ত মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিয়াদ মোর্শেদ বাবু হত্যা মামলার তদন্তে তার সরাসরি উপস্থিতি এবং নেতৃত্ব দেয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। তা ছাড়া ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা, তেজগাঁওয়ে ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নাজিমুদ্দিন সামাদ এবং কলাবাগানে জুলহাস মান্নান ও মাহবুব তনয় হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী শরিফুল। এখন প্রশ্ন হলো শরিফুল কীভাবে নির্বিঘেœ এতগুলো হত্যাকা-ে অংশ নিয়ে এখনও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে? এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর মিলানো যাচ্ছে না বলেই একের পর এক টার্গেট কিলিং অব্যাহত আছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টার্গেট কিলিং মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, তথ্য আদান-প্রদানে অনেক দুর্বলতা ও ঘাটতি রয়েছে, যা দূর করা খুবই প্রয়োজন। টার্গেট কিলিং পুলিশ কর্মকর্তা স্ত্রী হত্যার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও যে টার্গেটে পরিণত হয়েছে তাতে জঙ্গী তৎপরতায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এ ছাড়াও নিরীহ সহজ সরল গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী হিন্দু, খ্রীস্টান, সংখ্যালঘু, ভিন্নধর্মাবলম্বী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের টার্গেট কিলিংয়ের নিশানায় পরিণত করার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক, যা বন্ধে সরকারকে আরও কার্যকর সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
×